Thursday 10 November 2016

'রাষ্ট্রপিতা' সুরেন্দ্রনাথ

- তমাল দাশগুপ্ত

এই দেশে রাষ্ট্রপিতা বা ফাদার অভ দ্য নেশন আখ্যা প্রথম কাকে দেওয়া হয়েছিল, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আজ আর কেউ জানে না। না, গান্ধী সেই ব্যক্তি নন। 

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তাকেই প্রথম রাষ্ট্রপিতার আখ্যা দেওয়া হয়, গৌরকিশোর ঘোষের একটা লেখায় জানতে পাচ্ছি। যদ্দুর আমি বুঝলাম, এরপরে, মরণোত্তর কালে ওটাকে রাষ্ট্রগুরুতে চেঞ্জ করা হয়েছিল, কারণ ততদিনে ওই রাষ্ট্রপিতা খেতাবের অন্য একটা পাকাপাকি জবরদখল হয়ে গেছে। 



আমি বাঙালি স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস যতই পড়ছি, ততই একটা প্রতীতি জন্মাচ্ছে। 

আমাদের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছিল বললে অল্প বলা হয়। আসলে ইংরেজ ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী এলিট বাঙালির সঙ্গে স্বদেশী বিপ্লবঘেঁষা বাঙালির কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছিল। আমাদের মডারেট অংশটির সঙ্গে আমাদের চরমপন্থীদের সাপে নেউলে সম্পর্ক হয়ে গেছিল। সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শেষ বাঙালি নিয়ন্ত্রক। সি আর দাশ (ততদিনে বাংলার অবিসংবাদী নেতা) সুরেন্দ্রনাথকে কোনঠাসা করে দিলেন, ব্যারাকপুর কেন্দ্রে জনৈক ডাক্তারকে দাঁড় করিয়ে দিলেন সুরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এবং সুরেন্দ্রনাথকে হারিয়ে সেই ডাক্তার, তার নাম বিধান রায়, জায়ান্ট কিলার বলে প্রখ্যাত হলেন। কিন্তু নেপোয় দই মেরে দিল, কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল গান্ধীর হাতে।

১৯২৩ সাল। এর পর সুরেন্দ্রনাথ আর মাত্র দুবছর বেঁচেছিলেন।

আজ সুরেন্দ্রনাথের জন্য মন খারাপ হচ্ছে। শেষজীবনে অপমানিত হয়েছেন, বাঙালি দুয়ো দিয়েছে। আবার বাঙালির রক্তে তখন সর্বনাশের নেশা, এই জাতি রুষ্ট হয়েছে, সেই মহাক্রোধ রুদ্ররূপী মহাকাল হয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ছারখার করে দিতে উদ্যত। কাকে দোষ দেব? 

সুরেন্দ্রনাথকে জানলে বাঙালির এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের অস্তরাগ জানা যায়। বাঙালি তখন ইংরেজ রাজত্বের সেকন্ড ইন কম্যান্ড। এই দেশ বাঙালিকেই দিয়ে যেতে হত, কলকাতা আবার হত এই দেশের রাজধানী, যদি বাঙালি রাজনীতির কূটনীতি ঠিক ভাবে করত সেসময়।

আমরা কি ঠিক করেছিলাম? সুরেন্দ্রনাথ আর চিত্তরঞ্জনের মধ্যে আমরা দ্বিতীয়জনকে বেছেছি, আমরা কি ঠিক করেছিলাম? ইতিহাস বলছে, এই জাতির তখন এক দুরন্ত যৌবন এসেছে। বঙ্কিম বিবেকানন্দ অরবিন্দ আমাদের বিপ্লবে দীক্ষা দিয়ে গেছেন। সেই রোমাঞ্চ এই জাতির জীবনে খুব দরকার, অনেকটা যৌবনে যৌনতা যেমন দরকার।

বাঙালি যেন একটা উড়নচণ্ডী প্রেম করেছে তখন। বাঙালি শান্ত ধীর স্থির থেকে বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে-মেয়ে হয়ে সাজানো গোছানো বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই পারত। কিন্তু বাঙালি ঘর ছেড়েছে, অবাধ্য সন্তানের মত। বিপ্লবের সঙ্গে তার সপ্তপদী। তার ফলে যে ভোগান্তি, যে নির্যাতন, যে কষ্ট, যে অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, যে শাস্তি সে পেয়েছে, বাংলাকে টুকরো করে, বাঙালিকেই উচ্ছেদের যে বিশ্বমানবিক বন্দোবস্ত ইংরেজ করে গেছে, সে বর্ণনা করতে গেলে শরতবাবুকে আবার কলম ধরতে হয়। সে চিরন্তন দুঃখী রূপকথা পাষাণেরও চক্ষু সজল করে দেবে।

বাঙালি কি ভুল করেছে? জাগতিক হিসেবে ভুল তো বটেই। তবে আহা, এমন ভুল কি যে সে করতে পারে গো? এর জন্য কলজের জোর লাগে, হৃদয়ের অনুরাগ লাগে, মস্তিষ্কের অকুতোভয়তা লাগে। পৃথিবীতে আর কটা জাতের আছে?

তবে ওই আর কি। রাজার দুলালী আজ ভুঁয়েতে গড়ায়। হায় বিধি নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।

(সপ্তডিঙা ২০১৬ মার্চ সংখ্যায় অণুপ্রবন্ধ সংকলনে প্রকাশিত, ১০ মার্চ ফেসবুকের পোস্ট) 

Friday 4 November 2016

তোমার ছায়া, পূর্বমানুষ


তমাল দাশগুপ্ত



এক



আমি কপাল থেকে ঘামের মতো মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম
আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাওয়ার বদলে মাইরি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম

--সুনীল গাঙ্গুলী


মধ্যরাত। দিনকাল বড় গুমোট। আজ ছিল ছয়ই জুন,সাত তারিখ শুরু হয়ে গেছে বিলিতি মতে, দুহাজার পাঁচ সাল। যদিও সময়ের হিসেব ঘড়ির মাপে হচ্ছে না আর। ক'টা মৃতদেহের পেছনে লাইন দিয়েছে আমাদের বডি, সেই হিসেবে সময় কাটছে। সে দিনটা ছিল অমাবস্যা, কিন্তু শ্মশানে তো আলোর অভাব নেই। ইলেক্ট্রিক চুল্লীতে আলো, কাঠের চিতায় আলো। ল্যাম্পপোস্টগুলোও আলো বিকিরণ করছে। আমি গঙ্গার ধারে বসে ছিলাম। খানিক দূরে কিছুটা আড়ালে বাচ্চু ওর ইয়ারদোস্তদের নিয়ে বসে গুলতানি করছে। শ্মশানের ইন চার্জের সঙ্গে ব্যবস্থা করে এসেছে, এইবার গঙ্গার ধারে বসে বসে কিঞ্চিৎ গাঁজা খাবে।


সিপিএম করে ওরা সবাই, সিপিএম করাটা অবিশ্যি প্রায় আমাদের পারিবারিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যে লোকটা এখন বডি হয়ে শুয়ে আছে, সে অন্যরকম ছিল। সে ছিল প্রথা বহির্গতখানিকটা ব্রাত্য।


বাচ্চু আমার পিসতুতো ভাই। আমার তিন পিসি, তিনজন পিসতুতো ভাই। বাচ্চুর দলবল আজ আমাদের শ্মশানবন্ধু। দাদু মারা গেছে শুনে বাচ্চু ওর ছেলেদের নিয়ে মহা উৎসাহে চলে এলো। এতদিন অন্যের বাড়ির মড়া পোড়াত, আজ নিজের দাদুর মড়া পোড়াবে। ও আমার মেজপিসির ছেলে, মধ্যমগ্রাম নবপল্লীর বাসিন্দা। আমাদের বাচ্চু গুণ্ডামি করে, পরোপকার করে, ভোটের সময় বুথ দখল করে, এবং সমাজসেবা করে। দুঃস্থ লোকের মড়া পোড়ানোর কাজটা আগেকার দিনে এরকম ছেলেরাই করত। নেহাত আগেকার দিনের মত, শরৎচন্দ্রের দিনকালের মত দুঃস্থ লোকের মড়া আর অত সুলভ নয়, আর এদিকে সৎকার সমিতিও ফোন করলেই চলে আসে। বাচ্চুর দলবলকে দেখে কিরকম মনে হচ্ছে, এতদিনে ওদের একটা বহুদিনের অ্যাম্বিশন পূর্ণ হল।



নার্সিং হোম থেকে বডি আনতে আনতে সন্ধে হয়ে গেল। ঠাকুরদা ভোররাতে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাড়িতে তখন সবসময়ের কাজের লোক সনাতন ছাড়া আর কেউ ছিল না। পাড়ার কয়েকজনই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে গেল। দাদু এই বাড়িতে একাই থাকত, অনেক বলা সত্ত্বেও আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে থাকতে রাজি হয়নি। এদিকে আমার আজ এম ফিলের পরীক্ষা ছিল। প্রথম বছরের শেষে যে পরীক্ষাটা হয়। পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আমি মোবাইল অন করলাম। নোকিয়া ৩৩১৫। সঙ্গে সঙ্গে একটা মেসেজ এলো। নাম্বারটা দেখাচ্ছে, নাম নয়, ফোনবুক লোড হতে একটু সময় লাগে। তবে নম্বরটা চেনা, দেব্দার। দেব্দা আমার পিসতুতো দাদা। মেসেজে দেখলাম লিখেছে দাদু এক্সপায়ার্ড। কল মি এ এস এ পি।


আজ কলেজে পড়াতে যাওয়া ছিল না। আশুতোষ ইভিনিং কলেজে পার্ট টাইম, আর ক্ষুদিরাম বোস কলেজে গেস্ট পড়াই আমি। আজ সেদুটোর কোনওটাতেই যাওয়ার ছিল না। আমি দেব্দাকে ফোন করলাম, শুনলাম ও এখন বডি নেওয়ার ফর্ম্যালিটিগুলো করছে শ্যামবাজারের নার্সিং হোম-এ। আমি সেখানে যাব কি না জিগ্যেস করায় আমায় বলল, না, আমি যেন নিউব্যারাকপুরে চলে গিয়ে ওদিকটা দেখাশুনো করি। বাচ্চুও যাচ্ছে নিউব্যারাকপুরে, কিন্তু ও যা ছেলে, উলটো গিঁট পাকিয়ে ফেলতে পারে, অতএব আমি যেন এক্ষুনি চলে যাই, গিয়ে ওদিকের যোগাড়যন্ত্র করি। আন্দাজ সন্ধে সাড়ে ছটার মধ্যে ওরা লরিতে করে বডি নিয়ে বাড়িতে ফেলবে, সেখানে ফুলচন্দন ইত্যাদির ব্যবস্থা আমি যেন ইতিমধ্যে করে রাখি। আর হ্যাঁ, আমার বাবাকে সামলানোর কাজটাও যেন করি। আমার বাবা মা দুজনেই বর্তমানে নিউব্যারাকপুরের বাড়িতে চলে গেছে বাগবাজারের ফ্ল্যাট থেকে। সমস্ত ইনস্ট্রাকশন শুনে প্রায় পুজোবাড়ির আয়োজন হচ্ছে মনে হল। শোক করার সময় কেউ খুব বেশি পাবে না, দৌড়োদৌড়িতেই সময় বেরিয়ে যাবে।

ঠাকুরদার আশি বছর বয়েস হত আর ঠিক দুসপ্তাহ পরে। অসময়ে বা অকালে চলে গেছে বলা যায় না।


আমি যখন ট্রেন থেকে নামলাম নিউব্যারাকপুর স্টেশনের দুনম্বর প্ল্যাটফর্মে, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে হল্টের দোকানগুলোয়। শুনেছি একসময় এখানে স্টেশন নয়, হল্ট ছিল। সেসব পঞ্চাশের দশকের কথা। স্টেশন হওয়ার পরেও পুরোনো লোকেরা হল্ট বলার অভ্যেস বজায় রেখেছিল, তাদের দেখাদেখি আমরাও হল্ট বলতে শিখেছিলাম। আমি নিজেই অবশ্য ছোটবেলায় নিউব্যারাকপুরে দুনম্বর প্ল্যাটফর্ম তৈরি হতে দেখেছি। আগে শুধু একটাই প্ল্যাটফর্ম ছিল।


সন্ধেবেলা বাড়িতে ঢুকেই প্রথম তুলসী মঞ্চের দিকে চোখ পড়ল। আমার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে আসছে। রোজ সন্ধ্যায় এই তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বলত, রোজ সন্ধ্যায় এই বাড়িতে শাঁখ বাজত।


আজ এই বাড়ি থেকে এই বাড়ির নির্মাতা শেষবারের জন্য বেরিয়ে যাবে। রাজার সাজে।


বডি নিয়ে আসতে ওদের বেশি দেরি হল না। চন্দন দিয়ে সাজানোর সময় কেউ আর বডি বলছে না, ঠাকুরদা হয়ে উঠছে ঠাকুরদার মৃতদেহ, ফুল দিয়ে তার শেষশয্যা সেজে উঠছে। দেখলাম মুখটা বেশ প্রশান্ত।

যখন ঠাকুরদাকে খাটসহ লরিতে তোলা হচ্ছে, আচমকা 'বাচ্চুর দাদু মাইকি জয়' জিগির তুলে বসল বাচ্চুর দলবল। শোকস্তব্ধ পরিবেশে সেই আচমকা ভাসানঘোষণা বয়স্কদের খানিকটা ভড়কে দিয়েছিল। অভ্যেসবশত করে থাকবে, ফি বছর নবপল্লীর দুর্গাঠাকুরকে লরিতে তোলার সময় যেমন করে। আমার পঞ্চান্ন বছরের বাবা তার আশি বছর বয়সী বাবার জন্য কেঁদে এমনিতেই চোখ লাল করে ফেলেছিল, সে রক্তচক্ষু তুলে কটমট করে তাকাল একবার। বাচ্চুর বাবা মানে আমার মেজপিসেমশাই ধমক দিয়ে এদেরকে থামিয়ে দিয়েছে, তাই আর ব্যাপারটা নিয়ে কোনও অসৈরণ হল না। ভেবে দেখলাম ব্যাপারটা, ভাসানই তো। এও তো দশমী দিবস। শেষ দশমী। আসছে বছর আর হবে না।


ভদ্রলোক একাই থাকতেন শেষের দিকে নিউব্যারাকপুরে নিজের বানানো বাড়িতে। পিসিরা যে যার বাড়িতে, তবে কেউই খুব দূরে নয়। আমি-বাবা-মা বাগবাজারের ফ্ল্যাটবাড়িতে চলে এসেছিলাম, অনেক আগেই। কলকাতায় থাকলে যাতায়াতের সুবিধা। দ্বিজেন দাশগুপ্ত খুব একা হয়ে গেছিলেন শেষ জীবনে। ঠাকুমা দশ বছর আগেই মারা গেছিলেন, আমি তখন স্কুলে পড়ি।

তবে বরাবরই লোন উলফ ছিল লোকটা। না, উলফের সঙ্গে তুলনাটা ভুল দিলাম। আসলে লোকটা বাঘ ছিল। শান্তশিষ্ট একটা রাজকীয় বাঘ। আমার ঠাকুরদা, দ্বিজেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত।

আমি লরির ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে। পশ্চিমদিকে, গঙ্গার উদ্দেশ্যে লরি চলছে। বাবার এক মামাতো ভাইও রয়েছে সঙ্গে। গণেশকাকু। ঠাকুরদার ছিল চার সন্তান, এক ছেলে আর তিন মেয়ে। আমার তিনজন পিসি নিউব্যারাকপুরের বাড়িতে তো এসেছেন, কিন্তু তারা শ্মশানে যাবেন না, আমার মা-ও যাবেন না। আমাদের পরিবারে মেয়েরা শ্মশানে যায় না, এটাও একটা প্রথা। তাই শেষযাত্রায় তিন পিসেমশাই রয়েছেন। তিনজন পিসতুতো ভাই রয়েছে। মেজজনের দলবলের কথা তো আগেই বলেছি। আছি আমি আর বাবা। গণেশকাকুও। মোট আঠেরো জন জীবিত মানুষ। আর একটা মৃতদেহ। আশি বছর বয়েসী একটা বৃদ্ধ বাঘের মৃতদেহ।





দুই



এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে চাঁদ ডাকে আয়, আয়, আয়।
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে চিতা কাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়।
---শক্তি চট্টোপাধ্যায়


সিগারেট খাচ্ছিলাম গঙ্গার ধারে বসে। এখনও তেরোটা বডির পেছনে লাইন দিয়ে শুয়ে আছে ঠাকুরদা। বাবা ওদিকে ক্লান্ত হয়ে আধশোয়া অবস্থায় এলিয়ে পড়েছে বেঞ্চিতে, সঙ্গে পিসেমশাইরা আর গনেশকাকা। শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে কাগজপত্র রেডি করার কাজটা দেব্দা করে ফেলেছে। বাকিরা সবাই খুব দার্শনিক মুখ করে ঝিম মেরে বসে। শ্মশানে এলেই বোধহয় সবাই খুব উদাসীন হয়ে পড়ে।


এতক্ষণ লরিতে সবাই চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম, আগলে রেখেছিলাম, কিন্তু মৃতদের পোড়ার লাইনে দ্বিজেন একাই শুয়ে আছেন সাদা চাদরের ওপরে, সাদা চাদরের নিচে। অন্যান্য মড়ারাও একা। শবযাত্রীরা সবাই লাইনে বডি পেতে এদিক ওদিক কেটে পড়েছে। একটু আগে খাটটা বাচ্চুর দল সশব্দে ভেঙে এল। ওই খাট দিয়ে জ্বালানি হবে না আবার নতুন খাটিয়া হবে, কে জানে।

তেরোটা বডি। সামনে দালান, তাতে দুটো ইলেক্ট্রিক চুল্লী। একটা বডি পুড়তে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় মিনিমাম লাগছে দেখলাম। মানে চারঘন্টা লাগবেই।


দ্বিজেন মাহেন্দ্রক্ষণে পুড়বেন যা মনে হচ্ছে।

আমি গঙ্গার দিকে চেয়ে বসে থাকি। শ্মশান আমার পেছনে, আর সামনে জল। পেছনে খানিক তফাতে আগুন জ্বলছে, কাঠের চিতা পাশাপাশি তিনটে। তিনজন মানুষ জ্বলছে। কাঠে অবশ্য আমরা পোড়াবো না, কারণ ওই যে বাঁশ দিয়ে মাথা ভাঙা, সেটা আমাদের কারও বরদাস্ত হবে না।

ধর্মভীরু মানুষদের আত্মীয়রা অবশ্য এখনও কাঠের চিতা পছন্দ করে। একটা চিতার সামনে খানিক আগে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, মৃতর চামড়া পুড়ছে, সাদা চর্বির আস্তরণ বেরিয়ে আসছে। একটা হাত উঠে গেছে কিভাবে যেন আকাশের দিকে। চিতা থেকে আগুনশিখা উর্ধ্বগামী হয়ে স্বর্গের দিকে মুখ তুলে দেখছে, দেবযান আর কত দেরি করে পৌঁছবে।

মানুষটি আগুনের উর্ধ্বে, আগুন তাকে নিচে থেকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সে ক্রমে আগুনের পরপারে চলে গেল, ছাই হয়ে যাচ্ছে মানুষটি। সে চন্দন ছাড়িয়ে চলে যাচ্চে, অগুরু ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। সে সমস্ত প্রিয়জনের অশ্রু ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে, সে অগ্নি ও কাষ্ঠের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। পেছনে পড়ে থাকছে তার স্মৃতি, অন্য মানুষদের মনে। একটা রক্তমাংসের কমনম্যান আজ মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার স্মৃতিও একদিন মিলিয়ে যাবে।


এই দ্বিজেন দাশগুপ্তের কাছে হাতেখড়ি হয়েছিল আমার। তার ছোট্টখাট্টো বইয়ের আলমারির কাঁচদরজা খুলে ক্লাস থ্রিতে প্রথমবারের জন্য বঙ্কিম রচনাবলী নামিয়েছিলাম। ঠাকুরদার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আগের মাসে, আমার জন্মদিনে গেছিলাম সকাল সকাল একবার দেখা করে আসার জন্য। তখন লোকটা বাইরের বারান্দায় খালিগায়ে বসে শেকসপিয়ার পড়ছিল। বঙ্কিম আর শেকসপিয়ার, এ দুটোই খুব প্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ সে লোকটার তেমন ভালো লাগত না। কিন্তু সাহিত্য আলোচনা বাদ থাক আজ।


আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ঠাকুরদার সঙ্গে একবার কথা বলি। তার কথা শুনতে ইচ্ছে করছিল, তার নিজের কথা। তার গলা আরেকবার শুনতে ইচ্ছে করছিল। সে যখন আমার মত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কলকাতায়, যখন ছাত্র ছিল, যখন আমার মত ছিল, যখন অল্পবয়েসী ছিল, তখনকার কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। সেই সব কথা লিখে রাখতে ইচ্ছে করছিল। আমি প্রাচীন সভ্যতার লিপিকারের মত তার স্মৃতি, তার শব্দকে ধরে রাখব আজ সঙ্কেতের ভাষায়, এরকম একটা বেয়াড়া ইচ্ছে জাগল।


তোমার সঙ্গে একটিবার কথা বলতে চাই দাদু, শুনতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ, জীবন ও মৃত্যু দেখে নেওয়া পূর্বমানুষ?

গঙ্গার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ একা একা। একসময় দেখলাম, ঠাকুরদা আমার পাশে এসে বসে আছে। আমি একটুও চমকালাম না, অবাক হলাম না। শুধু সিগারেটটা নিভিয়ে ফেললাম। দূরে শ্মশানের লাইন, সেখানে এখন দ্বিজেন দাশগুপ্তর মৃতদেহ। আমার পাশে যে দ্বিজেন দাশগুপ্ত, সে এখনও বেঁচে আছে। আমরা দুজন পাশাপাশি বসে রইলাম নির্বাক হয়ে। আমাদের সামনে গঙ্গা নদী, সেখানে এই জাহ্নবী জীবন দুর্গানাম নিয়ে ত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছিল গঙ্গাবক্ষে এক নৌকোচালক, বহু আগে। হয়ত আজও তার পুনরাবৃত্তি হয় রোজ।







তিন



সেই শৈশবের থেকে এ-সব আকাশ মাঠ রৌদ্র দেখেছি; এই সব নক্ষত্র দেখেছি।

---জীবনানন্দ দাশ


১৯২৫ সালে ১৮ই জুন জন্মেছিলাম। জন্মের দিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল, সে বছরের প্রথম বর্ষা নাকি। বানে সব ভেসে গেছিল, তাই আমায় সবাই বানা বলে ডাকত। আমাদের গ্রামের নাম হয়বতপুর, মহকুমা নলছিটি, জেলা বরিশাল। আমার জন্মের কয়েকদিন আগে ওই জুন মাসেই গান্ধীজি বরিশালে এসেছিলেন, আশেপাশের গ্রামের অনেকেই বরিশাল টাউনে ছুটেছিল তাঁকে দেখতে। বাবা সেসময় সতীন সেনের সহকর্মী, গান্ধীজির অভ্যর্থনা সমিতির মেম্বার হয়েছিলেন।


আমার জন্মের বছরেই প্রথমবারের জন্য সরস্বতী পুজো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল বরিশাল জুড়ে সমস্ত সরকারী আর বেসরকারী স্কুলে, মৌলবীদের উস্কানিতে। সতীন সেন ১৯২১ সাল থেকেই বরিশাল কংগ্রেসের নেতা, গুরুতর অসুস্থ অশ্বিনী দত্তের শূন্যস্থান ভরাট করেছিলেন বলা যায়। সতীন সেন সেসময় গান্ধীজির আর দেশবন্ধুর ডাকে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। আমার জন্মের পরের বছরেই পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ শুরু হবে। হ্যাঁ, সেই চীনে প্রবাদটার কথাই মনে পড়ে। আমি ইন্টারেস্টিং সময়ে জন্মেছিলাম।


আমরা হয়বতপুরের দাশগুপ্তরা একসময় বংশানুক্রমিকভাবে রাজা রাজবল্লভের কর্মচারীর কাজ করতাম। এই অঞ্চলে রাজার জমিদারি যা ছিল, সেগুলো দেখাশোনা করার জন্য রাজা আমাদের পূর্বপুরুষ ত্রিভুবনচন্দ্র দাশগুপ্তকে ইংরেজি ১৭৫১ সালে এই গ্রামে পাঠিয়েছিলেন। এই দাশগুপ্তরা কুলীন বৈদ্য ছিল, আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুর। রাজা রাজবল্লভ তাঁর মেয়ের একবার বিধবা বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন শুনেছি, সেসময় পাত্র হিসেবে নাকি এই ত্রিভুবনের এক তুতো দাদার কথাই রাজার বিবেচনায় ছিল। কিন্তু নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্যাগড়া দেওয়ার ফলে আর রাজা সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। ত্রিভুবন ছিলেন অনাথ, জ্যাঠার বাড়িতে মানুষ। সেই জ্যাঠা রাজা রাজবল্লভের একজন অন্তরঙ্গ, মানে অন্যতম ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন ঢাকায়। সেসময় ত্রিভুবন দাশগুপ্তও ঢাকাতেই থাকতেন, বলা বাহুল্য। ত্রিভুবন ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন। রাজার কাছে ষোলো বছর বয়েসে ত্রিভুবনকে রাজার সমীপে নিয়ে যান তার জ্যাঠা, রাজা তখন নতুন তালুক কিনেছেন, ত্রিভুবনকে যোগ্য দেখে পাঠিয়ে দিলেন নলছিটির হয়বতপুরে নায়েব-সেরেস্তাদারের কাজ দিয়ে। নামেই সেরেস্তাদার, আসলে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে পাঠান রাজা ত্রিভুবনকে। এর বেশ কিছু বছর পরে পলাশীর যুদ্ধ এবং নবাবী আমল শেষ, ইংরেজ আমল শুরু। রাজবল্লভকে কয়েক বছর পরে ডুবিয়ে মারে মিরকাশিম। এইসময় নাকি হয়বতপুরের উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশাল জাঙ্গালিয়া নদীর চণ্ডীঘাটে রাজার তরবারি ভেসে উঠতে দেখেছিলেন ত্রিভুবন, তিনি সেটাকে তুলে রাখেন। আমাদের মূল জমিদারবাড়িতে সেটা রাখা আছে, দুর্গোৎসব-শ্যামাপূজা-জগদ্ধাত্রীপূজার দিন সেটায় সিঁদুর মাখিয়ে ঈষ্টদেবীর সামনে রাখা হত। ত্রিভুবনের বংশের সবাই শাক্ত ছিলেন। কিন্তু ত্রিভুবন বিবাহসূত্রে বৈষ্ণববংশের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন। এজন্য শুনেছি আমাদের বাড়িতে ছাগবলির বদলে নিরামিষ বলি শুরু হয়।


ত্রিভুবনের দুই বিবাহ ছিল, খুলনার সেনহাটীর প্রসিদ্ধ বৈদ্য, কুলীনশ্রেষ্ঠ হিঙ্গু সেনের বংশধর কবিরাজ রামতারণ সেনের দুই মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। দুইপক্ষে মোট পাঁচজন পুত্র জন্মায়, একটিও কন্যা হয়নি। হয়বতপুরের দাশগুপ্তরা সবাই ত্রিভুবনের এই পাঁচ ছেলের বংশধর, তাঁর আগে এই গ্রামে বৈদ্য ছিল না। এখনও হয়বতপুরে মূলত নমঃশূদ্র আর মুসলমানদের বাস। অল্প কয়েক ঘর ব্রাহ্মন আর কিছু কায়স্থ অবশ্য আছে। আমার জন্মের কালে মোট কুড়ি ঘর বৈদ্য ছিল হয়বতপুরে, তার মধ্যে দুই ঘর সেনগুপ্ত, যারা ত্রিভুবনের নাতনির সঙ্গে বিবাহসূত্রে হয়বতপুরে চলে আসা জামাতাবংশ। এ ছাড়া বাকিরা সবাই ত্রিভুবনেরই বংশধর।

ত্রিভুবনের ছোট ছেলে রামজীবন ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। ত্রিভুবন পারিবারিক ব্যবসা, অর্থাৎ বৈদ্যবৃত্তি থেকে সরে এসেছিলেন, কিন্তু রামজীবন কবিরাজ হিসেবে তরুণ বয়েসেই প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি আয়ুর্বেদশাস্ত্রে সুপণ্ডিত তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে ন্যায়শাস্ত্রে ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ। একবার দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন নৈয়ায়িকদের নিয়ে এক তর্কসভার আয়োজন করেছিলেন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশের যুবরাজ, নামটা বোধহয় পরমেশ্বর বসু। চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশ তখন নামেই, আসলে ওরা জমিদার তখন। মা সরস্বতীর এক পা নবদ্বীপে এবং অন্য পা বাকলায়, এরকম প্রবাদ চালু ছিল মধ্যযুগের বাংলায়, ইংরেজ আমলেও সে খ্যাতি বজায় ছিল। সে তর্কসভায় রামজীবন উপস্থিত ছিলেন। ন্যায়চুঞ্চু উপাধির এক মহাপণ্ডিত ব্রাহ্মণের সঙ্গে রামজীবন তর্কে নামেন এবং তাকে পরাজিত করেন। তর্কসভায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা রামজীবনকেই দেওয়া হোক, এই মর্মে যখন বাকিরা আন্দোলন করছেন, অপমানিত বোধ করে রামজীবনকে সেই ন্যায়চুঞ্চু নামক ব্রাহ্মণ পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দেন, বৈদ্য হয়ে ব্রাহ্মণকে এইভাবে সর্বসমক্ষে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দেওয়ার পাপে, নিজের বৈদ্যত্ব অতিক্রম করে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার অপরাধে রামজীবনের বংশে কেউ আর কোনওদিন আয়ুর্বেদজ্ঞ হতে পারবে না, চিকিৎসক হতে পারবে না। রামজীবন প্রথমে হতবাক হয়ে যান। তারপরে তিনিও পালটা অভিশাপ দেন নিজের পৈতে ছিঁড়ে- এই ব্রাহ্মণ অন্যায়ভাবে আমায় অভিশাপ দিয়েছেন, তর্কযুদ্ধে জয় পরাজয় থাকেই। বৈদ্যজাতি প্রাচীন কাল থেকেই ব্রাহ্মণদের সমকক্ষ হিসেবে ন্যায়চর্চা করেছেন, এই ব্রাহ্মণ নিজের সঙ্কীর্ণ দম্ভে অন্ধ হয়ে আমার ভবিষ্যত বংশধরদের প্রতি অন্যায় শাস্তির ঘোষণা করেছেন, তাই আমি অভিশাপ দিচ্ছি, এ ব্রাহ্মণ তার ব্রহ্মত্ব খোয়াবে এবং ব্রহ্মদৈত্যে পরিণত হবে। সত্যি মিথ্যে জানি না, কিন্তু লোকে বলে, এই ন্যায়চুঞ্চু এর পরে নিয়তির আশ্চর্য চক্রান্তে সত্যিসত্যি ব্রাহ্মণত্ব হারিয়েছিলেন। বুড়োবয়েসে এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে নিকে করেন, এবং হিন্দুসমাজ থেকে বহিষ্কৃত হন। শেষ বয়েসে কশাইয়ের ব্যবসা ধরেছিলেন।


যাই হোক, এরপর রামজীবন নৌকোযোগে ফিরে আসেন নলছিটিতে। সে দিনটা ছিল বিজয়া দশমী। আমি যেন নিজের চোখে রামজীবনের সেই বিষণ্ণ মুখে পড়ন্ত বিকেলে নৌকো থেকে হয়বতপুরের ঘাটে নামা দেখতে পাই।

এই রামজীবনের বংশেই আমি জন্মেছি, আমি রামজীবনের থেকে সপ্তম পুরুষ। কি আশ্চর্য, রামজীবনের বংশধরদের মধ্যে আর একজনও কবিরাজি করেন নি, এমনকি ইংরেজ আমলে ডাক্তারিও নয়। আমার বাবা চারুচন্দ্র ছিলেন বরিশাল কোর্টের মোক্তার, আমার ঠাকুরদা রামতনু বরিশালে ইংরেজদের স্টিমার কম্পানির হৌসে বড়বাবু ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে সেদিনের দুটো অভিশাপই খুব জোরদার ছিল, এবং লেগে গেছিল।

আমাদের অন্যান্য জ্ঞাতিদের মধ্যে অবশ্য কবিরাজি করতেন অনেকে। অভিশাপ শুধু রামজীবনের বংশেই লেগেছিল।

অগ্নিযাত্রা নামে একটা পারিবারিক প্রথা উদযাপন করতাম প্রত্যেক বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় আমরা, দাশগুপ্তবাড়ির প্রতিমার ভাসান হয়ে গেলে। এই অগ্নিযাত্রা শুধু রামজীবনের বংশধরেরা করত। রামজীবনের সেই দশমীতে হয়বতপুর ফিরে আসার স্মৃতিতে। বস্তুত রামজীবনের ওপরে নেমে আসা অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য পারিবারিক উপাচার ছিল এই যাত্রা। পঞ্চধাতু, পঞ্চফল, পঞ্চপুষ্প, পঞ্চতৈল, পঞ্চামৃত – একটি বড়সড় মাটির প্রদীপ ঘিরে এগুলো রাখা থাকত সিঁদুর মাখিয়ে, আমরা রামজীবনের বংশধরদের পরিবারদের সব সদস্য গোল হয়ে সেগুলো ঘিরে বসতাম। আমরা মোট পাঁচঘর জ্ঞাতি ছিলাম রামজীবনের ওপরে সেই ব্রাহ্মণের অভিশাপের বাহক। আমরা সবাই বিজয়া দশমীর দিন একজায়গায় জড়ো হতাম, আমাদের, মানে রামতনু দাশগুপ্তের বানানো দালানবাড়িতেই এই গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান হত। এই রিচুয়াল শুধুমাত্র রামজীবনের বংশধরদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, এমনকি কুলপুরোহিতও সেখানে উপস্থিত থাকতেন না। পঞ্চধাতুসহ সমস্ত উপাদান একবার করে অগ্নিস্পর্শ করানো হত, তারপর সেগুলো আমরা কপালে ঠেকাতাম। কোনও মন্ত্রোচ্চারণ নয়, শুধু নীরবে সবাই একটি অগ্নিশিখাকে ঘিরে বসে আছে। সে পরিবেশের কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। সবশেষে সেই সাগ্নিক প্রদীপটি নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। এই রহস্যময় তান্ত্রিক আয়োজন করে রামজীবনের বংশধরদের কি লাভ হয়েছে কে জানে। হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের কেউ আবার ডাক্তার হবে, বলা যায় না।

রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুর পর রাজার বংশধরেরা জমিদারি আর ধরে রাখতে পারেন নি, সেগুলো খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, এরপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যখন শুরু হচ্ছে, তখন থেকে দাশগুপ্তরাই হয়বতপুরের জমিদার হয়ে বসে। সে জমিদারি কিনেছিলেন ত্রিভুবনের বড় ছেলে, রামতারণ। ছোটছেলে রামজীবনের কথা তো আগেই বলেছি। রামজীবনের পুত্র রামশরণ, তস্য পুত্র রামলাল, তস্য পুত্র অভিরাম, তার ছেলে রামতনু, রামতনুর ছেলে চারুচন্দ্র। এই চারুচন্দ্র দাশগুপ্ত, আমার বাবা, ছিলেন বরিশাল শহরে মোক্তার। ঠাকুরদা রামতনু বাবার ছোট বয়েসেই মারা গেছিলেন, আমি তাঁকে দেখিনি। আমার এক দিদি আর দুই দাদা ছিল, আমি কনিষ্ঠতম। ছোড়দা যখন অপঘাতে মারা যায়, তখন আমার বয়েস ন'বছর। সেটা এক আশ্চর্য কাহিনী। আমায় সেদিন কেউ বিশ্বাস করেনি। ছোড়দা মারা গেছিল এক ডাকিনীর হাতে আমার চোখের সামনেই। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, আমি প্রত্যক্ষদর্শী।


ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে শীতকাল এলেই খেজুরগাছের রস জোগাড় করার ধুম পড়ত। আমাদের এদিকের মাটিতে খেজুরের মত শুকনো জমির গাছ বেশি জন্মাত না। আমি আর ছোড়দা ভোররাতের বেলায় দত্তদের খেজুরগাছের রস চুরি করতে গিয়েছিলাম। ওই অঞ্চলের তেজারতির কারবার করে প্রচণ্ড ধনী হয়েছিলেন বিজয় দত্ত। তার ছিল একটা খেজুরবাগান। পনেরো কুড়িটা খেজুরগাছ ছিল, গাছের টঙে পেরেক বিঁধিয়ে নিচে একটা হাঁড়ি বেঁধে দিত। সারারাত ধরে সেই সব হাঁড়িতে অসামান্য রস জমা হত। তার একটা দুটো হাল্কা করে দিলে কোনও বড় রকমের পাপ হবে না। খেজুরবাগানে ঢুকেছি, এইবার বেছেবুছে একটা গাছে উঠতে যাব, আর ছোড়দা নিচে পাহারায় থাকবে। এমন সময় দেখি খানিক দূরে সেদিন যে গাছটা ঝড়বৃষ্টির সময় বাজ পড়ে পুড়ে গেছিল, তার তলায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আমিই আগে দেখলাম। ছোড়দা তখন উল্টোদিকে তাকিয়ে ছিল, আমি ওর হাত টেনে ধরলাম, “ছোড়দা, ওদিকে কে ওটা?”

একটি এলোচুলের মেয়ে, ষোড়শী, কৃষ্ণবর্ণা, কোমরে গামছা, উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। দেখেই মনে হল, সে এখানকার কেউ নয়। এই গ্রামের নয়, সম্ভবত এই পৃথিবীরই নয়। ছোড়দা দেখলাম ভয় পেয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। আমি এই সময় একটা ভুল করলাম। ডাকিনীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে নেই। ভয়ে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না এমনিতেও। তবুও আমি জিগ্যেস করে বসলাম, তুমি কে?

সেই ডাকিনীর ঠোঁটে একটা ক্রূর হাসি ফুটে উঠল। কোনও উত্তর না দিয়ে সে আস্তে আস্তে নিচু হল, নিচু হয়ে পরণের গামছাটা দুহাত দিয়ে ধরে তুলতে লাগল, খুব ধীরে ধীরে।


ছোড়দা ধনুষ্টঙ্কার লাগা মানুষের মত দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে পড়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ডাকিনী যেমন করে গামছাটা তুলছে, ছোড়দার শরীর সেইভাবে বেঁকতে বেঁকতে যাচ্ছে।

ডাকিনীর মুখ এখন আর দেখা যায় না। গামছা সে দুহাতে তুলে মাথা পর্যন্ত মেলে ধরেছে, এখন কোমর থেকে তার উর্ধ্বাঙ্গ আবৃত আর নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। আমি সেই প্রথম কোনও মেয়ের যোনি দেখলাম। এদিকে তাকিয়ে দেখি ছোড়দার মুখটা যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে যাচ্ছে, অসহ্য যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মত ছটফট করছে ছোড়দা। আমি এইসময়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম, আমার আর কিছু মনে নেই।


সকালবেলা বাড়ির লোকে আমাদের যখন খুঁজে পায়, তখন আমার ধুম জ্বর, এবং প্রলাপ বকছি। ছোড়দাকে নলছিটি মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই মারা যায়। ডাক্তারের ধারণা, খেজুররস কোনওভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছিল এবং সেই বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। কিন্তু আমরা তো খেজুরগাছে চাপার আগেই ডাকিনীকে দেখেছিলাম।

আমার কথা সেদিন কেউ বিশ্বাস করেনি। আজও কেউ করবে বলে মনে হয় না, কিন্তু তবু বলে রাখলাম। কি দেখেছিলাম, কাকে দেখেছিলাম, কেন দেখেছিলাম, কেন ছোড়দাই মরল আর আমি বেঁচে রইলাম, যা দেখেছিলাম সে দৃশ্যের অর্থ কি, আমি হ্যালুসিনেট করেছিলাম কিনা, করে থাকলে কেনই বা করলাম, এসব নিয়ে ভাবার চেষ্টা আমি আর করিনি। এরকম অদ্ভুত দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে তারপর ভাবাভাবি করা যায় না।


আমি নলছিটি মহকুমা হাইস্কুলে গিয়ে ভরতি হলাম ফিফথ ক্লাসে, ১৯৩৫ সালে। সেটা হয়বতপুর থেকে চারক্রোশ দূরে। নৌকোয় যেতে আসতে রোজ চারঘণ্টা লেগে যেত। এরপর বাবা আমায় বরিশাল টাউনে নিয়ে গেলেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলাম বরিশাল টাউনের বি এম স্কুল থেকে। অশ্বিনী দত্তের নিজের হাতে তৈরি এই ব্রজমোহন স্কুল, বরিশালের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

অশ্বিনী দত্ত ১৯২৩ সালে মারা যান। আগেকার বরিশাল আর নেই। পুরো পূর্ববঙ্গ জুড়েই মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর সংগঠিত আক্রমণ শুরু করেছিল ইংরেজের সক্রিয় মদতে, সে আমার জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। বরিশালে এর আঁচটা খুব বেশি করে লাগছিল। এই অবস্থায় বাবা আমায় ব্রজমোহন কলেজে না পড়িয়ে কলকাতা পাঠাবেন ঠিক করলেন। আমি কলকাতা চলে চলে এলাম দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে।

আমার দিদি দামিনী আমার থেকে দুবছরের বড়। তার বিয়ে হয় ১৯৪০ সালেই। জামাইবাবু অমলকুমার সেনগুপ্ত বরিশালের ঝালোকাঠির ছেলে, কলকাতায় ইম্পেরিয়েল পোর্ট অথরিটির অফিসে চাকরি করতেন। তখনকার দিনে বিবাহের পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায়ই যৌতুক হিসেবে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শালাকে গুঁজে দেওয়া হত, বাবাও তার ছোট ছেলেকে জামাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, বাবাজীবন, কলকাতায় একা থাকবে তোমরা দুজন, ও তোমাদের সঙ্গে যাক, ঘরে আরেকজন মানুষ থাকলে সব দিক দেখতে সুবিধে হবে।



বড়দার অবশ্য মত ছিল না। বড়দা হিতেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, তখন ঢাকা থেকে আই এ পাশ করে ঢাকাতেই একটা সাহেবি অফিসে চাকরি পেয়েছে, পেয়েছে আমাদেরই এক জ্যাঠার সুপারিশে, তিনি ওই অফিসের বড়বাবু। ও আমায় বলছিল আমি যেন ঢাকায় চলে আসি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই।

রমেশ মজুমদার হলেন বড়কর্তা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ভাইস চ্যান্সেলর। আমাদের ফুলপিসির শ্বশুরবাড়ির লোক রে। ওনারা হলেন ফরিদপুর জেলার খাদ্দারপুরের লোক, তোর মনে আছে তো, আমরা সেখানে বৌভাত খেতে গেছিলাম? ফুলপিসির সম্পর্কে খুড়শ্বশুর হলেন রমেশবাবু। উনি এই আমাদের বরিশালের ব্রজমোহন কলেজেই পড়াশোনা করেছিলেন এককালে। আমাদের বৈদ্যদের বড় মুরুব্বি। ঢাকায় চল, ওখানে আই এ আর বি এ পড়ে নে। আর কি সব বাঘা বাঘা বদ্যি প্রফেসর আছে ওখানে জানিস? ল পড়াতেন নরেশ সেনগুপ্ত, পরে অবিশ্যি কলকাতা হাইকোর্টে চলে গেলেন। কিন্তু ল ফ্যাকাল্টিতে জিতেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এখনও আছেন। আরে ওই তো, আমাদের বিনয়জেঠুর ভায়রাভাই। তারপরে বাংলা পড়ান বিখ্যাত কবি আর সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। আমাদের প্রিয়নাথমামাকে মনে আছে তো, আরে ওই যে, বিক্রমপুরে বাড়ি? তাঁরই মামাতো দাদা মোহিতলাল। অঙ্ক পড়ান ভূপতিমোহন সেন, আর এদিকে নতুন ছোকরা প্রফেসরদের মধ্যে ইকোনমক্সের অমিয়কুমার দাশগুপ্ত তো আমাদের নীলাম্বরদার সম্পর্কে মাসতুতো ভাই। বুঝলি?”


আমি চোখ গোল গোল করে সব শুনছিলাম। ওর কথার মানে যা বুঝলাম, তা হল এই যে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বদ্যিতে, এবং সেই বদ্যিদের মধ্যে আবার ভর্তি আমাদের আত্মীয়।


তবে ভাগ্যিস ঢাকায় যাইনি। রমেশবাবু ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। উনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও শেষ হিন্দু ভাইস চ্যান্সেলর।

ঢাকায় যাওয়া হয়নি মূলত বাবার আপত্তিতে। ফজলুল হক সদ্য সদ্য লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ করেছে। ফজলুলকে বাবা ফজলি বলত। আম আর কি। বর্ণচোরা। এই প্রচণ্ড উদার সাজার চেষ্টা করল, আর এই সমস্ত ছদ্মবেশ ঝেড়েঝুড়ে ফেলে হিন্দুদের মেরে ফেলার ডাক দিল। এদিকে বাংলায় তখন ফজলুল হকেরই রাজত্ব চলছে, সে বাংলার প্রধানমন্ত্রী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারই অনুগত আজিজুল হক হয়েছে ভাইসচ্যান্সেলর, হয়েই সেই ব্যক্তি ইসলামিক ইতিহাসে আলাদা করে এম এ দিতে শুরু করেছে।


ব্রিটিশ ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৩৭ সালে। যে অধিকারের জন্য বাংলার হিন্দু এত লড়ল, এত রক্ত ঝরাল, সে ক্ষমতা যখন শেষপর্যন্ত নির্বাচিত আইনসভার এল, তখন বাংলার হিন্দু বাংলার আইনসভাতেই চিরস্থায়ী সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বাঙালির সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল।


সে যাই হোক, ঢাকা শহর বা পূর্ববঙ্গ হিন্দুদের জন্য তেমন নিরাপদ নয় বলে চারুচন্দ্র দাশগুপ্ত মনে করছিলেন। যে কলকাতা খাস ফজলুলের রাজত্ব, যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আজিজুল হক, সে কলকাতাকে কেন নিরাপদ ভাবলেন, সেদিন মোক্তারি বুদ্ধিতে চারুচন্দ্র কি বুঝেছিলেন কে জানে, কিন্তু আমার দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে আমি ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় এলাম। শিয়ালদায় পা দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে আমার প্রথম কলকাতা দেখা।



চার



কলকাতাতে নিয়ম মাফিক সন্ধে হলেই,
পাথর নেমে আসবে বুকে সন্দেহ নেই।

---শ্রীজাত


সেটা ১৯৪০ সাল। এই সময়টা শিক্ষিত বাঙালিরা সবাই কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে আমাদের জাতের লোকজন। একসময় বরিশালের বৈদ্যরা সবাই বিপ্লবী হয়ে যেত, সে নিয়ে সাদাত আলি আখন্দ, ইংরেজ পুলিসের দুঁদে গোয়েন্দা ১৯৩০ সাল নাগাদ ইলিসিয়াম রো'তে বসে বসে যা ভাবতেন, তা নিজের স্মৃতিচারণা, ১৩ নম্বর লর্ড সিনহা রোড-এ লিখেছেন এইভাবে।

"বৈদ্যের ছেলে। গৈলা বরিশাল বাড়ি - সন্ত্রাসবাদীদের ডেন গৈলা। ওর নিজেরই কত আত্মীয়স্বজন দেউলী-বাকসায় রাজবন্দী হয়ে আছে। কিংবা না গিয়ে থাকলেও যাব-যাব করছেন।

আমিই তো বরিশালের ফাইল-ফোল্ডার রাখি। কিছুই অজানা নেই। বরিশালের বৈদ্যগোষ্ঠীর 'কেহ না রহিল আর বংশে দিতে বাতি'। অনুশীলন উনিশ নম্বরের এজেন্টটি সাবাড় করে দিয়েছে বৈদ্যবংশের আবাল-বৃদ্ধ বনিতার বিরুদ্ধে সাবভার্সিভ অ্যাকটিভিটির রং-বেরং-এর খবর দিয়ে। এমনকি চোদ্দ পনের বছরের কিশোর-কিশোরীকেও বাদ দেয়নি। আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে ওদের আর কাউকে সরকারী চাকরি করে খেতে হবে না।"


কিন্তু এইবার চাকা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করেছিল। বরিশালের সবথেকে বড় নেতা, বৈদ্যদের শিরোমণি সতীন সেনের সহযোগী তিনজন তুখোড় বৈদ্য নেতা, হীরালাল দাশগুপ্ত, সুকুমার সেন, নৃপেন সেন – তিনজনেই কমিউনিস্ট হয়ে গেলেন আগের বছর, ১৯৩৯ সালে। হীরাদাকে আমি চিনতাম, বি এম স্কুলের ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আগের বছর। সে শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। হীরালালদার মুখেই প্রথম রুশ বিপ্লবের কাহিনী শুনেছিলাম, সে এমন বলার ভঙ্গি যে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। শুধু আমার একার না, সবার।


কলকাতায় এসে আমরা উঠলাম জামাইবাবুর নতুন ভাড়াবাড়িতে। টালিগঞ্জের কাছে চন্দ্র মণ্ডল লেন। আমি আশুতোষ কলেজে গিয়ে আই এ-তে ভর্তি হলাম। বাড়ি থেকে হাজরা মোড় হেঁটেই যাতায়াত করতাম, মিনিট কুড়ি লাগত।

কলেজে ভর্তি হয়েছি। প্রথম সপ্তাহের কথা, জনাছয়েক বন্ধুর একটা গ্রুপ হয়েছে, প্রথম দিন সবাই সবার একটা করে ডাকনাম জেনে নিয়েছে বা নিজেই দিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দিনে শ্রীহরির কচুরির দোকানে গিয়ে কচুরি খেলাম সবাই মিলে। আমার দেখলাম ডাকনাম হয়েছে দ্বিজে, আর দলে দেখলাম আরও একজন বরিশাইল্যা আছে, পরেশ চাটুয্যে। শুনলাম আই এ ক্লাসে আরও জনা পাঁচেক আছে বরিশালের, পূর্ববঙ্গের বাঙাল তো আরও বেশি। কাজেই আমার বাংলা উচ্চারণ নিয়ে খুব বেশি হাসাহাসি হল না। বাঙাল একসময় বিরল ছিল কলকাতায়, সেসব আগের শতাব্দীর কথা। এই ১৯৪০ সালে বাঙালদের নিয়ে আগেকার মত হাসাহাসি করা মুশকিল। তারপর তৃতীয় দিনের কথা। গ্যালারিতে বসে ইংরেজির ক্লাস করছি। আই এ-র ইংরেজি ক্লাসে দেড়শো স্টুডেন্ট, ক্লাস হয় গ্যালারিতে। প্রফেসর অক্ষয় বাঁড়ুয্যে পড়াচ্ছেন প্যারাডাইস লস্ট। পেছনের আগের সারিতে বসেছি।


পাশ থেকে যতীন ফিসফিস করে বলল, ওই দ্বিজে, আজ নতুন বই এসেছে দুর্গাদাসের, ঠিকাদার, দেখবি নাকি?
না রে ভাই, বাড়িতে বলিনি, দেরি হলে জামাইবাবু ক্ষেপে যাবে।
সে কি রে, টালিগঞ্জে থাকিস, স্টুডিওপাড়ায় বাড়ি, তোর বাড়ির পাশেই তো স্টারদের চাঁদের হাট বসে রোজ, আর সিনেমা দেখলে কিনা তোর জামাইবাবু বকবে?
তুই বরং একদিন শুটিং দেখার ব্যবস্থা কর, যতে, আমার সিনেমার শুটিং দেখার খুব ইচ্ছে।
সে হবেখন। আজ একেবির ক্লাসের পরেই ছুট দিলে এম্পায়ার সিনেমায় আড়াইটের ম্যাটিনি শো ধরা যাবে। টিকিট কাউন্টারে যে বসে সে আমার চেনা লোক। চল, যাওয়া যাক।

এর আগেও সিনেমা দেখেছি, বি এম স্কুলে পড়ার সময়, বরিশালে। কিন্তু সেখানে নতুন ছবি আসত না। বেশিরভাগ সময়েই পুরোনো ছবি আনত। আজ শুনলাম অন্তত কয়েক মাসের পুরোনো না হলে কলকাতা থেকে জেলার দিকে কোনও হিট ছবি ভ্রমণ করে না। আসলে প্রিন্ট খুব কম সংখ্যায় তৈরি হয়। সেগুলোই কলকাতায় ব্যবসা শেষ হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন জেলায় যাবে। সেদিন যতের কাছে প্রচুর জ্ঞানলাভ করলাম। কিন্তু কলকাতায় আসার পরে প্রথমবার সিনেমা দেখা, তাও আবার কলেজের ক্লাস কেটে বন্ধুদের সঙ্গে, এবং সেটাও আবার বই বেরোনোর প্রথম দিনে, প্রিমিয়ারের দিনেই, সে অভিজ্ঞতাটা স্নায়ুতে অনেকটা উত্তেজনা পুরে দিয়েছিল। যতের ভাষায়, সাপ খেলিয়ে দিয়েছিল। দুর্গাদাস নাকি একবার কাকে বলেছিলেন, যে রোলই আমায় দাও, পর্দায় পুরো সাপ খেলিয়ে দেব। এ জানার পর থেকেই দুর্গাদাসের হনুমান ভক্ত যতে কথায় কথায় সেই সাপ খেলিয়ে দেওয়ার মেটাফর লাগায়। একটু আগে ইম্পেরিয়াল মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় উল্টোদিক দিয়ে আসা দুজন চাঁদপানা মেমসাহেবকে দেখেও যতে বলে ফেলল,উফ্‌,একদম সাপ খেলিয়ে দিল তো বুকে।


এম্পায়ারের টিকিট কাউন্টারে যে বসে, সে যতের পাড়াতুতো দাদা। যতে খাস কলকাতার ঘটি, লোয়ার সার্কুলার রোডে ওদের আদ্যিকালের বাড়ি। মারহাট্টা ডিচ বুঁজোনোর পরপরই নাকি যতের ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, মানে উর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ ওখানে এসে প্রথম বাস করেছিলেন। তা পাড়ার দাদা যতেকে বকাঝকা না করে সিনেমা দেখায় মদত দিচ্ছে কেন, সে প্রশ্নটা নিতান্তই বাঙালের মত হয়েছে, সে আমায় দলের ঘটিরা সবাই মিলে বুঝিয়ে দিল। ছোকরা বয়েসে সিনেমা না দেখলে এবং ধোঁয়া না টানলেই সম্ভবত তার পাড়ার লোক উদ্বিগ্ন হয়ে ভাববে, ছোকরার ভেতরের সব কলকব্জা ঠিক আছে তো? ফলে আমরা সোজা ঢুকে পড়লাম যতের সঙ্গে এম্পায়ার হলের মধ্যে বুক ফুলিয়ে। এরপর শুরু হল পর্দায় ডুয়ার্সের পাহাড় আর জঙ্গলের আলো আঁধারি খেলা। ঠিকাদার ছবির সিংহভাগ জুড়েই ডুয়ার্স। যাকে বলে আউটডোর। স্টুডিওর মধ্যে শুটিং হলে সেটা হল ইনডোর, এটা আমি আগে শুনেছি, তবে যতে আবার শুনিয়ে দিল। বাঙালকে গাইড করছে আর কি। আমি তখন ছবিতে মজে গেছি। দলের বাকিরাও। রূপোলি পর্দায় ঝকঝকে ছবি, আমাদের মফস্বলে আসা বেশিরভাগ প্রিন্টের মত লড়ঝড়ে ছেঁড়াফাটা নয়। সেই ছবির উজ্জ্বলতা মোহাচ্ছন্ন করছিল। সেই দিগন্ত, সেই পাহাড়ী নদী, সেই অরণ্য- সবই কেমন আশ্চর্য মায়াময় লাগে। নদীনালার দেশের ছেলে আমি,এর আগে কখনও পাহাড় দেখিনি।

দুর্গাদাসের ছবি অবশ্য দেখেছি এর আগে। চণ্ডীদাস নলছিটিতেই দেখেছি দশ বছর বয়েসে, আর আগের বছর বরিশাল টাউনে দেখেছিলাম বিদ্যাপতি। তো সেগুলো ছিল হিস্টরিক্যাল। কিন্তু এই ছবিতে দুর্গাদাস একদম বর্তমানকালের বাঙালি। সাহেবী মেজাজ, আর উড়নচণ্ডী। মাথায় একটা ক্যাজুয়াল ইউরোপীয় ক্যাপ, অনেকটা ইউরোপ অ্যামেরিকার শ্রমিকরা যেরকম পরে। সেগুলোর চারপাশে কানা থাকে না, সামনেটা একটু ফুলে থাকে। এইরকম টুপির কি নাম হয়, সেটা কিন্তু দেখলাম যতে জানে না। তবে ছবি দেখার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রাভিনেতাদের সম্পর্কে বিশাল জ্ঞানলাভ করলাম। যতে আমার কানে কানে অনেক ব্রিফ করে দিচ্ছিল। অবনী হালদারের চরিত্র করা দুর্গাদাসকে দেখে মনে হচ্ছিল, এ লোকটা অনেকটা আমার মত আর ডুয়ার্সের জঙ্গল অনেকটা কলকাতার জঙ্গলের মত।



ছবি শেষ হল। এবার আমরা ফিরছি। আমার কলকাতাপ্রবাসজীবন পর্দায় ঘটে চলা চলচ্চিত্রের মত রূপোলি হয়ে উঠল। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে মাটিতে আর পা ফেলতে হচ্ছিল না। উড়ে উড়ে চলছিলাম যেন। এই বোধহয় ওড়ার শুরু, বরিশালের বাঙালকে কলকাতা এইবার বখাতে শুরু করবে। একটা অনুভূতি হচ্ছিল। আনন্দের, আমেজের। জ্যোতির্ময় নস্যির নেশা করে। যতীন তার প্রিয় হিরো দুর্গাদাসের চরিত্র অবনীর মতই একটা চুরুট ধরিয়েছিল। আমি জ্যোতির্ময়ের থেকে এক টিপ নস্যি নিয়ে টানলাম। বেশ লাগল। এম্পায়ার থেকে দক্ষিণে হেঁটে যাওয়ার সময়টা কলকাতার সন্ধেবেলাকে রহস্যময় এবং রূপকথাময় মনে হয়, আমরা তখন হেঁটে যাচ্ছি নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে। অশোক বলল, চল, এই লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা ভালো পাব আছে।

আজই প্রথম কলকাতায় সিনেমা দেখলাম, এইবার কলকাতার পানশালায় মদ্যপান? তা বেশ, মন্দ কি! যতে এক পায়ে খাড়া। ও আমাদের কাছে গল্প করল, দুবার দুর্গাদাসকে মুখোমুখি দেখার। একবার রঙমহল থিয়েটার থেকে দুর্গাদাসকে বেরোতে দেখেছে। পুরো হাতিবাগানে নাকি জর্দা, বিদেশী পারফিউম আর দামী স্কচের গন্ধ ম' ' করছিল, দুর্গাদাস যখন স্টুডিবেকার গাড়ি করে চলে গেলেন।

বালিগঞ্জে বাড়ি, জানিস তো? আমি গেছি কয়েকবার, বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি, কাছ থেকে আর একবার দেখা যায় কি না। কিন্তু নাসে কপাল হয়নি। আশ্চয্যি ব্যাপার বাওয়াদুর্গাদাসকে দেখলাম শেষমেশ পা'কপাড়ায়আমার মামাবাড়ির সামনে। ওখানে দুর্গাদাসের এক বন্ধু থাকেসে-ও ফিল্ম লাইনের লোক। মুকুল বোস। জগদীশ বোসের কিরকম আত্মীয় হয়মানে সেই বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট জে সি বোস। তা মুকুল বোস হল টপ সাউন্ড রেকর্ডিস্টবুঝলিনিউ থিয়েটার্সের পুরো সাউন্ডের ব্যাপারটা তো ওই দেখে। টকি যখন প্রথম এলোতখন যে ম্যাডান একদম ঘায়েল হয়ে গেল আর বাঙালির নিউ থিয়েটার্সের হাতে পুরো দাপটটা চলে এলোতার পেছনে ওই শর্মাই। ওই মুকুল বোস। সেদিন দুর্গাদাস গেছে তার সঙ্গে দেখা করতেকিন্তু দেখা করবে কিএত মদ খেয়েছে যে গাড়ি থেকে নামতেই পারছে না। গাড়ির মধ্যে বসে মাতলামি করছে। নিজের চোখে দেখলুম,বললে পেত্যয় যাবি না। এই মনে কর তিন হাত দূর থেকে। দেখি দুর্গাদাস বলছেঅ্যাই কালুয়াকিং জর্জ কো বুলাওএত্তেলা দো কে দুর্গাদাস বাঁড়ুয্যে আয়া হ্যায়। বোলো আভি আকে মেরা জুতা সাফ করে। ম্যায় সাফসুতরা জুতা কে বিনা গভর্নরকে প্যারেড মে নেহি যাউঙ্গা। শেষ পর্যন্ত মুকুল বোসই বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে দুর্গাদাসের গাড়ির মধ্যে বসে পড়লআর সে গাড়ি ভোঁভোঁ ছুটল। গাড়ি তো চলে গেলকিন্তু সে গন্ধটা রয়ে গেলউফ্‌ সে কি গন্ধ। সেরকম প্রাণকাড়া সুবাস আর পাবি নাওটাই দুর্গাদাসের পেটেন্ট। স্কচজর্দাআর বিলিতি সেন্ট এর।

পরের দিন বুজলিআমি তো হাঁ। দেখি আনন্দবাজারের চিত্রসংবাদে ওই পা'কপাড়ায় দুর্গাদাসের গাড়ির মধ্যে মাতলামোর কথা লিখেছে।  সে তো লিখেছেলিখবেইস্টার যা যা করবে সে সবটাইতো খবরই হবেজানা কথা। কিন্তু আমি হাঁ হয়ে গেলাম পড়ে যে সেটা পুরোটাই নাকি অ্যাক্টোদুর্গাদাস ওর নতুন ছবিতে ওরকম একটা পাব্লিক প্লেসে মাতলামো করবেসে ছবির রেকর্ডিস্ট নাকি মুকুল বোসতাই মুকুলের বাড়ির সামনে গিয়েই একটা ডেমো দিয়ে দিল। বোঝএই হল দুর্গাদাস।

পরেশ একটু ভারিক্কি চালে বললওরে ডেমো কয় না। ওরে কয় মনিটর।

যতে একটু চটে গিয়ে বললমনিটর হল শুটিং এর সময় সমস্ত যোগাড়যন্ত্র হয়ে যাওয়ার পরে ক্যামেরা চালু করার আগে পুরো শটটা এক বার করে দেখানো। এখানে কি শুটিং হচ্ছিল রে পার্শে?

পরেশ বেগতিক দেখে চুপ করে গিয়ে রেস্টুরেন্টের ছাতের আলোকসজ্জা অবলোকন করতে লাগল।

আমরা পাব লিন্ডসে নামে একটা বার অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসেছি। আমিপরেশ চাটুয্যেযতীন হালদারঅশোক গুহ,জ্যোতির্ময় বসাকচন্দ্রনাথ রায়চৌধুরি। এদের মধ্যে পরেশ আর যতীন প্রচণ্ড দুর্গাদাস ভক্ত। অশোক আর চন্দ্রনাথ হল প্রমথেশ বড়ুয়ার ফ্যান। দুর্গাদাস একটু পুরোনো দিনের হিরোপার্শে আর যতের সিনেমার টেস্ট কাজেই একটু পুরোনোপন্থী হিসেবে দেখে অশোক (ডাকনাম ঘণ্টাইনসিডেন্টালি এটা নাকি দুর্গাদাসেরও ডাকনামতাই অশোকের ডাকনাম ধরে যতীন বেশি চোটপাট করতে পারে নাআর চন্দ্রনাথ ওরফে চাঁদুযাদের প্রমথেশ-ভক্তি নাকি তুলনায় আধুনিক হিসেবে সাব্যস্ত করছে তাদের। অন্তত ওরা নিজেরা তাই ভাবে।

দুর্গাদাসের অ্যাক্টিং আগেকার দিনের মত। আসল সিনেমা দেখতে হয় প্রমথেশ বড়ুয়ার। আর লোকটা কি ট্যালেন্টেডসিনেমা ডিরেক্ট করেশুধু তো হিরো না। একেবারে রেনেসাঁসের রাজপুত্তুর যাকে বলেআ কমপ্লিট রেনেসাঁস ম্যান। চন্দ্রনাথ ঘোষণা করল।

তালশাঁস বললে তাও বুঝতামএই রেনেসাঁসটা কি র‍্যাযতে চিড়বিড় করে উঠল।


এই আকস্মিক আঘাতে দুই প্রমথেশ অনুরাগী একটু ভেবড়ে গেলআর যতে নতুন উৎসাহে কমেন্টারি দিতে লাগল আবার। দুর্গাদাস কলকাতার পেশাদার মঞ্চে নাটক করছেন কুড়ি বছরের ওপরে। উনিশশো বাইশ সালে প্রথম সিনেমায় নামেন। সাইলেন্ট যুগে। তখন ম্যাডানের একচ্ছত্র দাপট। দুর্গাদাস আর্ট কলেজের ছাত্রকাজ খুঁজছেন। বিরাট ব্যবসা ম্যাডানের সাইলেন্ট ফিল্মেরসারা ভারত জুড়ে মনোপলি। ম্যাডানের ছবিতে ক্যাপশন লেখার কাজ নিলেন দুর্গাদাস।

পাশ থেকে অশোক ফুট কাটলওই শেকসপিয়ার যেরকম থিয়েটারে ঘোড়া সামলানোর কাজ দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন।


যতীন শেকসপিয়ারের সঙ্গে তুলনায় খুশি হবে না ঘোড়া সামলানোর সঙ্গে দুর্গাদাসের ক্যাপশন লেখার তুলনায় রেগে যাবে বুঝতে পারল না। সে একটু হকচকিয়ে গেলএমন সময় চন্দ্রনাথ ঘোষণা করলতবে দুর্গাবাবুর ক্যাপশন আঁকার পাট তো সাইলেন্ট ফিল্মের যুগ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেই চুকেবুকে গেছিলকিন্তু তারপরেও ভদ্রলোক পুরোদমে আর্টের কাজ করে গেছেনশুনেছি আগের বছরেও সেটা একবার করেছেন রঙমহল থিয়েটারেওরই অভিনীত একটা নাটকে। নাটকের সিনসিনারি আঁকেন দুর্গাবাবু।

যতে তড়বড় করে উঠলসে নাটকের কথাই তো বলছিলামনাটকের নাম মাকড়শার জাল। আমি দেখতে গেছলাম তো।

আগের কথার সূত্র ধরে এইবার পরেশ চাটুয্যে বললসেইক্ষেত্রে দুর্গাদাসরে ক্যান রেনেসাঁস ম্যান কওন যাইব না?

এইবার আলোচনাটা খুব ঘোরতর জটিল আকার নিতে যাচ্ছিলএমন সময় ওয়েটার এলো অর্ডার নিতে।

এ ব্যাপারে আমি একেবারেই আনাড়ি। বরিশালে থাকতে বিলিতি মদ খাইনি কখনওতাড়িসিদ্ধিভাঙ এগুলো কালেভদ্রে উৎসবে পার্বণে চেখেছি মাত্র। কাজেই আমি চোখ বন্ধ করে বললামবাকিরা যা নেবেআমিও তাই নেব।

এ ব্যাপারে স্পেশালিস্ট হল অশোক আর যতীন। তারা অর্ডার দিতে লাগল। এমন সময় জ্যোতির্ময় আমার দিকে নস্যিদানিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললতা তুই কিডিডি না পিসি?

মানে?

মানে দুর্গাদাস ব্যানার্জি না প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া?

ওঃবেশতুই কি আগে বল।

আমি যদিও আগে প্রশ্নটা করেছিকাজেই উত্তরটা আমার আগে প্রাপ্যকিন্তু তোকে একটা বাঙাল ডিসকাউন্ট দিলাম। আমি এই দিদি বনাম পিসি দ্বন্দ্বকে বাইরে থেকে দেখাটাই উপভোগ করিএর ভেতরে ঢুকতে চাই না। এদের দুজনের তো বিরাট ফ্যান ফলোইং। এরা দুজন হল কৌরব আর পাণ্ডববঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ,গিরিশ ঘোষ আর অর্ধেন্দু মুস্তফিমোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল, হিটলার আর স্ট্যালিন। এদের পেছনে পেছনে দৌড়ে আমি ফ্যানদের ভিড়ে ঢুকে গুঁতোগুঁতি করতে চাই না। এদের ছবি দেখিকিন্তু কেউই আমার নায়ক নয়। ইন ফ্যাক্ট আমি এই ঝাঁকের কই মেন্টালিটিতেই বিশ্বাস করি না। গড্ডালিকা প্রবাহস্রোতে গা ভাসানোএগুলো জ্যোতি বসাকের জন্য নয়। আমি কয়েকজন নতুন নায়কের ওপরে নজর রাখছি। ছবি বিশ্বাসের নাম শুনেছিস?

অন্নপূর্ণার মন্দির১৯৩৬ সালে বেরিয়েছিল। দেখেছিলাম। খুব নাম করেছিল।

ঠিক। এই ছবি বিশ্বাসের ওপরে একসময় অনেকটা আস্থা ছিল। মনে হয়েছিল এ পারবে ওই দুজনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু তারপর থেকে বেশ কয়েকটা ছবি আর জমাতে পারেনি। এই মুহূর্তে জহর গাঙ্গুলী নতুন হিরোদের মধ্যে সবথেকে বেশি পপুলারকিন্তু আমার ওকে ভালো লাগে নাবড্ড চড়া দাগের অভিনয় করে।  

হুমবুঝলাম। তার মানে তোর কোনও ফেভারিট নেই।

জ্যোতি আরেকটিপ নস্যি নিয়ে বললউঁহু। আছে।


এতক্ষণ বাকিরা সবাই আমাদের কথোপকথন শুনছিল। এইবার ওয়েটার এসে সাজিয়ে গেল দুটো বোতলছটা গ্লাসআর মাটন কিমা।


সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল গ্লাস তুলে নিয়ে চিয়ার্স করতে। আমিও করলামলাইফে প্রথমবার।


আলোচনা এইবার অন্যদিকে ঘুরে গেল। সুভাষ বোস আর ফরওয়ার্ড ব্লকগান্ধী আর কংগ্রেসহিটলার আর জার্মানিকলকাতার ফিলিম থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকে মোড় ঘুরে গেল।


আমি ফিসফিস করে জিগ্যেস করলামভালো কথাজ্যোতিতোর ফেভারিটের নাম তো জানালি না?

জ্যোতি চোখ সরু সরু করে বললআমার নামেই নাম। জ্যোতি। জ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্য। ডাক্তার। বইটা দেখেছিলিএই ক'মাস আগে রিলিজ করেছিল। উনিশশো চল্লিশে এখনও পর্যন্ত সবথেকে হিট বাংলা ছবি। ডাক্তারের ঠিক আগে পরাজয় নামে ছবিতে কানন দেবীর সঙ্গে একটা ছোট রোল করেছিলসেটাই প্রথম অ্যাপিয়ারেন্স। তুই বোধহয় তখনও বরিশাল থেকে কলকাতায় আসিস নি। নাঃসেসব দেখিস নিভালই করেছিস। জ্যোতিপ্রকাশের অভিনয় দেখলে বুকে অনেকটা পাথর জমাট হয়ে আসেজানিস?


পাঁচ



হলুদ দু ঠ্যাং তুলে নেচে রোগা শালিখের মতো যেন কথা
বলে চলে তবুও জীবনঃ
বয়স তোমার কতচল্লিশ বছর হলো?
--- জীবনানন্দ দাশ




রাতের দিগন্তআমি এই গাঙ্গেয় সভ্যতার আসমুদ্রজীবনের এক আঁজলা রোজনামচা লিখে রাখছিআমায় সহায়তা কর। এইসমস্ত নদীতীরে তোমার প্রাচীন চর্যাস্মৃতি লেখা আছেআমি তা তুলে আনতে চাইছিআমায় সে পলিমাটি খুঁড়তে সহায়তা কর। এইসমস্ত অন্ধকারে তাম্রলিপ্ত থেকে সপ্তগ্রাম তোমার পদচিহ্ন ধরে রাখেআমি সেই পদচিহ্নের রেশ ধরে নতুন পথের সন্ধান করতে এসেছিআমার সঙ্গে থাকো রাতের দিগন্ত। তোমার সমুদ্রপোত ছেড়ে গেলে তোমার রমণীর কণ্ঠে বাষ্প জমেআমি সেই সমস্ত অভিমানবাষ্পের মানচিত্র এঁকে দিতে এসেছি রাতের দিগন্তএজন্য আমায় কোনও পারিশ্রমিক দিতে হবে না। যখন বাণিজ্যশেষে বণিকরা ফিরে আসেতাদের দর্শনমাত্রে যে উল্লাস জাগে ঘরের মানুষদের মনেআমি সেই আনন্দের কণামাত্র ভাগ পেলে ধন্য হইরাতের দিগন্ত। তোমার দক্ষিণের মোহনাদের বড় প্রিয় সেইসব ফিরে আসা জাহাজের প্রথম দেখতে পাওয়া মাস্তুলের নামে জয়ধ্বনি হোক রাতের দিগন্তআমি কিছু দিকনির্দেশ ভিক্ষা করতে এসেছি আজ তোমার কাছে। তোমার আগের শতাব্দীর গর্জনশীল চল্লিশার সমুদ্রযাপন লিখে রাখছি আমিসে শতাব্দী যখন চল্লিশতম বছরে পড়েছিলসেইসব দিনকালের আগুনশিখা এনে আমার মাথায় ছুঁইয়ে দাওআমার মাথায় তোমার অগ্নিভ হাত রাখোরাতের দিগন্ত। আমি তোমার আবাহন করলাম।


প্রথমে জানাও তোমার নায়কদের কথা। তোমার পদাতিকদের কথা জানাও। তোমার সন্তানদের কথা জানাওতোমার পিতা ও মাতাদের কথা জানাও। তোমার ক্ষতের কথা জানাওতোমার রক্তক্ষরণের কালপঞ্জী জানাও। জানাও কারা আততায়ী ছিলকাদের কাদের জন্য তোমার পাড় ধ্বসে গেল কীর্তিনাশার ভাঙনে।


যেসময় গঙ্গাবক্ষে রাত হলে পূর্বে ও পশ্চিমে পরিষ্কার ঝকঝকে আলোকরেখাময় দিগন্ত এবং মাথার ওপরে অগুন্তি নক্ষত্রখচিত আকাশ দেখা যায়সেইরকম ঋতু এসেছে এখন কলকাতায়। এ সময়টা উনিশশো একচল্লিশ সালশরতকাল এসে গেছে। হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের পরে দুবছর অতিক্রান্ত। দ্বিজেন কলকাতায় আসার পরেও এক বছর হয়ে গেছে। সুভাষ বসুর মহানিষ্ক্রমণ ঘটে গেছেবাংলার মসনদে এখন শ্যামাপ্রসাদ এবং ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা। দুজনেই ইংরেজের প্রতি আজীবন অনুগতএবং একে অপরের স্নেহভাজন। ফজলুলকে আইনব্যবসায় জায়গা করে দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদের বাবা আশুতোষফজলুল ছিলেন আশুতোষের জুনিয়র। সেহিসেবে শ্যামা আর হক দুজনে একে অপরের গুরুভ্রাতা।


এ তো রাজনীতির জুটি। চলচ্চিত্রে এরকম একটা জুটি ছিল দুর্গাদাস আর বীরেন্দ্রনাথ সরকারের। যদিও সেটা ভেঙে গেছিল একটা নীতির প্রশ্নে এইসময়। দুর্গাদাসের জন্য স্বার্থের থেকে নীতি বড় ছিল।


দুর্গাদাসের সঙ্গে নিউ থিয়েটার্সের মালিক বীরেন্দ্রনাথ সরকারের এক প্রচণ্ড মতভেদ হয় ত্রিশের দশকের শেষের দিকেএবং দুর্গাদাস ছেড়ে আসেন নিউ থিয়েটার্স। ঝগড়ার বিষয় ছিল বাংলা ও বাঙালির প্রাধান্য নিয়েই। বি এন সরকার এইসময় ডাবল ভার্শন ছবি করার সময় হিন্দি ও উর্দুভাষী আর্টিস্ট এনে কলকাতায় কাজ করছেন। কলকাতার বাইরে উত্তর ভারতে নিউ থিয়েটার্সের একটি পাকাপাকি স্টুডিও করার কথা হচ্ছে। একজন অবাঙালি পরামর্শদাতা এইসব মন্ত্রণা যোগাচ্ছেন বি এন সরকারকে। দুর্গাদাস এই প্রস্তাবের প্রচণ্ড বিরোধী। ভারতের চলচ্চিত্রশিল্পের ভরকেন্দ্র কলকাতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র আছেদুর্গাদাস জানেন। নিউ থিয়েটার্সকে যখন আটকানো যায়নিতখন প্রয়াস হয়েছে বাঙালি নিয়ন্ত্রিত এই প্রতিষ্ঠানটিকেই বাঙালির স্বার্থের বিরুদ্ধে নামানো যায় কি না। দুর্গাদাস সে প্রয়াসের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেনলেখালেখি করেছেন। শেষপর্যন্ত জিতেছেনওসে কাহিনী আমি জানাব। কিন্তু বাঙালির জন্য যুদ্ধ তো অন্তহীনবিরামহীন। এ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতি নেই। সকালের যুদ্ধজয় সন্ধ্যাবেলায় অর্থহীন হয়ে যেতে পারে।


এদিকে বাঙালির ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বসিয়ে দিতে ইংরেজ সরকারও তলে তলে কলকাঠি নাড়ছে। কলকাতায় আগে জার্মানি আর জাপান থেকে প্রচুর র ফিল্মের স্টক আসত। ইংরেজ সরকার সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ বিকল্প ব্যবস্থা কিছু করেনিযেটা বম্বেতে করেছেসেখানে অ্যামেরিকা থেকে ফ্রেশ র ফিল্ম আসছেফলে স্টক নিয়ে তাদের সেভাবে সঙ্কট হয়নি।


আসলে ইংরেজের ধারণা একদল বাঙালি ওই জার্মানি আর জাপান থেকে র ফিল্ম আমদানি করার ছুতোয় তলে তলে ইংরেজবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তার ওপরে জার্মানি-জাপান শত্রু দেশতার ওপরে সুভাষ বোসকে তারা মদত দিচ্ছে। এদিকে এতবড় একটা বিশ্বযুদ্ধ। কাজেই সেই র ফিল্ম আমদানি বন্ধ করার নির্দেশজারি ইংরেজ সরকার অতি উৎসাহের সঙ্গেই করে বসেছে।


ইংরেজ তার দূরদর্শী যুদ্ধোদ্যমে কি কি করে বসছেসে এক আশ্চর্য সম্ভাবনার জগত। কদিন আগে ভাইসরয় লর্ড লিনথিগগো বাংলার গভর্নর স্যার জন আর্থার হার্বার্ট কে ডেকে বললেনস্যার জনবাংলায় প্রচুর নৌকো।


হ্যাঁতা তো আছেনৌকো প্রচুর।

এই নৌকো সব জাপানিদের হাতে পড়লে কি হবে জানেন?

কি হবে বলুন তোখুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবেসে তো বুঝতেই পাচ্ছি।

আরে মহা ধড়িবাজ জাত এই জাপানিগুলো। আর গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মত এই বাঙালিগুলো তো আছেই। যদি সব নৌকোগুলোতে জাপানি টেকনিকে মোটর বসিয়ে দেয়ওই নৌকো চেপেই ব্যাটারা পুরো গঙ্গা যমুনা দোয়াব দখল করে ফেলবে। বুঝেছেনএ হল জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন।

হুমচিন্তার ব্যাপার। মানতেই হবে।

এক কাজ করুন। সব নৌকোগুলো ধরে ধরে বাজেয়াপ্ত করে ফেলুন।

অ্যাঁ?

আরে সব নৌকো ফরফিট করুনসিজ করে দিন।
কিন্তু পূর্ববঙ্গে প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম নৌকোওদের চাল ডাল তেল নুন সবই নৌকো করে পৌঁছয়। নৌকো বন্ধ করে দিলে তো ডেডলক হয়ে যাবে। বেঙ্গলে ফ্যামাইন হওয়াও আশ্চর্য নয়।

হয়ে যাক গে।


এরকম আলোচনা যখন হচ্ছে বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে সরকারের উচ্চতম মহলেওদিকে তখন বাঙালির ফিল্ম কম্পানি নিউ থিয়েটার্স দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যবসা করে সারা ভারতে বাঙালির একটা দাপট স্থাপন করে ফেলেছে। বাঙালি লেখকদের গল্প থেকে সিনেমা বানিয়েবাঙালি আর্টিস্টদের নিয়েবাঙালি কলাকুশলীবাঙালি ডিরেক্টর নিয়েবাঙালি প্রোডিউসারের এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পেছনে দুর্গাদাসের বলিষ্ঠ বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা ভূমিকা ছিল। সে কাহিনী আজ বিস্মৃতপ্রায়।


বি এন সরকার ছিলেন নিপাট ভদ্রলোকবম্বের এবং লাহোরের প্রোডিউসারদের ছবিও নিজের সিনেমা হল চেইনে এক্সহিবিট করতে দিতেন। সে তার ছবিকে এরা বম্বের আর লাহোরের মার্কেটে জায়গা দিক আর না দিক। সরকারমশাই আর পাঁচটা শিক্ষিত বাঙালির মত স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি সুভাষ বসুর অনুগামীও বটেন। বি এন সরকারের চলচ্চিত্র ব্যবসার শুরু হয়েছিল চিত্রা সিনেমা হল দিয়েনিউ থিয়েটার্স তখনও শুরু হয় নি। হাতিবাগানে চিত্রা থিয়েটার ২০শে ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে উদবোধন করেন কলকাতার তদানীন্তন মেয়রসুভাষ বসু। এটি বীরেন্দ্রনাথ সরকারের নিজের মালিকানায় প্রথম প্রেক্ষাগৃহ। প্রথম যে ছবিটা দেখিয়ে নিউ থিয়েটার্সের যাত্রা শুরু হয়তা ছিল রাধা ফিল্ম কম্পানির নির্বাক ছবি শ্রীকান্ত। এরপরে মাড়োয়াড়ি নিয়ন্ত্রিত বেশিরভাগ স্টুডিওর ছবির মত বম্বের অনুকরণ না করে বাঙালির রুচি অনুযায়ী ছবি বানানোর উদ্দেশ্যেই নিউ থিয়েটার্স তৈরিএবং এর পেছনে সুভাষ বসুর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল।


সেই নিউ থিয়েটার্স কিভাবে নিজের বাঙালি উৎস এবং এজেন্ডা থেকে সরে যেতে পারেশুধু তো একজন অবাঙালির পরামর্শে এমন বৃহৎ দিকপরিবর্তন হয় না। বেশ কয়েকগুলো বাঙালি খয়ের খাঁও ছিল এর মধ্যেতারাও বি এন সরকারকে এইসময় উস্কাচ্ছিল। এমনই একজন ব্যক্তি ধরা যাক এসপ্ল্যানেডের পিকাডিলি সিনেমা হলের ম্যানেজার শ্যামল সরকার। এই হলে বি এন সরকারের বেশিরভাগ শেয়ার এখনকিন্তু আদি মালিক ছিল এক পারসিসে এখনও এর ছ'আনা মালিক। এই হলে বাংলা ছবি চলে নাহিন্দি-উর্দু ছবিই আনা হয়।


সবথেকে ভালো ব্যবসা দেয় লাহোর আর বম্বের ছবিকারণ ওই আর্টিস্টদের একটা ক্ষমতা আছে সারা ভারতের ভারতীয়দের পালস বোঝার। ওই কাজ কলকাতার ডিরেক্টর আর আর্টিস্ট দিয়ে হয় না। গোলকচাঁদ কাপুর তো ভুল কিছু সাজেশন দেয়নি। এখন লাহোরে একটা স্টুডিও খুলতেই হবে আমাদের। বাঙালিদের দিয়ে আর হবে নাএদের ওপরে ভর দিয়ে নিউ থিয়েটার্স ব্যবসা বেশি বাড়াতে পারবে না। ব্যবসা বাড়ানোর কাজে এইসব বাঙালি সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে থাকলে চলে না। লাহোরের ওরা হিন্দিটা বলতে পারে। বাঙালিকে দিয়ে হিন্দি বলানোর মানে হচ্ছে হ্যান্ডিক্যাপ নিয়ে ঘোড়দৌড় শুরু করা।


দুর্গাদাস বসে বসে সব শুনছিলেন। আলোচনাটা হচ্ছিল পার্ক স্ট্রিটের ইম্পেরিয়েল রেস্টুরেন্টে বসে। সময়টা ছিল ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি। এখানে বসে দুর্গাদাস অনেক ফিল্মের মিটিং করেছেন এর আগেও। আজকের মিটিং এ বি এন সরকার ছাড়াও নিউ থিয়েটার্সের বেশ কয়েকজন কর্তাব্যক্তি আছেন।


হিন্দি ভাষাটা একটা খিচুরিকোন উপাদানটা বেশি ঢালা হবেতা নিয়ে কোনও ঐক্যমত্য নেই। পাঞ্জাবি অভিনেতার উচ্চারণও তো হ্যান্ডিক্যাপ হতে পারে। ওদের তো রীতিমত ইরিটেবল ভাওয়েল সিন্ড্রোম আছে বলা যায়। স্বরবর্ণগুলো উচ্চারণই করতে জানে না। আবার পাঞ্জাবি যেভাবে হিন্দি বলেসেভাবে তো বিহারি মোটেই বলে না। তাই বাঙালির উচ্চারণ কোনও হ্যান্ডিক্যাপ না। হিন্দি ভাষাটা কোনও একভাবে বলা হয় নাপ্রত্যেক প্রদেশে নিজের মত করে একটা বলার ধরণ আছেএকসময় যেমন সংস্কৃতের রকমফের  হত স্থানভেদে। হিন্দি একটা যোগসূত্র রক্ষার ভাষাএই ভাষা বলার ক্ষেত্রে এই বাঙালি সংকোচের অর্থ হয় না। বাঙালি সামান্য প্রশিক্ষণ নিলেই চমৎকার হিন্দি বলছে। কিন্তু সেও বাহ্য। আসল কথা তো ভাষা না। টকি আর কদিন এসেছে। আমরা তো অভিনেতা। বাঙালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করতে পারে কেবাকিরা তো যা পার্ট দাও স্রেফ দুর্যোধনের উরুভঙ্গ আর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেই সেরে ফেলতে চায়। চড়া দাগের বাহ্যস্ফোট ও আস্ফালনের হুহুঙ্কারঠিক যেন যাত্রার ভীম। ক্যামেরার সামনে ওরা যা করে দেখে মনে হয় রামলীলের সঙ্গে ক্যামেরার ভাষার ফারাকই এখনও শেখেনি।


শ্যামল সরকার একটু অবজ্ঞার হাসি হেসে বললআজ কি সকাল থেকেই মদ্যপান শুরু করেছেন মিস্টার ব্যানার্জিনাকি আপনি সর্বভারতীয় সিনে স্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আপনার সাউথ কলকাতার অ্যাকসেন্ট দিয়েবক্স অফিস আমি বুঝিআপনি বোঝেন না। সিনেমার এইসব সূক্ষ্ম ও সৌখিন চারুশিল্প দিয়ে ব্যবসা চলে না। ব্যবসা আমি বুঝিআপনি বোঝেন না। এখানে এইসব বাঙালি সেন্টিমেন্ট ফলাতে গেলে নিউ থিয়েটার্স মারা পড়বে।


দুর্গাদাসের মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। এই অদূরদর্শী লোকগুলোই ছড়ি ঘোরাবেএই নির্বোধ ও লোভী লোকগুলোই শেষ কথা বলবেএরা তো ব্যবসার প্রয়োজনে নিজের স্ত্রীপুত্রকেও বেচে দিতে পারে। আসলে অবাঙালি ইন্টারেস্টের দালালনিউ থিয়েটার্সকে ভেতর থেকে ডিরেইল করতে চাইছেবাঙালিকে ছেঁটে ফেলতে চাইছে বাঙালির নিজের হাতে গড়া কম্পানি থেকে। নিজেকে বলছে সঙ্কীর্ণতাবিরোধীবলছে উদারপন্থী। আসলে ঘুণপোকা। এই পরগাছাটা কোথায় ছিলযখন বাংলা ও বাঙালির কবিকে নিয়ে তৈরি বাংলা ভাষার ছবি চণ্ডীদাসের ডায়ামন্ড জুবিলি দিয়ে নিউ থিয়েটার্সের সর্বভারতীয় উত্থান ত্রিশের দশকের শুরুতে?


দুর্গাদাস এই লোকটিকে উচিত শিক্ষা দেবেন বলে মনস্থির করলেন।


পরের দিন কাগজে দুটো খবর হল। একপ্রকাশ্য দিবালোকে পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রতারকার গুণ্ডামি। পিকাডিলি হলের ম্যানেজার শ্যামল সরকারকে মেরে তার নাক ভেঙে দিয়েছেন প্রবাদপ্রতিম ফিল্মস্টার দুর্গাদাস ব্যানার্জি। শ্যামলবাবু বর্তমানে প্রেসিডেন্সি জেনারেল হসপিটালে চিকিৎসাধীনসংজ্ঞা ফিরেছেকিন্তু কোনও প্রশ্ন করলে আনুনাসিকভাবে যা বলছেনসেটার মর্মোদ্ধার করতে পারেননি আমাদের চিত্রসাংবাদিক বামন দে। আর দুর্গাদাসের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
দুইবাজারে জোর গুজবনিউ থিয়েটার্স ছেড়ে দিচ্ছেন দুর্গাদাস।


কদিনের মধ্যেই গুজবটা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে দেন দুর্গাদাস।


নিয়তির পরিহাসবি এন সরকারের সঙ্গে ঝগড়া করে বাঙালি নিয়ন্ত্রিত নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে দিয়ে অবাঙালির মালিকানায় চলা ভারতলক্ষ্মী পিকচার্স জয়েন করতে হয় দুর্গাদাসকেআর কোনও স্টুডিওর সেসসময় তাঁর মাপের চিত্রতারকাকে নিয়ে কাজ করার সাধ্য ছিল না। তবে এই চোখানি নামক ব্যবসায়ীর কোনও একচোখোমি ছিল নাসে বাঙালিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিত। ভারতলক্ষ্মীর ব্যানারে একের পর এক ছবি করেন এইসময় দুর্গাদাস।


বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের এই টালমাটাল সময়ে সুভাষ বসুর নির্দেশেসুভাষ বসুর পরামর্শে কালীশ মুখোপাধ্যায় রূপ মঞ্চ নামক চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯৩৯ সালে। সুভাষ এ সংক্রান্ত নির্দেশটি প্রথম কালীশকে দেন আরও বছর দুয়েক আগে।


১৯৪১ সালের উনিশে জানুয়ারি সুভাষ কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার আগে সমস্ত অনুগামীর প্রতিই একটা বার্তা রেখে গেছিলেন। একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান। যখন সেই স্বাধীনতার পরমমুহূর্ত আসবেতখন যেন তার উপযুক্ত হতে পারেন সেই যোদ্ধারা।


এইসময় দুর্গাদাসের সঙ্গে বি এন সরকারের ঝগড়া মেটাতে মধ্যস্থতায় বসেন কালীশ। এই মিটিং এর কথা কোনও ইতিহাস বইতে পাবেন না কেউ। কিন্তু উনিশশো চল্লিশ থেকে একচল্লিশের মধ্যে এই দৃষ্টিগ্রাহ্য বার্তা এসেছিলযে দুর্গাদাসের সমস্ত দাবি মেনে নিয়েছেন বি এন সরকার। ১৯৪০এর বাংলা সুপারহিট ছবি ডাক্তার হিন্দিতে রিমেক করার সময় প্রত্যেক বাঙালি শিল্পীকেই রিপিট করালেন বি এন সরকারকোনও অবাঙালি শিল্পীকে আনেন নি।


ইতিহাস বলছে১৯৪০ সালে বাংলা চলচ্চিত্র ডাক্তার মুক্তি পায়। ১৯৪১ সালে এর হিন্দি ভার্শনের শুটিং শুরু হয়। বাংলা ছবিটির পরিচালক ফণী মজুমদার অন্যত্র ব্যস্ততাই সুবোধ মিত্র পরিচালনা করেন ডাক্তারের হিন্দি চিত্ররূপ। বাংলাটির মত এতেও অভিনয়ে পঙ্কজ মল্লিকজ্যোতিপ্রকাশঅহীন্দ্র চৌধুরী। ১৯৪১ এর ডিসেম্বর মাসে ডাক্তার মুক্তি পায়।


আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হলনিউ থিয়েটার্সের মালিকানায় চলা চিত্রা সিনেমা হল সেসময় উৎসবের দিনকালে সারারাতব্যাপী যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতসেখানেও ঠিক এই সময় একটা পরিবর্তন আসে।


ইতিহাস বলছে২৪শে অগাস্ট ১৯৪০ জন্মাষ্টমীসারারাত চিত্রায় দুলারী বিবিজীবন মরণপরাজয় ও মীরাবাঈ দেখানো হয়। লক্ষণীয়দুটো বাংলা ছবিদুটো হিন্দি ছবি।


এরপর ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ শিবরাত্রিসারারাত চিত্রায় পরাজয়জীবন মরণচণ্ডীদাস দেখানো হয়।


১৪ই অগাস্ট ১৯৪১ জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে চিত্রায় মুক্তিডাক্তারজীবনমরণমাসতুতো ভাই।


একচল্লিশের শিবরাত্রি আর জন্মাষ্টমীদুদিনই সারারাত ধরে শুধু বাংলা ছবি দেখালো চিত্রা। অর্থাৎ একটা পলিসি চেঞ্জ যে হয়েছিলতাতে সন্দেহ নেই। এবং এই পলিসি চেঞ্জের ফলে চিত্রার কোনওরকম লোকসান হয়েছিল বলেও কোনও সংবাদ নেই।


ইতিহাস অবশ্য জানাচ্ছে নাদুর্গাদাস আর বি এন সরকারের পুনর্মিলনের খবর শ্রবণ করে শ্যামল সরকারের নাকে কোনও টনটনে ব্যথা নতুন করে চাগিয়ে উঠেছিল কি না। জানানোর কথাও না। শ্যামল সরকার এবং পিকাডিলি এই উপন্যাসের প্রয়োজনে বানিয়ে নেওয়া নাম। যে হল ম্যানেজার অবাঙালিদের হয়ে তরফদারি করেবাঙালিকে বদনাম করে দুর্গাদাসের হাতে মার খেয়েছিলেনতার নাম বা তার হলের নাম আমাদের ইতিহাস জানায়নিশুধু দুর্গাদাসের নিখাদ বাঙালি ঝাড়ের উল্লেখ এবং সেই খয়ের খাঁ হল ম্যানেজারের উল্লেখ আমরা ইতিহাসে পাচ্ছি। ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতা আছেহাড়ের গায়ে রক্তমাংস জোড়ার। দুর্গাদাস এইসময় বাঙালি শিল্পী-কলাকুশলী-চিত্রপরিচালকদের নিয়ে সর্বভারতীয় ছবি করার পক্ষে যুক্তিগুলি সাজিয়ে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন কোনও এক পত্রিকায়দুঃখের বিষয়সে প্রবন্ধটি হারিয়ে গেছেশুধু তার উল্লেখ পাই আমরা দুর্গাদাসের জীবনীতে।


যার কোনও উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় নাকালীশ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় সেই গোপন মিটিং দুর্গাদাস এবং বি এন সরকারের মধ্যেযার কথা আগেই বলেছিসেখানে দুর্গাদাসের সমস্ত বক্তব্য মেনে নিয়েছিলেন বি এন সরকার। তিনি বাংলা ও বাঙালির অগ্রাধিকারের পলিসিতে ফিরেছিলেন। এইসময় নিউ থিয়েটার্সের আরেকটি ছবি হল প্রতিশ্রুতিএর হিন্দি ভার্শন সৌগন্ধদুটিরই পরিচালক হেমচন্দ্র চন্দ্র। চন্দ্রাবতী ছাড়া বাংলা সংস্করণের সবাই হিন্দিতে অভিনয় করেন। চন্দ্রাবতীর ডেট মেলেনিনইলে তিনিও হিন্দি ভার্শনটিতে থাকতেন।


ইতিহাস আরেকটা জিনিস জানাচ্ছে আমাদের। সুভাষের মহানিষ্ক্রমণের পরে দুর্গাদাস তার ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেনএইবার একটা খুব বড় ওলট পালট আসতে চলেছে।


ইতিহাস কি আর সব জানেঅগ্নিযুগে কঠোরতম গোপনীয়তা রক্ষা করা হত প্রত্যেক স্তরেমন্ত্রগুপ্তির জোরে টিকে ছিল বাংলার বিপ্লব-প্রয়াসের গোপন যাত্রাপথ। কে কোথায় জড়িত ছিলেনতার কোনও নথি নেই। পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার বিপ্লবীরাকাজেই ভবিষ্যৎ সেই ইতিহাসের সম্পূর্ণ দলিল রচনায় অক্ষম ছিলকারণ ভবিষ্যৎ তখন কুক্ষিগত নানা রঙের প্রতিবিপ্লবীদের হাতে, তারা কেউ হিন্দুত্ববাদীকেউ কংগ্রেসীকেউ কমিউনিস্ট। বিপ্লবীরা এবং তাদের সহযোগীদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে ছিলেনসঙ্গত কারণেই তাঁরা নিজেদের কাহিনী লিপিবদ্ধ করতেনথিভুক্ত করতে এগিয়ে আসেননি। কোনও বিকল্প ইতিহাস লেখা যায়নিযেখানে দুর্গাদাস ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে গোপন অংশীদারযেখানে দুর্গাদাস ভারতে বাঙালির সক্রিয় আধিপত্য কামনা করেছিলেনসিনেমার বাইরেও।


কিন্তু বাঙালি সম্ভবত অভিশপ্ত। এ জাতির মাথার ওপরে কোনও প্রাচীন অভিশাপ আছে। এত সহজে তার কালরাত্রির অন্ধকার শেষ হয় না। এবং এ জাতির শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধারা বারবার আহত হনক্ষতবিক্ষত হনআমাদের সূর্য ও চন্দ্র বারবার রাহুগ্রস্ত হয়আমাদের আলোকোজ্জ্বল দিন বারবার অস্তাচলে ঢলে পড়ে।


ছয়


O, talk not to me of a name great in story
The days of our youth are the days of our glory.

--- Lord Byron



ওয়েলিংটন এলাকায় পুরোনো ঘিঞ্জি মেসবাড়িতে তখন রাত নেমে এসেছে। কলকাতা শহরের রাত। ভৌতিক বাল্বের আলোয় খোক্কসের পিঠের মত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে চিলেকোঠার ঘরআর সে ঘরের মেঝেয় কড়িকাঠের ছায়া। তখন সেই আন্‌তাবড়ি অবয়বকে বন্ধু বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে হয়আর ঘাম শুকিয়ে যাওয়া রাত্রির সংকেত বুঝে নেয় পরিশ্রান্ত দিন। সেরকম ক্লান্তির সময় এখন। নিদ্রামগ্ন রাত নেমেছে এই শহরের ওপরে। সে রাতের একদিকে ইতিহাসের ঘুমজড়ানো চোখে জমে থাকা প্রচুর স্বপ্নআর তার অন্যদিকে নিস্তব্ধ হয়ে আছে কলকাতা।


দ্বিজেন দাশগুপ্ততুমি বলো আজ তোমার কথা। আমি সামান্য লেখকআজ সারাদিন শহরের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে চলা তোমার দুপায়ে লেগে থাকা ধূলিকণাদের শব্দ শুনতে এসেছি। আমি এই সমস্ত ইমারতে লেগে থাকা সময়ের ছাপ গুনতে এসেছিঠাকুরদা।


দ্বিজেন এখন এই মেসবাড়িতে থাকে। তার জামাইবাবু ১৯৪১-এর শুরুতেই আচমকা কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চলে গেছে ওয়ালটেয়ার। দিদি অবশ্য যায় নিতখন সে সন্তানসম্ভবা ছিল। দিদির একটি মেয়ে হয়েছে এ বছর ফেব্রুয়ারিতেবরিশালের বাড়িতেই। মা ও মেয়ে দুজনেই বেশ ভাল আছে। দ্বিজেন জামাইবাবুর সঙ্গে ওয়ালটেয়ারে গিয়ে সেখানকার কলেজে ভর্তি হতে পারতকিন্তু একে তো দিদি সেখানে নেইউপরন্তু কলকাতা শহরটা সে ছাড়তে চায়নি। কলকাতাকে ভালোবেসে ফেললে কোনও রূপকথার জাদুকরীর হাতে বন্দী হওয়ার মত অবস্থা হয়। তখন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও গেলেও নিস্তার নেইপ্রাণভোমরা সেই ডাকিনীর হাতেই বন্দী হয়ে আছে।


সকালের খবরের কাগজ খুলে দেখার সময় পায় না দ্বিজেনতাছাড়া নিজে কাগজ কেনার পয়সাও তার নেই। সকালে উঠেই সে কোনওরকমে চোখেমুখে জল দিয়ে বাথরুমের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে টিউশন পড়াতেদুটো বাড়িতে পড়িয়ে তারপরে যায় কলেজে। এরপর কলেজ থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যাবেলা আরও দুটো টিউশন। এই চারটে টিউশন করে তার কলকাতার খরচাপাতি সে মোটামুটি তুলে নিতে পারে। বাড়ি থেকে বাবা মাসে দশটাকা মানি অর্ডার করে পাঠায়তার বেশি পাঠানো এখন সম্ভব নয়মোক্তারির ব্যবসায় পশার আর আগের মত নেইএখন জেলা কোর্টেও বিলেত ফেরত উকিল-ব্যারিস্টারদের ভিড় বাড়ছে। তারপরে বন্ধুদের কারও সঙ্গে কিছুক্ষণ গুলতানিআটটার নাইট শোতে সিনেমা দেখা বা ভবানীপুরের একটা চায়ের দোকানে তাদের যে আড্ডাটা বসেসেখানে হাজিরা দেওয়া। এরপর প্রায় মাঝরাত নাগাদ মেসবাড়ি ফিরে এসে সেদিনের খবরের কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে। এই হল সপ্তাহের পাঁচদিনের রুটিন তার। আজও দেখছিল। বিশ্বযুদ্ধের খবর রয়েছে অনেকটা। দুর্গাদাসের নতুন ছবিঅবতারপ্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ডিরেকশনসে ছবি গোল্ডেন জুবিলি করেছেবড় বড় করে তার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। দুর্গাদাসের জনপ্রিয় নাটকপি ডব্লিউ ডিতার একশোতম রজনী আজ অভিনীত হবে নাট্যভারতী মঞ্চেতারও বিজ্ঞাপন। এ দুটোই এর মধ্যে তার দেখা হয়ে গেছে তার বন্ধুদের সঙ্গে। ওদের দলেও এর মধ্যে নতুন কয়েকজন জুড়েছে। পুরোনো দুজন আর নেই। পরেশ চাটুয্যে সরকারি আপিসে কেরানীর চাকরি পেয়ে গেছেমুরুব্বির জোরেসে এখন চাকরি করছে। জ্যোতির্ময় বসাকের বাবা মারা গেছেফলে তাদের পারিবারিক ব্যবসা এখন তাকেই দেখাশুনো করতে হয়। এরা দুজনেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছেজ্যোতির্ময়ের অবশ্য সামনের বছর প্রাইভেটে আই এ পরীক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা।


খবরের কাগজ পড়তে পড়তে একজায়গায় দ্বিজেন বিজ্ঞাপন দেখলকলকাতা পুলিসে এ এস আই নেওয়া হচ্ছে। মোট পঞ্চাশটা শূন্যপদ। যুদ্ধের সময়তাই স্পেশাল রিক্রুটমেন্ট ড্রাইভ হচ্ছে। পোস্টিং কলকাতায়আর্মির সহায়ক হিসেবে কাজে লাগানো হবে আপাতত। যোগ্যতা ম্যাট্রিকুলেশন।


আচমকা দ্বিজেনের মনে হলকি হবে পড়াশোনা করেখুব সম্ভবত সেই কেরানীই হতে হবে। তার থেকে এ চাকরি মন্দ কিবেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড দেখা যাবেকলকাতার আন্ডারবেলি দেখা যাবে। রাতের কলকাতায় দাপটের সঙ্গে বেড়ানো যাবে। দ্বিজেন কল্পনা করে দেখলরাতের কর্ণসুবর্ণ কিংবা তাম্রলিপ্তে সে নগরকোটাল হয়েছে। বেশ রোমাঞ্চকর লাগল। সেযুগ হলে একটা তরবারি ঝুলতএখন একটা আগ্নেয়াস্ত্র থাকবে কোমরের বেল্টে।


পরের দিন দ্বিজেন লালবাজারে গিয়ে আবেদনপত্র ফিল আপ করে এলো। লোক্যাল গার্জিয়ানের একটা সই দরকার হয়তা মেসবাড়ির বাড়িওয়ালা সেটা করে দিয়েছে।


বাড়িতে এখনও কিছু জানায়নি। তার পরিবারে এর আগে কেউ পুলিসে চাকরি করেনিকাজেই বাড়ির লোকে মত দেবে না খুব সম্ভবত। যাক্‌গেচাকরি পাওয়া অনেক পরের ব্যাপার। প্রথমে ইন্টারভিউতারপরে শারীরিক পরীক্ষাতারপরে ঝাড়াই বাছাই করে কয়েকজনকে নেবে। আগে তো চাকরি হোকতারপরে বাড়িতে বলা যাবেতখন দেখা যাবে'খন। আর পুলিসের চাকরি ভালো না লাগলে এরপরে ছেড়ে দিতে তো কোনও বাধা নেই।


দ্বিজেনের এখন বয়েস ষোলো। সে কলকাতায় এসেছিল পনেরো বছর বয়েসে। এই বয়েসে মানুষ অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেআর সে অবিমৃষ্যকারিতার ফলে জীবন অনেকসময়ে একদম নতুন মোড় নেয়। তবে এই একবছরের কলকাতাজীবন তাকে অনেকটা গড়েপিটে নিয়েছেঅন্য খাতে বইয়ে দিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতার নৈশজীবন দেখেছে সে। দেশী বিদেশী অনেক সিনেমা দেখেছেপ্রত্যেক সপ্তাহান্তেই নতুন বাংলা আর ইংরেজি ছবি দেখার নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। গড়ের মাঠে সন্ধেবেলা চার লালমুখো গোরাসৈন্যের সঙ্গে বন্ধুরা মিলে মারামারি করেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন এবছর জুনমাসে মারা যানতারা তখন নিমতলায় গেছিল দল বেঁধে। বন্ধুদের সঙ্গে রেসের মাঠে গেছেসেখানে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে মাউন্টেড পুলিসের ঘোড়ার চাঁটও খেতে হয়েছিল।


দ্বিজেন একটু উড়নচণ্ডী হয়ে গেছেসন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে বখিয়ে দেওয়ার দায় মূলত কলকাতার ওপরেই বর্তায়।



সাত


প্রতিটি ট্রেনের সঙ্গে আমার চতুর্থভাগ আত্মা ছুটে যায়
প্রতিটি আত্মার সঙ্গে আমার নিজস্ব ট্রেন অসময় নিয়ে খেলা করে

--- সুনীল গাঙ্গুলী




ঘড়িতে বারোটা পঁয়তাল্লিশ। আশুতোষ কলেজ থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়তে দৌড়তে বেরোলো দ্বিজেনতার কাঁধে একটা ঝোলা। আজ কলেজের পরীক্ষার ফিজ জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিলটাকা যোগাড় করতে দেরি হয়ে গেছিলসে আজই জমা দিতে পেরেছে। এদিকে কাল থেকে দুর্গাপুজোর ছুটিচার সপ্তাহের। আজ বরিশালে ফিরবে সে।


দ্বিজেন বেলা দেড়টার বরিশাল এক্সপ্রেস ধরবে সে শিয়ালদা থেকে। নামে বরিশাল এক্সপ্রেস হলেও সে ট্রেন অবশ্য বরিশাল অবধি যায় নাতার অনেক আগেই থেমে যায়। সে ট্রেনের গন্তব্য হল খুলনা জেলা। বরিশালে বিশাল বিশাল সব নদীতার ওপরে ব্রিজ নেইরেললাইনও নেই। সাত সাগর না হলেওঅন্তত তেরো নদী দ্বিজেনকে পেরোতেই হবে বাড়ি ফিরতে গেলে। 


আজ হল মহাপঞ্চমী। বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। হাজরা মোড় থেকে কপালগুণে একটা মোটরবাস পেয়ে গেলকিছুটা দৌড়ে  চলন্ত বাসেই উঠে পড়ল সে। শিয়ালদা অবধি ভাড়া এক আনা।


শিয়ালদায় নেমেই প্রবল ঢাকের আওয়াজ শুনল দ্বিজেন। দূরদূরান্ত থেকে ঢাকীরা এসেছে কলকাতার পুজোয় বাজাবে বলে। তারা সবাই মিলে মহানন্দে ঢাক বাজাচ্ছে। বারোয়ারি পুজোবাড়ির পুজোর কর্তারা এসে বায়না করে একে একে নিয়ে যাবে তাদের। এরা বেশিরভাগই চাষী। এই পুজোর মরশুমে তাদের ঢাক শ্বেতশুভ্র পালকে সেজে উঠেছেদেখে মনে হচ্ছে যেন শিয়ালদার সামনে একটা আস্ত কাশবন উঠে এলো। তবে দ্বিজেনের এখন সেসব দেখার সময় নেই।   


হন্তদন্ত হয়ে শিয়ালদায় সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দ্বিজেন দেখে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। থার্ড ক্লাস বেশ খানিকটা সামনের দিকে,  সেপর্যন্ত দৌড়ে ওঠা যাবে না। পেছনের দিকে একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরার পাশে পাশে দৌড়চ্ছিল দ্বিজেন। তার দরজা ছিল খোলা। 


যা থাকে কপালেএই ভেবে সে লাফিয়ে উঠে পড়ল ফার্স্ট ক্লাসের দরজায়। লাফিয়ে উঠেই যার সামনে পড়ল দ্বিজেনতাকে দেখে সে এমন চমকে গেল যে চলন্ত ট্রেন থেকেই পড়ে যাচ্ছিল। ঠোঁটে একটা চুরুট নিয়ে দ্বিজেনের সামনে দুর্গাদাস ব্যানার্জি। বাঙালির প্রথম ম্যাটিনি আইডলবাঙালির প্রথম মহানায়কবাংলা চলচ্চিত্রজগতের সম্রাটবাংলার শহর থেকে মফস্বলের রূপোলি পর্দার একচ্ছত্র শাসকআপামর বাঙালির হার্টথ্রব দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিজেনের সামনে দাঁড়িয়ে। দ্বিজেন একটু টলে গেল।  সেই সঙ্কটমুহূর্তেও দ্বিজেনের মনে হলযতে যেন কতদূর থেকে দেখেছিলতিন হাত?


আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল সে। তবে দ্বিজেনের ভাগ্যে সেদিন মরা ছিল না। ফার্স্ট ক্লাস কামরার দরজার কাছেটুপিতে কপাল ঢেকে ধূমপান করছিলেন দুর্গাদাস। এক থাবা মেরে ধরে নিলেন দ্বিজেনকে। 

তবে দ্বিজেনের চমকানোর এখনও কিছু বাকি ছিল। কামরার ভেতরের দিকে সে তাকিয়ে দেখেএই ছোট্ট ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে প্রায় চাঁদের হাট বসেছে। দুর্গাদাস ছাড়াও আরও পাঁচজন আছেন। চারজনকে দেখে দ্বিজেন চিনলজ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্যশীলা হালদারছবি বিশ্বাস আর প্রমথেশ বড়ুয়া। পঞ্চম যাকে সে চিনতে পারেনিতিনি হলেন বি এন সরকার।


এরা একসঙ্গেএক ফ্রেমেএটা ট্রেনের কামরা না মাল্টিস্টারার ছবি?


দ্বিজেনের চিত্রার্পিত অবস্থা। এদিকে ট্রেন ততক্ষণে শিয়ালদা ছাড়িয়েছেট্রেন থামিয়ে যে দ্বিজেনকে নামিয়ে দেওয়া হবেসে ব্যবস্থা করাও এখন এই ভি আই পি দের পক্ষে সম্ভব নয়। এই চাঁদের হাটে অনুপ্রবেশ করে ফেলে দ্বিজেন যৎপরোনাস্তি সংকুচিত হয়ে পড়ল। তবে প্রশ্ন হলএরা সবাই শিয়ালদায় এলেনস্টেশনে তো দক্ষযজ্ঞ হয়ে যাওয়ার কথা। 


যেন তার মনের ভাবটা খানিক বুঝতে পেরেই দুর্গাদাস তার কাঁধে হাত রেখে বললেনদ্যাখোশিয়ালদার পেছনে একটা রাস্তা দিয়ে ঢুকেছি আমরাআর প্রত্যেকের মাথায় টুপি আর চোখে সানগ্লাস থাকায় পাব্লিক সহজে চিনতে পারেনি। সাদা পোষাকে সিকিউরিটিও ছিলতারাও অনেকটা ম্যানেজ করেছে আমাদের আড়াল করতে। কিন্তু তুমি তো আমাদের দেখে ফেললে হেএখন নেক্সট স্টেশনে নেমে যদি রটিয়ে দাওতাহলে তো মহা মুশকিল হবে। এ ট্রেনের খুলনায় পৌঁছতে এখনও ঘণ্টা চারেক। তার মধ্যেই সব মিডিয়া হাউজগুলো টেলিগ্রাম পাঠিয়ে নিজেদের প্রতিবেদকদের পাঠিয়ে দেবে স্টেশনে স্টেশনেআমাদের প্রতিবেদন করার জন্য। সেই বেদনা নেওয়া যাবে না। চলো তোতোমায় বরং বন্দী করা যাক।


দ্বিজেন এখনও ভ্যাবলা হয়ে আছে। এদিকে ট্রেন দমদম ছাড়ালোতারপর ডানদিকের লাইনে ঢুকে গেল। চেনাপরিচিত লাইন। এরপর ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন আসবেতারপর বিরাটি। তারপর মধ্যমগ্রাম। তবে ট্রেন দাঁড়াবে সেই বারাসাত জংশনে গিয়ে। 


প্রমথেশছবি বিশ্বাস আর বি এন সরকার একসঙ্গে বসে কি একটা আলোচনা করছিলেন। অন্যদিকে জ্যোতিপ্রকাশের কানে কানে শীলা কিছু একটা বলছিলেন। দ্বিজেন জানেসিনেমার গসিপ কলামগুলো ভর্তি থাকে আজকাল এই দুই সুদর্শন নায়ক নায়িকার প্রেমকাহিনীতে। শীলা হালদার মোটে কুড়ি বছর বয়স্কাভালো গাইতে এবং নাচতে পারেনউঠতি নায়িকাদের অন্যতম। দ্বিজেন এঁর কোনও ছবি এখনও পর্যন্ত না দেখলেওএঁর নাটক দেখেছে একটা। তবে জ্যোতিপ্রকাশ তো পূর্বে একবার বিবাহ করেছেনতার প্রথম স্ত্রীও বর্তমান।


জ্যোতিপ্রকাশ আশুতোষেও পড়াশোনা করেছেনদ্বিজেন শুনেছিল সিনিয়রদের মুখে। আট ন'বছর আগেকার কথা। এরপর প্লেন ওড়াতে শিখেছিলেন। বড়লোক বাড়ির ছেলেনিজের একটা ছোট্টখাট্ট প্লেনও ছিলমাঝেমধ্যে সেটা চালিয়ে এদিক ওদিক চলেও যেতেন। তারপরে সেনাবাহিনীতে জয়েন করেনকিন্তু বেশিদিন সেখানে মন টেঁকেনি। মেডিকেল গ্রাউন্ড দেখিয়ে অব্যাহতি পেয়ে যান। ফিল্মের একটা নেশা ছিলইতাই এরপর সোজা টালিগঞ্জ। দেবকী বসুকে কিছুদিন চলচ্চিত্র নির্দেশনায় অ্যাসিস্ট করেন। তারপরে কানন দেবীর বিপরীতে একটা ছোট চরিত্রে নামেনপরাজয় ফিল্মে। তারপর ডাক্তারযে ফিল্মের কথা দ্বিজেনের প্রথম শোনা জ্যোতির্ময়ের মুখে। জ্যোতিপ্রকাশকে অবশ্য দ্বিজেন পর্দায় দেখেছে এর মধ্যে। এ বছর চিত্রায় শিবরাত্রির দিন পরাজয় এবং জন্মাষ্টমীর দিন ডাক্তার সে দেখেছে সারারাতব্যাপী আয়োজিত সিনেমায়। ডাক্তারের হিন্দি ভার্শনও ক'দিন আগে রিলিজ করেছেসে ছবিটা সারা ভারতে সাড়া জাগাল।


এর মধ্যে বম্বের একটা হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতে গেছেন জ্যোতিপ্রকাশসে ছবির নাম রাজনর্তকী। সেখানে তার বিপরীতে ডাকসাইটে হিরোইন সাধনা বসু। এদিকে কলকাতায় জ্যোতিপ্রকাশ ও কানন দেবী একসঙ্গে আসতে চলেছেন একটা নতুন ছবিতেতার শুটিং শুরু হবে সামনের বছরের জানুয়ারিতেই। এ খবর কয়েকদিন আগেই দেখেছে দ্বিজেন। সে ছবিটার নাম যোগাযোগ। 



ট্রেন ঝমঝম করতে করতে বিরাটি আর মধ্যমগ্রামের মধ্যে একটা বনবাদাড় ভরা জায়গা পের হচ্ছে। এ জায়গার নাম আহারামপুর। আর ঠিক ন'বছর পরেই একদল উদ্বাস্তু যশোর জেলা থেকে ভিটেমাটি খুইয়ে এসে এখানে বসতি করবেএ জায়গার নাম তাদের পুরোনো ভিটের নামের সঙ্গে মিলিয়ে দেবে নিউব্যারাকপুরআর সেখানে এসে দ্বিজেনও ঘরবাড়ি করবেতার দাদা হিতেন্দ্রনাথও সেখানেই এসে থিতু হবে।


দুর্গাদাস দ্বিজেনকে কিছু একটা বলছেনকিন্তু দ্বিজেন ঠিক বুঝতে পারছে না। দ্বিজেনের চোখ কিরকম ঝাপসা হয়ে এসেছেকান কিরকম ভোঁ ভোঁ করছে। ওদিকে একটা হাসির উচ্ছ্বাস উঠলছবি বিশ্বাসের একটা রসিকতায় বড়ুয়াসাহেব এবং সরকারমশাই দুজনেই খুব হাসছেন।


শীলা আর জ্যোতির বিয়ের অনুষ্ঠান হবে শীলার দেশের বাড়ি খুলনায়। আমরা সেখানেই চলেছি। বাট ইয়ং ম্যানইউ লুক পেল। আর ইউ ফিলিং আনওয়েল?


দ্বিজেনের শেষ এই কথাটাই মনে আছে যেটা দুর্গাদাস বলেছিলেন। বাকি সময়টা কিরকম হিপনোটাইজড অবস্থায় কেটে গেছেসেটা তার মনে নেই। ট্রেন বারাসাত জংশনে পৌঁছলে সে একটা ছুতো করে নেমে যায় এবং একটা থার্ডক্লাস কামরায় উঠে পড়ে। এককোনায় একটু জায়গা করে নিয়েছিল দ্বিজেন।



তারকাদের সংসর্গ করাটা অনেকটা কড়া ঝাঁজের গঞ্জিকা সেবনের মতদ্বিজেনের মনে হয়েছিল ঘোরের মধ্যেই।


বরিশাল থেকে সেবার পুজোর ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরেই খবরটা পেল দ্বিজেন। সে কলকাতা পুলিসের চাকরিটা পেয়েছে।


আগের বছর১৯৪০-এর শুরুর দিকে ডুয়ার্সে ঠিকাদার ছবির আউটডোর শুটিং সেরে পাটনায় গেছিলেন দুর্গাদাস। একটা নাটকের কল শো করতে। ট্রেনেই ফিরছিলেন দুর্গাদাসতখন বর্ধমান স্টেশনে বাংলার প্রাইম মিনিস্টার ফজলুল হক এসে সেই ফার্স্ট ক্লাসেই উঠতে যাচ্ছিলেন। দুর্গাদাস ছিলেন সপরিবারে। ফজলুলকে উঠতে দেন নি। দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেনআমি তো আগে থেকেই এখানে আছিসপরিবারে ট্র্যাভেল করছিশরীরটাও ভালো নেই। এখানে গুঁতোগুঁতি না করে আপনি অন্য কোনও কামরায় যান। ফজলুল অবশ্য চলে যানকিন্তু যাওয়ার আগে একটু দুষ্টুমি করে স্টেশনমাস্টারকে চুপিচুপি নির্দেশ দিয়ে যান ঝামেলা করার জন্য। সে স্টেশনমাস্টার সম্ভবত ফজলুলেরই অনুগামী ছিলসে দুর্গাদাসকে অপমান করার চেষ্টা করলে এবং তাকে ওই ফার্স্ট ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে দুর্গাদাস তাকে একটি মোলায়েম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। এদিকে ট্রেন তো আটকে রাখা যায় নাফজলুলের জরুরি মিটিং ছিল গভর্নর স্যার হার্বার্টের সঙ্গে। ট্রেন ছেড়ে দেয়কিন্তু দুর্গাদাস হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলে জানতে পারেনইতিমধ্যে তার নামে এফ আই আর করা হয়েছে রেলপুলিসের কাছে। দুর্গাদাস বন্ডে সাইন করে তবে রেহাই পান।


দ্বিজেন এই কথা জানতসে যতীনের কাছে শুনেছিল। দ্বিজেন কল্পনা করলসে পুলিসের বড়কর্তা হলে কিভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দুর্গাদাসের সম্মান রক্ষা করতসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী যে-ই হোক না কেন।


আট


রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো

--- শক্তি চট্টোপাধ্যায়


তারিখটা তেইশে জানুয়ারিউনিশশো তেতাল্লিশ। বেলা সাড়ে বারোটা। চিত্রার সামনে প্রচণ্ড ভিড়।



আমিও সেই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজ অবশ্য কোনও ডিউটিতে নয়। আজ ছুটি নিয়েছি। আজ দুর্গাদাসের নতুন ছবি প্রিয় বান্ধবীর প্রিমিয়ার শো। আমি আর আশুতোষের পুরোনো বন্ধুরা। আমিই একটু চেষ্টাচরিত্র করে পাস যোগাড় করেছিলালবাজারে এক চেনা দাদা আছেন যার টালিগঞ্জপাড়ায় ভালো যোগাযোগ। আজকের শো আগেই হাউসফুল হয়ে গেছেএই মারাত্মক যুদ্ধের বাজারেও। জনতা দুর্গাদাসের জন্যে অপেক্ষা করছেসবার চোখ রাস্তার দিকেদক্ষিণে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের দিকে। এই পথে দুর্গাদাস আসবেন। প্রিমিয়ার অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা বেলা একটায়। 


বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কাহিনীকার প্রবোধকুমার সান্যাল এবং নির্দেশক সৌম্যেন মুখোপাধ্যায় দুজনে এসে দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালেনএবং জরুরি ঘোষণা করলেন। জানা গেলদুর্গাদাস আসছেন না প্রিমিয়ারে। একটা সমবেত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ উত্থিত হল সেই জনতার মধ্যে থেকে।


উপস্থিত দর্শকদের অনেকের হাতেই একটা করে পুস্তিকা। ব্রোশিওর বিক্রি হচ্ছে হলের বাইরে একটা স্টল থেকে। তাতে প্রিয় বান্ধবী সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্যগানের লিরিকসঙ্গে ছবি। সেই পুস্তিকায় অনেকে দুর্গাদাসের সই নেওয়ার জন্য আশা করে ছিলেনসে আশা একেবারেই পূর্ণ হল না। এছাড়া কেউ কেউ অটোগ্রাফের খাতা সঙ্গে রেডি করেই এনেছেনতারা হতাশ হয়ে সেগুলো পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন। এমনই হতাশ হলেন যে একটু পরে হিরোইন চন্দ্রাবতী দেবী এসে পৌঁছনোর পরেও তার অটোগ্রাফ নিতে ভুলে গেলেন অনেকে।


তবে চন্দ্রাবতীর একটু কাছাকাছি যাওয়ার জন্য অনেকেই গুঁতোগুঁতি করতে লাগলেন। হলের সামনে আগে থেকেই একগাড়িভর্তি পুলিস মোতায়েননায়িকাকে তারা ঘিরে ধরে সাধ্যমত বাধা দিচ্ছে ফ্যানদের। একটু পরেই তারা চন্দ্রাবতীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ব্যস্তসমস্ত হয়ে। একটু পরে হলের দরজা দর্শকদের জন্য খুলে গেলযাদের হাতে টিকিট তারা এবার বুক ফুলিয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগল। যাদের টিকিট নেইতাদের কেউ মুখ আমসি করে এদিক ওদিক ব্ল্যাকার কেউ আছে কি না খুঁজতে গেলআবার কারও টিকিট পরের শো'তারা সময় কাটানোর জন্য হাতিবাগানের কাফেগুলোতে ঢুকে পড়ল। কেউ কেউ আশায় আশায় রইলপরে যদি দুর্গাদাস আসেনতখন অটোগ্রাফ নেবে এই ফন্দিতে। কেউ কেউ হলের পেছনের দিকে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেসেখান দিয়ে ঢোকা যায় কি না এই মতলবে। মোদ্দাহলের সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেল।

আমার বন্ধুদের কারো এখনও দেখা নেইনিশ্চিত নিজের নিজের অফিস থেকে বেরোতে দেরি হচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত অপেক্ষা করে তারপরে হলে ঢুকে গেলাম। বন্ধুরা যে যার পাস নিয়ে পরে ঢুকে যাবে নিশ্চয়ই। দেরি করলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা মিস করব।


***


প্রিয় বান্ধবীর প্রিমিয়ার শো শুরু হয়ে গিয়েছে চিত্রায়। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটেহাতিবাগানে আজ সবাই জহর আর শ্রীমতীর আশ্চর্য বন্ধুত্বের কাহিনী দেখতে গেছেপর্দায় যাদের ফুটিয়ে তুলছেন দুর্গাদাস আর চন্দ্রাবতী।

এখন একটা গানের সিকোয়েন্স চলছে।
গানেরি ইন্দ্রধনু মূর্চ্ছনায়সন্ধ্যাবেলায়
আমারি হিয়ায় ফোটে উচ্ছলতায়...

হলের মধ্যে অন্ধকারে একজনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে 

নোটবুকে পেনসিলের আঁচড় কাটতে শুরু করল দ্রুত।

গা--মু-সো...
-হি-ফৌ......

নয়


ক্ষুদিরামের মা আমার কানাইলালের মা
জননী যন্ত্রণা আমার জননী যন্ত্রণা

---মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়




শীলাএকটা জাপানী লোককথা আছে জানোকাননের মুখে শুনেছিলাম একবার নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিওর আড্ডায়। দশকল্পযুগ কেটে গেলেঈশ্বররা একবার করে মানুষের কাছে আসেনএসে প্রশ্ন করেনমানুষতুমি দেবতা হবেহতে চাইলে আমাদের সঙ্গে এসো। এসো এসোচলে এসো। মানুষ সভয়ে পিছিয়ে যায়আর দেবতারা হতাশ হয়ে ফিরে যান। আমার প্রায়ই মনে হয়আমাদের বাঙালিদের মধ্যে সেরকম একটা যুগ এসেছিল। আগের শতাব্দীতে যখন রামমোহনবিদ্যাসাগর আর বঙ্কিমবিবেকানন্দ। তখন এসেছিল। এ শতাব্দীতে যখন অগ্নিযুগ এলতখনও মনে হয় এসেছিল সেই ঈশ্বরীক্ষণ। আর মনে হয়আমরাও সেই লোককথার ভীরু মানুষদের মত পিছিয়েই গেলাম। 


আমি একবার রাসবিহারীকে দেখেছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পায়অতবড় একজন বিপ্লবীকিন্তু এমন ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন হাওড়া স্টেশনের কুলিরএবং সেই কুলির বেশেই মিটিং এ এলেনসে না দেখলে কল্পনা করা যায় না। আর্ট কলেজের এক দাদার সঙ্গে বিপ্লবীদের গোপন মিটিং এ গেছিলাম। সালটা বোধহয় ১৯১৪ হবে। রাসবিহারী দিল্লি আর লাহোরে বিপ্লব সঙ্ঘটিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ইংরেজ বলতইন্টারপ্রভিনশিয়াল টেররিস্ট। কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে ফেলে ইংরেজরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। দিল্লিতে শোভাযাত্রায় বড়লাটের ওপরে বোমা ফেলে রাসবিহারী বুঝিয়ে দিলেনবাঙালির অগম্য স্থান কোথাও নেই। 


কিন্তু শীলাবিপ্লবের আদর্শের থেকে বেশি টেনেছিল আমায় রাসবিহারীর নিপুণ অভিনয়ক্ষমতাআর তার থেকেও বেশি ওই মেক-আপের কারিকুরি। নিজের মেক-আপ নিজেই করতেন। মানুষকে অবজার্ভ করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলএকটা চরিত্রে ঢুকে তারপর বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলযেটা অভিনেতারও না থাকলেই নয়। নেহাত দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার ভূত মাথায় চেপেছিলনইলে রঙ্গমঞ্চে এলে উনি এযুগের অর্ধেন্দু মুস্তফি হতে পারতেন। কিংবা বেরটোল্ট ব্রেশট।


যন্ত্রণাটা বেড়ে যাচ্ছে শীলাআর খুব বেশিক্ষণ বাকি নেই জীবনেরসেটা খুব টের পাচ্ছি। কিন্তু এ ছবিটাপ্রিয় বান্ধবীসমস্ত যন্ত্রণা নিয়েও করতেই হত। তুমিতোমাদের কন্যাসন্তানজ্যোতিপ্রকাশতোমরা সবাই ভালো আছ তোশিগগিরিই তোমাদের সব্বার সঙ্গে আমার দেখা হবেশীলাবোন আমার।


শেষ ঘনিয়ে আসছে তা আমি জানতাম। আমি তো ধ্বংসস্তূপ হয়েই আছি। চলমান শব যাকে বলে। সারাজীবনে নিজেকে কম ভাঙচুর তো করিনিশরীরের ওপরে কম অত্যাচার তো করিনিফুঁ দিয়ে নিজের আয়ুরেখাকে নিজেই উড়িয়েছি। কিন্তু হাতে জমে থাকা কাজগুলো শেষ করার ছিল। সিনেমা শিল্প যাতে বাঙালির হয়ে কথা বলেবাঙালির এতযুগের সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়এই আশা আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমিও করেছিলাম। সেই কয়েকজনের সবাই আমাকে নেতাও ভেবে নিয়েছিল বটে। কিন্তু আমি তো আসলে কর্মী। শুধু কর্মী। আমি নেতা নইশীলা। আমি একসময় রাসবিহারী বসুর মত নেতাকে দেখেছিতারপরে সুভাষকে দেখেছি।


আমায় কালীশ বলেছিলকিছু সংবাদ পৌঁছে দিতে হবে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের জেলার কর্মীদের। কিন্তু এই অবস্থায় সাংকেতিক বার্তা পাঠানোর ঝুঁকি প্রচণ্ড। হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করার পর থেকেই কমিউনিস্টরা আমাদের সবার খবরাখবর পৌঁছে দিচ্ছে ইংরেজদের কাছেফরওয়ার্ড ব্লকের নেতাদের
বেশিরভাগ এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের পরিচিত মুখের অনেকেই অ্যারেস্ট হয়ে গেছেনযাদের যাদের কথা কমিউনিস্টরা জানতজানতে পেরেছিল সুভাষের রামগড়ের আপোষবিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়কংগ্রেসের মধ্যে ও বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচী একসঙ্গে নেওয়ার সময়। কমিউনিস্টদের আমরা বিশ্বাস করেছিলামবিপ্লবের পথে সহযোদ্ধা হিসেবে। এইবার আমাদের সবাইকে ধরিয়ে দিচ্ছে ওরা। রাশিয়া ওদের বলেছিল যুদ্ধে ইংরেজকে সাহায্য করতেআর আমাদের কমিউনিস্টরা সরাসরি ইংরেজের স্পাই হয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আসলে ইংরেজের জেলের ভেতরেই কিছু খোঁচর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে। যাই হোক। এইরকম অবস্থায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কোনও সম্মেলন ডাকা প্রায় আত্মহত্যার সামিল হবে। তাছাড়াও আমাদের সবাই আন্ডারগ্রাউন্ড। এই অবস্থায় সুভাষ চাইছেনসংবাদটা কোনও ফিল্মের মাধ্যমে কৌশলে পৌঁছে দেওয়া যায় কি না।


আমি জানতে চেয়েছিলাম সংবাদটা কিএবং সেটা কোথথেকে এসেছেআর সংবাদ কি নির্ভরযোগ্য?


নির্ভরযোগ্য। সুভাষ জার্মানি ছেড়ে আসতে চলেছেন। আসবেন জাপানে। জাপানের সরকারের সঙ্গে আগেই আলোচনা চালিয়েছেন রাসবিহারী। শীঘ্রই পূর্বদিক দিয়ে ভারত আক্রমণ শুরু করবে আজাদ হিন্দ ফৌজইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এর নেতৃত্ব সুভাষের হাতে থাকবে। রাসবিহারীজাপানের বিদেশমন্ত্রক গাইমুশো এবং ভারত বিষয়ক দপ্তর হিকারি কিকান নির্দেশ দিচ্ছেনফরওয়ার্ড ব্লক এবং বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কর্মীরা পূর্ববঙ্গের জেলায় জেলায় যেন প্রস্তুত থাকেযাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রচুর নৌকো যেন গোপন স্থানে তৈরি থাকেঅতিদ্রুত বিদ্যুৎগতি আক্রমণ চালিয়ে ইংরেজ শাসনের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দিতে হবে বাংলা জুড়ে। এই আক্রমণ তেতাল্লিশ সালের বর্ষাকালে শুরু হতে পারেপরিকল্পনা সেরকমইকারণ পূর্ববঙ্গে বিদেশী শাসন অচল করে দেওয়ার জন্য বর্ষাকালই প্রকৃষ্ট সময় কিন্তু আমাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ প্রস্তুত না থাকলে এই অভিযান সফল হবে না। এই হল বার্তা। কোথথেকে এসেছে সেসব জানানো যাবে না তা তুমি জানো দুর্গাদা। কালীশ বলেছিল আমায়।


আমি রাসবিহারীকে দেখেছিশীলা। তোমার জন্মেরও বহু আগে তিনি এই দেশজুড়ে সশস্ত্র বিপ্লব সঙ্ঘটিত করতে ঘরবাড়ি ছেড়েছিলেননিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়েছিলেন ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন বলে। আজ এই যে যুদ্ধটা চলছেএকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলে লোকেতখন যে যুদ্ধটা চলছিলসেটা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে হবেইংরেজের শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইংরেজমুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখতেন রাসবিহারী। আমাদের দুর্ভাগ্যবাঙালির দুর্ভাগ্যযে বাকি ভারত রাসবিহারীর সেই স্বপ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারল না।




আমার খালি মনে পড়ছিল সেই জাপানী লোককথার গল্পটা। আমরা তো কম চেষ্টা করিনি এই পরাধীনতাএই ক্ষুদ্রত্ব থেকে উত্তরণের জন্যকিন্তু তবুও শেষপর্যন্ত পিছিয়ে গেছিআর সেইসঙ্গে দশকল্প পিছিয়ে গেছে স্বাধীনতা অর্জনের কাজ। একজন জাপানী জেনারেল বৌদ্ধভিক্ষু সেজে এলেন কলকাতায়রাজগীরের পাহাড়চুড়োয় বৌদ্ধমঠ থেকে বেতারে খবর পাঠাবেনতার সমস্ত কাজে সহায়তা করার জন্য কলকাতা থেকে একজন বিপ্লবীকে পাঠানো হল সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে। সে কাজের জন্য মুকুল বোস নিজে ঝুঁকি নিয়ে একটা ট্র্যান্সমিটার তৈরি করল। কিন্তু দুজন বাঙালিরই বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে গেল সেই জাপানি এবং আমাদের সেই বিপ্লবী। ভাগ্যিস এরা মুকুলের কথা কিছু জানত নাতাই পুলিস এদের অনেক নির্যাতন করেও কিছু বের করতে পারেনি। মুকুলের তো নিজের হাতে বানানো বেতারযন্ত্রট্র্যান্সমিটার ছিলসে যন্ত্র দিয়ে সুভাষ কয়েকবার জার্মানিইটালি আর জাপানের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। বেতারযন্ত্রের আবিষ্কর্তা জগদীশ বোস নিজের হাতে মুকুলকে শিখিয়েছিলেন সেই বিদ্যা। তবে ইংরেজরা একটা ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস চালায় বটে। কোথথেকে খবর পেয়ে মুকুলের ট্র্যান্সমিটারটা বাজেয়াপ্ত করে নিল ১৯৩৯ সালেই। জ্যোতি বিমান চালাতে জানতএকবার জ্যোতির প্লেনে চাপিয়ে পঞ্চাশটা মাউজার পিস্তল আনানো হয়েছিল বে অভ বেঙ্গলে ঢুকে পড়া একটা জার্মান সাবমেরিন থেকে। সেগুলো বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। জ্যোতির প্লেন চালানোর লাইসেন্সও ইংরেজরা বাতিল করে দিল কিভাবে গন্ধ পেয়ে। 


তবে সে কথা থাকশীলা। যা বুঝেছিলামএখন প্রধান কাজ হল সিনেমার মাধ্যমে বার্তাটা পৌঁছে দেওয়া। আমি কালীশকে বললামএকবার প্রিয় বান্ধবীর লিরিসিস্টকে ডাকো। গানের ভাষাতে সঙ্কেত গুঁজে দেওয়া যায়আর ছবির ব্রশিওরেও সঙ্কেত গুঁজে দেওয়া যায়কাজেই পাবলিসিস্টকেও ডাকো। আর বি এন সরকারকে বলে সে ছবিটা সামনের বছর তেইশে জানুয়ারি রিলিজ করাও। চিত্রায় এমনিতেও তেইশে জানুয়ারি সুভাষের জন্মদিনে প্রভাতফেরীর অনুষ্ঠান হয়কাজেই ফরওয়ার্ড এবং বিভি দুদলের কিছু লোক আসবেই। চোরে কামারে দেখা হবে নাকিন্তু সিঁদকাঠি ঠিকই তৈরি হয়ে যাবে।


ইতিহাস মনে করে রাখবেআমার শেষ ছবি প্রিয় বান্ধবী রিলিজ করেছিল চিত্রা সিনেমায়তেইশে জানুয়ারি উনিশশো তেতাল্লিশ সালে। বাকি তথ্য ইতিহাসের জন্য নয়শীলাসে শুধু আমাদের মত চলমান শবের জন্য। পুরো বেয়াল্লিশে আমি আর একটাও ছবি করিনিতখন শুধু এই প্রিয় বান্ধবীর কাজ হচ্ছিল। ছবিটা বেয়াল্লিশের দুর্গাপুজোর সময় রিলিজের কথা হয়েছিল প্রথমে। সেবছর লোকে বোমা পড়ার ভয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। আমি আর কালীশ একবার নিউ এম্পায়ারে ছবি দেখতে গেলাম। শো'র মাঝখানে আচমকা সাইরেনের শব্দ শোনা গেলআর ছবি বন্ধ হয়ে গিয়ে পর্দায় ভেসে ওঠেটার্ন কুইকলি টু দ্য লেফটটু দ্য লবি অর দ্য বার। সবাই আতঙ্কে হল থেকে গুঁতোগুঁতি করে বেরোয়। এরকম অবস্থায় কোন্‌ দর্শক ছবি দেখতে আসবেকিন্তু আসছিল তাওরূপোলি পর্দার এমনই মায়া। 


শীলাবোন আমারবেয়াল্লিশ বড় খারাপ কেটেছিল। যেদিন জানতে পারলামতোমার আর জ্যোতির বিবাহ আইনসিদ্ধ নয়হিন্দু বিবাহ আইনে অসবর্ণ বিবাহ চলে নাআর জ্যোতির আগের স্ত্রী ডাইভোর্সে নারাজতাই জ্যোতির দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তোমার জায়গা কোথাও নেইহিন্দু বিবাহ আইন তোমার স্বীকৃতি দেবে না অসবর্ণ বলেআর সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট জায়গা দেবে না এটি জ্যোতির দ্বিতীয় বিবাহ বলেসেদিন খারাপ লেগেছিল। তারপর শুনলামতুমি আর জ্যোতি মুসলমান হয়েছতোমাদের অনাগত সন্তানটির জন্য সামাজিক মর্যাদার আশায় মরিয়া হয়েনইলে সে অবৈধ বিবাহের অবৈধ সন্তানের খেতাব পেয়ে যাবেসেদিন খারাপ লেগেছিল। তুমি আর জ্যোতি যুদ্ধজয় করা মানুষসেই তোমরা এইভাবে পরাজয় স্বীকার করেমাথা নিচু করে এই অবমাননা বরণ করে নেবেএ ভাবলেও অসম্ভব কষ্ট হয় শীলা। তারপর তোমার কন্যাসন্তানটি জন্মানোর দুদিনের মাথায় মারা গেলসেদিন আমি অনবরত কেঁদেছি। সে কান্না শুকিয়ে যাওয়ার আগেই জানতে পারলামতুমি মারা গেছ। আমি তোমার বিয়েতে ছিলামশীলাআমি তোমার কন্যাসম্প্রদান করেছিলাম। তুমি এবং তোমার সন্তান যখন মারা গেলেশীলাআমি এক পক্ষকাল অশৌচ করেছিআমি রাতের আকাশের দিকে মুখ তুলে বোবা অভিযোগ জানিয়েছি। দুর্গাদা বলে তুই আমায় ডাকতি বটে বাকিদের মতকিন্তু আমি তো তোর বাপের বয়েসী। তোর জন্ম উনিশশো বাইশেআমি তো তখন আমার প্রথম ফিল্মে অভিনয় করে সেরেছি রে। বুড়োদের কাঁধে বাচ্চাদের লাশের থেকে বড় অভিশাপ আর কিছু নেই। এর দুমাসের মাথায় জ্যোতি আত্মহত্যা করল। বাংলা চলচ্চিত্রকে যে সম্রাটের মত শাসন করতে জন্মেছিলসে অভিষেকের আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। কি অসামান্য প্রতিভাকি সুখী তোদের সংসারকিভাবে কার বিষনিঃশ্বাসে সব পুড়ে নষ্ট হয়ে গেলশীলাআমি মারা যাওয়ার পরে শুধু জানতে চাই একবার। ভূত হয়ে যদি ঘাড় না মটকাই তাদের!


প্রিয় বান্ধবী নাকি এবছরের সেরা ছবির পুরষ্কার পেয়ে যাবেবি এফ জে এ-এর সবাই বলছিল। আমি আর সেটা দেখার জন্য বেঁচে থাকব না। এ আমার শেষ জবানবন্দীশীলা। আমার চারপাশের কেউ শুনতে পাচ্ছে নাতারা ভাবছে ডেলিরিয়ামতারা ভাবছে শেষসময়ে দুর্গাদাস বাঁড়ুয্যে প্রলাপ বকছে। শীলাঅদৃশ্য কালিতে লেখা এই চিঠিএ আমার জীবনের শেষ অ্যাডভেঞ্চার। এ চিঠি তুই ছাড়া আর কেউ পড়বে নাএই চিঠি অতীতবর্তমান ও ভবিষ্যতের সীমানা মুছে দিকজীবিত ও মৃতের মাঝখানের দেওয়াল অতিক্রম করুক। শান্তি আসুক বাঙালির জীবনেস্বস্তি আসুকসে জয়ী হোক জীবনসংগ্রামেএই শেষ কামনা রইল। 


আর আমি আসছিতোর বানানো সেই মাংসের কচুরি আবার খেতে খুব ইচ্ছে করছেবানিয়ে রাখিস বোন।



ইতি,
দুর্গাদা
২০শে জুন১৯৪৩


দশ



কি অপূর্ব শোভাসেই গম্ভীর বিষ্ণুমন্দিরে প্রকাণ্ড চতুর্ভুজ মূর্তির সম্মুখেক্ষীণালোকে সেই মহাপ্রতিভাপূর্ণ দুই পুরুষ মূর্তি শোভিত – একে অন্যের হাত ধরিয়াছেন। কে কাহাকে ধরিয়াছেজ্ঞান আসিয়া ভক্তিকে ধরিয়াছে – ধর্ম আসিয়া কর্মকে ধরিয়াছে বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে ধরিয়াছে কল্যাণী আসিয়া শান্তিকে ধরিয়াছে। এই সত্যানন্দ শান্তি এই মহাপুরুষ কল্যাণী। সত্যানন্দ প্রতিষ্ঠামহাপুরুষ বিসর্জন। বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল।
---বঙ্কিমচন্দ্রআনন্দমঠ





হবানন্দ আর গবানন্দের কথোপকথন হচ্ছে। স্থান গড়ের মাঠ। সময়ঃ উনিশশো তেতাল্লিশ সাল।

গবানন্দঃ প্রভুঅবলোকন করুনইংরেজ ভাঙিতেছেঅনুমতি দিন আক্রমণ করি।

হবানন্দঃ বৎসভাঙিতেছে সত্যইহারা বঙ্গভূমি ছাড়িয়া পলায়ন করিবে তাহাও সত্য, কিন্তু এখন  বাংলায় বাঙালির রাজ্যপাট হইবে না। তুমি অনর্থক এমন কসরত করিও না এবং পাঁয়তাড়া কষিও না।

গবাঃ কি বলিতেছেন মহাত্মন্‌যাহার জন্য এমন রক্তপাতএমন ত্যাগস্বীকারএতগুলি মানুষের এ চূড়ান্ত ক্ষতিস্বীকারএতগুলি বীরের দ্বীপান্তরএতগুলি শহীদের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদান,  বাঙালির এই অবদানএই অগ্নিযুগএই এতকিছুতাহা সব বিফল হইবে?  
     
হবাঃ বৎসহাঁউমাউ করিও না। ইতিহাস বড় বিচিত্রতার কুটিলগতি। ইতিহাস বলিতেছেএক্ষণে বাঙালির মধ্যে বিশ্বমানবদিগের একাধিপত্য শুরু হইবে। তাহারা প্রবল বিশ্ববাদীক্রমে ক্রমে তাহারা বিশ্বের খেটে খাওয়া প্রলেতারিয়েতের জন্য মিছিল করিবে কলিকাতার বুকেএবং ঘরের পাশে পূর্ববঙ্গে হিন্দু মরিলে তাহা ফিরিয়াও দেখিতে যাইবে না। তাহারা ভল্গা হইতে মাচু পিকচু,  হনোলুলু হইতে হাজারিবাগ সর্বত্র এই বিশ্বমানবতাবিশ্ববিপ্লব,  এবং কালে কালে বিশ্বহিন্দুত্বের উপাদান খুঁজিয়া পাইবেইহারা বাঙালিয়ানাকে সংকীর্ণ এবং অতিনিম্ন আখ্যা দিবে। ইহাই হইবার,  ইহাই হইবেএবং তোমার বিলাপ ও হাহাকারে তাহা বদলাইবে না।


গবাঃ প্রভুআমার যে মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করিতেছে। এ আপনি কি ভয়ানক বার্তা দিতেছেন। হা হতোস্মিএই সর্বনাশা ভবিষ্যদ্বাণী শ্রবণের পূর্বে আমি মরিয়া যাইলাম না কেন


হবাঃ বৎসবাঙালি সেই বঙ্কিমের সময় হইতেই জাতির আরাধনা শুরু করিয়াছিল বটেকিন্তু বঙ্কিম শুধু যে আরাধনা করিতে শেখান নাইব্যবচ্ছেদও শিখাইয়াছেনশুধু পূজা শেখান নাইঅনুসন্ধানও শিখাইয়াছেনতাহা স্বাদেশিকতার তোড়ে বাঙালি মনে রাখে নাই। আবেগ বড় বিষম বস্তু। ভরা জোয়ারের মতপ্রবল স্রোতের মত। নৌকো বাহিতে হয় নাআপনা আপনি আগাইয়া চলে। সে আবেগের জোয়ার চিরকাল রহিত না। বাঙালি যত আবেগ দিয়াছেযত রক্ত দিয়াছে তাহার স্বাদেশিকতার আরাধনায়তত মস্তিষ্ক দেয় নাই। যত বলিদান দিয়াছে তত তত্ত্ব দেয় নাই। যত সাহসিকতার পরিচয় দিয়াছে তত সংগঠন দেয় নাই। জল শুকাইয়াছেআজ ভাঁটা আসিয়াছেআজ স্রোতের প্রতিকূলে বাহিতে শিখিতে হবে। আজ ইতিহাসের শব-ব্যবচ্ছেদ করিতে হইবেআজ নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধান করিতে হইবেআজ পশ্চিমের বস্তুবাদী দর্শন হইতে শিখিতে হইবে। কে শিখাইবেকংগ্রেসীগুলা সুবিধাবাদী এবং অভ্যেসে চলিয়া থাকে,  আর হিন্দু মহাসভা চিরকাল ইংরাজের দালালি করিয়া থাকে।

আমরা বিপ্লবী বাঙালিসমাজবদলে বিশ্বাসী বাঙালিরামমোহন বিদ্যাসাগর বঙ্কিম বিবেকানন্দের বাঙালি কাহার কাছে গিয়া শিখিবসুভাষকে কংগ্রেস হইতে তাড়াইয়া যে বিধান রায় ইঁট পাটকেল খাইয়াছিলেনসেই নেহরু-গান্ধীর দালালের কাছ হইতে শিখিবআজীবন ইংরেজ অনুগতবিপ্লববাদের শত্রু শ্যামাপ্রসাদের কাছ হইতে শিখিবনাআমরা বামপন্থীদের হইতে শিখিব। দর্শন শিখিবইতিহাস শিখিবসাহিত্য শিখিব। নারীবাদ কাহাকে বলে শিখিবসাম্রাজ্যবাদ কাহাকে বলে শিখিব। শ্রমিক শিখিবপুঁজি শিখিব। সমাজের প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করিতে হইবেআমরা বামপন্থীদের থেকে সাব-অল্টার্ন শিখিব। আমরা ফিল্মে চ্যাপলিন আর মঞ্চে ব্রেখট শিখিবশিক্ষাঙ্গনে অ্যাডর্নো হর্কহাইমার এবং আর্বান গেরিলা যুদ্ধে মারিগেল্লা শিখিব। ইহাদের কারণে কিছু গোল্লাও পাইবকারণ ইহারা অনেক ভুলভালও শিখাইবেসন্দেহ নাই। সে ভুলের মাশুল প্রদান করিতে গিয়া বঙ্গদেশের এবং বাঙালির অনেক ক্ষতিও হইবেসন্দেহ নাই। তাহাদের অনেক শিক্ষা অতিদ্রুত সামাজিক আর্থিক পটপরিবর্তনে তামাদিও হইয়া যাবেসন্দেহ নাই। কিন্তু যাহা মিলিবেতাহার মূল্য অনেক।
উপরন্তু ইহাদের ইংরেজ গুঁজিয়া গেছেইহাদের নেহরুর শাসনাধীন স্বাধীন ভারতের সরকারও বিভিন্ন ক্ষেত্রেবিশেষ করিয়া শিক্ষাক্ষেত্রে গুঁজিবে। ইহাদের সহিত তাত্ত্বিক যুদ্ধে শেষ জয়ী হয়এমন শক্তি কাহারও রহিবে না। উপায়ান্তর থাকিলে আর কহিব কেন ইহাদের মানিয়া লইতেইহারা বাঙালির ভবিতব্য। চট করিয়া ইহাদের মৌরসীপাট্টা শেষ হইবে না। অতএব রে মূঢ়এই গুম্ফশোভিত স্তালিনচিত্রকে প্রণাম করব্যোম কালীএই বলিয়া হাই তুলিয়া হবা চক্ষু নিমীলিত করিলেন।


গবাঃ ধ্যাত্তেরিএ ব্যাটা ভবিষ্যতে বসিয়া অতীতবাণী করিতেছে।

হবাঃ (চক্ষু মুদ্রিত করিয়াইসব পুরাণই তাহাই করিয়াছে বৎসসকলেই ভবিষ্যতে বসিয়া অতীতকে লইয়া ভবিষ্যতবাণী করিয়াছে। ইহা প্যাঁচালো কেস। ইতিহাস তো ঐতিহাসিক উপন্যাসের হস্তপদ বাঁধিয়া রাখিয়াছেসুতরাং সেই বাঁধা হস্তেই ভানুমতীর খেল যাহা দেখাইবার তাহা দেখাইয়া যাইতে হয়।

গবাঃ যাহা অতীতযাহা ঘটিতযাহা হইয়া গিয়াছেতাহাকে অবশ্যম্ভাবী বলিয়া ভবিষ্যদ্‌বক্তার খেতাব দিতেছ নিজেকেবেল্লিক কোথাকার।

হবাঃ (চোখ খুলিয়াচোখ পাকাইয়াচোপ হঠকারী হনুমানএটা কি দুহাজার এগারো সাল পাইয়াছিসএইটা উনিশশো তেতাল্লিশএক্ষণে কমিউনিস্ট উঠিবেবিশ্বমানবও উঠিবে। উহাদের উঠিবার কথা ইতিহাস লিখিয়া গিয়াছেতুই কেবলই পাতিহাঁসের মত প্যাঁক প্যাঁক করিয়া কি সেই লিখন বাতিল করিয়া দিতে পারিবি?

গবাঃ (হতাশ হইয়া হাত পা ছড়াইয়া শুইয়া পড়িলেনএমনটা তো কথা ছিল নাএই পরিণতির জন্য শরীর পাতন করিলামএই পরিণামের জন্য বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ফাঁসি গিয়াছিল?

হবাঃ বামপন্থীরাও বিপ্লবী। তাহারা বিপ্লবের শত্রু নয়মিত্র। আর দ্যাখ্‌ হনুমানবঙ্কিম ইংরেজের চাকুরি করিতেনএবং আনন্দমঠ লেখার সময় ইংরেজ রাজত্ব মধ্যগগনে। আমি বিশ্বমানবের চাকুরি করি নাআর বামপন্থীদের রাজত্বও ঢলিয়া গিয়াছে। ফলে ইহাদের সাফাই গাইবার কোনও বাধ্যবাধকতাই আমার নাইইতিহাসের লৌহদৃঢ় যুক্তি এবং ক্রনোলজির ঘটনাপরম্পরা ব্যতীত। কিন্তু বিশ্বমানব যে বাঙালি বৌদ্ধিক পুষ্টিতে সহায়তা করিবেকমিউনিস্ট যে বাঙালিকে বিপ্লবের তত্ত্ব এবং পশ্চিমী দর্শনে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিবেতাহা নিজের মস্তকে গজাল মারিয়া ঢুকাইয়া দে। এবং ইহাদের শিক্ষা বাঙালির মেধাচর্চায় সহায়ক। আজ যে জাতীয়তাবাদ দেখিতেছিসতাহা লইয়াও পৃথিবীজুড়িয়া কাজ বামপন্থীরাই করিবেএদেশে করিবে না যদিও। হিন্দুদিগের মধ্যে তো একবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদ বলিলে বুঝাইবে হনুমানতাহা বাঁদরামি ব্যতীতএবং এ ওর লেজ ধরিয়া ঝুলিবার ব্যতীত অপর কোনও কর্মে আসিবে না। বাঙালির বামপন্থা তাহার শাপে বরবুঝিয়াছিস আকাট?

গবানন্দ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার চোখে আশার আলো চিকচিক করিতেছে। সেই দেখিয়া হবানন্দও আরেকটি হাই তুলিয়া অলসভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। গবানন্দ তখন হবানন্দের হাত ধরিলেন। হবানন্দ গবানন্দকে লইয়া ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে লইয়া যাইলেন। সন্ধ্যায় মুক্ত বাতাস সেবন করিলে ছোকরার মাথাটা খুলিবেবর্তমানে বড়ই ব্যস্তসমস্ত হইয়া আছে।


হবানন্দ গবানন্দকে লইয়া যাইলেন।

আহাসে কি দৃশ্য। অভিজ্ঞতা আসিয়া উৎসাহকে লইয়া যাইলউত্তর আসিয়া প্রশ্নকে লইয়া যাইলইতিহাস আসিয়া সনতারিখকে লইয়া যাইল। গবানন্দ প্রতিষ্ঠাহবানন্দ বিসর্জন। গবানন্দ কুমারটুলিহবানন্দ বাবুঘাট। গবানন্দ নোবেলহবানন্দ নোবেলচোর।

এঁদের যাওয়ার পথে বঙ্কিমচন্দ্র সেন্ট পলস চার্চের দেওয়ালের রোয়াকে বসে বসে মার্ক্সের এইট্টিন্থ ব্রুমেয়ার পড়ছিলেন। এদের গলা জড়াজড়ি করে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেনআর বিড়বিড় করে বললেনফার্স্ট টাইম অ্যাজ ট্র্যাজেডিসেকন্ড টাইম অ্যাজ ফার্স।


এগারো


সাদা বাড়িট্রামলাইনের রোদতোমরা একদিন আমায় বিদায় বলেছিলেমনে নেই?

--- সুনীল গাঙ্গুলী





'মাস ফোর্ট উইলিয়ামে আর্মি-অক্সিলিয়ারি ডিউটির পরে দ্বিজেনের এখন কালীঘাট থানায় পোস্টিং। আজ তেমন কাজ নেইসে বসে বসে মনে করছিল আলিপুর পুলিস লাইন্সে কলকাতা পুলিসের ট্রেইনিং-এর সেইসব ভূতোনন্দী খাটুনির দিনকালের কথা। চাকরিটা হয়েছিলও বেশ আশ্চর্য রকমের পরীক্ষা নিয়ে। দ্বিজেন ছোটবেলা থেকেই ইংরেজিতে ভালো। এক লালমুখো সাহেবসে একগাদা প্রশ্ন করল। তার মধ্যে শেকসপিয়ারের কোন নাটক ভাল্‌লাগে থেকে শুরু করে হলিউডের কোন তারকাকে পছন্দ সবরকমের প্রশ্নই ছিল। এরপর এক সাহেব ডাক্তার নিল মেডিকেল পরীক্ষা। তার কয়েকদিন পরেই পুজোর ছুটি শুরু হয়ে গেল। ফিরে এসে দ্বিজেন জানতে পেরেছিলচাকরি পেয়েছে সে। এইবার ট্রেইনিং এর পালা।

সে কি ট্রেইনিং। সকালে পাঁচটায় সাইরেন বেজে উঠত। ছটার মধ্যে প্রাতঃকৃত্য সেরেব্রেকফাস্ট সেরে প্যারেড গ্রাউন্ডে। তারপরে তিনঘণ্টা শারীরিক কসরতের পরে একঘণ্টা বন্দুক চালানোর ক্লাস। এরপরে ফিরে এসে আবার স্নান করে পেনাল কোডের ক্লাস। তারপরে লাঞ্চ। লাঞ্চের পরে প্যারামিলিটারি ট্রেইনিং হতএটা ছিল স্পেশাল রিক্রুটমেন্টে ঢোকা সমস্ত এ এস আই-এর জন্য বাধ্যতামূলক। এরপরে আবার আইনের ক্লাস। সন্ধে সাতটার সময় সব শেষ হততারপরে রাত আটটায় ডিনার। এরকম একমাস চলেছিল।


একটা ফোন এলো। হ্যালোকালীঘাট থানাডিউটিতে কে এখনদাশগুপ্তশুনুনআমি কন্ট্রোল রুম থেকে সার্জেন্ট স্মিথ বলছি। বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউতে চলে যানদুর্গাদাস ব্যানার্জিহ্যাঁ হ্যাঁবেঙ্গলি ফিল্মস্টার দুর্গাদাস মারা গেছেন। আপনাকে ফিউনেরাল প্রসেশনে ডিউটি দেওয়া হলক্রিমেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত পুরোটা দেখতে হবে। সঙ্গে জিপ রাখবেন আর থানা থেকে দশজন কনস্টেবলকে নিয়ে একটা বড় ভ্যান রেডি করে রাখুনতারা আপনার কম্যান্ডে থাকবে।

***

মধ্য কলকাতায় কোনও জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্রের অফিস। সময়টা মধ্যরাত। সম্পাদকের দপ্তরে দশজন লোক মিটিং করছেন একটা বড়সড় চৌকো মেহগনি টেবিলের চারধারে বসে। প্রত্যেকের মুখে একটা করে মুখোশ লাগানো। এদের মিটিং-এ সবাই মুখোশ পরেই থাকেন।


তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছেডানদিকে বসে থাকা জনৈক মুখোশধারী বললেন। 


উল্টোদিকে বসে থাকা আরেকজন উত্তর করলেনসমুদ্র রায়ের লেখা ছায়া দীর্ঘ হয় উপন্যাস আট বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে নির্ভুল বর্ণনা ছিল সেই শত্রুনিধনের মহাডামরীচক্রেরযার ফলে বখতিয়ার খিলজির অপমৃত্যু হয়েছিলএবং গৌড়বঙ্গকে ধ্বংসের পরিকল্পনা সাময়িকভাবে ভেস্তে যায়। সে উপন্যাস পড়ে আমরা নিশ্চিত হইযে আমাদের গুপ্ত তথ্য আর গুপ্ত নেইএবং বহুযুগ ধরে প্রবাদ ও হেঁয়ালিতে পরিণত সেই সরহবজ্রের গুপ্ত পুঁথি নিশ্চিত কেউ খুঁজে পেয়েছেনইলে ওই লেখক এ প্রক্রিয়া এমনভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারত নাতখন আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় এইযুগে বাঙালির মধ্যে কোনও গুপ্তসঙ্ঘ এরকম কোনও তান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেন না চালাতে পারে। আমাদের প্রথম সন্দেহ দাঁড়ায় টি সি গুপ্তার মেয়ে নীলা এবং সমুদ্র রায়ের ওপরে। কিন্তু এরা দুজন যেন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছেবহু সন্ধান করেও এদের কোনও হদিস পাওয়া যায় নি। বাকিটা উমাপতিধর বলুন।


বাকিদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এক লোলচর্ম বৃদ্ধের ওপরে। তার মুখ একটা মুখোশে ঢাকা থাকলেওসর্বাঙ্গ একটা আলখাল্লায় ঢাকা থাকলেও তার দুই হাত কনুই থেকে উন্মুক্ত। সেই হাতদুটি দেখলে চমকে উঠতে হয়তারা অনেক শতাব্দীর পুরোনোসে হাতদুটির চামড়া এমন কুঁচকোনো যে দেখে মনে হয় কোনও জীবন্ত মানুষের হাত ওরকম হতে পারে না।


উমাপতিধরলক্ষ্মণসেনবল্লালসেন এবং বল্লালসেনের পিতা বিজয়সেনের সভাকবিএরপরে বখতিয়ার খিলজির প্রশংসা করেও স্তব লিখেছিল এই ব্যক্তি। এ কি অমরঅমর হলে হাতের চামড়া এরকম লোলচর্ম হয়ে যাবে কেনএ কি মেথুসেলার মত আটশো বছর ধরে বেঁচে আছেযারা গৌড়বঙ্গকে বিদেশী শক্তির হাতে বারবার তুলে দেয়তাদের কি কোনও গুপ্তসমিতি আছে গত আটশো বছর ধরেনাকি এ আরও পুরাতনএ কেএরা কারাএরা বাঙালিকে ধ্বংস করে দিতে এমন বদ্ধপরিকর কেনকি স্বার্থ?


উমাপতিধর থেমে থেমে বলতে শুরু করলেনপঞ্চচক্র আবার প্রস্তুত হচ্ছে দেখে আমরা আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি। মনে হচ্ছিল শিলাবতী আবার ফিরে এসেছেনএই শীলা হালদার মেয়েটিকে দেখে। এদিকে বি এন সরকার চিত্রব্যবসায়ীজ্যোতিপ্রকাশ উড্ডয়ন মন্ত্র জানেনএ যুগের তন্ত্রবিদ্যাব্যবসায়ী। ছবি বিশ্বাস সম্রাট শশাঙ্কের বংশধরযুদ্ধব্যবসায়ী। দুর্গাদাস নটএবং প্রমথেশ বড়ুয়া ভূস্বামী। আমরা ভাবলামএইবার শীলাকে মধ্যস্থলে স্থাপন করলে এই পঞ্চচক্র ভয়ানক শক্তিশালী হয়ে উঠবেআমরা সবাই ছারখার হয়ে যাব। যেভাবে বখতিয়ারকে মেরে ফেলেছিল সেদিনের পঞ্চচক্রএকজন যোদ্ধাএকজন তান্ত্রিকএকজন ভূস্বামীএকজন বণিকএকজন নট। 


ঠিক সেই বিন্যাস আটশো বছর পরে আবার গড়ে উঠতে দেখে আমরা কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি। সন্দেহভাজন সবার বিরুদ্ধেই মারণ উচাটন করলামযাতে সবাই বিনষ্ট হয়। একটু সময় লাগছে ফল ফলতেতবে কয়েকজন ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়েছে। সবথেকে আগে পঞ্চচক্রে যে সাধারণত চালিকাশক্তি হয়সেই নারীকেই বাণ মেরেছিশেষ করেছি। ওদের বাকিরাও বিনষ্ট হবেতাদের কীর্তি নষ্ট হবেবা নিজেরাই অপঘাতে নষ্ট হবে। 


কিন্তু আনন্দের কিছু নেই। উপস্থিত সবাই শুনুনআমাদের অনুমান ভুল ছিল। এরা বাঙালির বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মী বটেকিন্তু পঞ্চচক্র এরা নন।

গোবর্ধন আর্তনাদ করে উঠলেনমানে?

হিসেবে ভুল ছিল। আমরা ভুল করে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলাম এদের ধ্বংস করতেকিন্তু ওদিকে পঞ্চচক্র অন্য কোথাও এই মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছেতার ইঙ্গিত পেয়েছিপ্রমাণ পেয়েছি। তারা কোথায়আমরা জানি নাএবং খুঁজে বের না করতে পারলে এই ঘরে বসে থাকা প্রত্যেকের মহাবিপদকেউই নিগুডাকিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবে না।

সে ঘরের মধ্যে একটা থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এল।

***



তখন মানচিত্র জুড়ে অনেক শ্বাপদের উল্লাস। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রতীরে একটি সুররিয়েল শ্মশানে তখন মড়ক লাগার সাইরেন বেজে চলেছে। তেতাল্লিশ সালের রাক্ষসীবেলাতখন পিশাচ ও পিশাচীরা ভোজ বসিয়েছে আধপোড়া নরমাংসের। তুমি সেই আকর্ষণীয় সময়ে বেঁচে আছদ্বিজেন দাশগুপ্ত। বৃহৎ মানচিত্রের সমান্তরালে তুমি একটি ছোট্টখাট্ট নশ্বর রেখাচারদিকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে তুমি একটুকরো দাহ্যবস্তুতুমি শিগগিরি পুড়ে যাবে। চারদিকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছেএখানে অনেক আহুতি চাইএখানে ইতিহাস পদে পদে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখে দিয়েছেএ পথের দুধারে খাদ। 


আমি সেই হননের প্রান্তরে তোমায় হেঁটে যেতে দেখছিনগণ্য মানুষতুমি জনতার একজন হয়ে হেঁটে যাচ্ছ। আমি তোমায় হেঁটে যেতে দেখছি টালিগঞ্জ থেকে হাজরা। তোমার সঙ্গেতোমার পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে বরিশাল। আমি শুনতে পাচ্ছিসে রাক্ষসীবেলায় দিগন্তে গুম গুম আওয়াজ করছে বরিশাল গানসেই রহস্যময় শব্দ যার কোনও ব্যাখ্যা মেলে নাযার সম্পর্কে আগেকার দিনের লোকে বলতলঙ্কায় বিভীষণের প্রাসাদের দরজা বন্ধ হচ্ছেআর কেউ কেউ বলতপ্রতাপাদিত্য মোগল সেনার সঙ্গে আজও যুদ্ধ করে চলেছেনতার কামান তোপ ফেলছে। আশ্চর্যসমুদ্রের বেশি কাছে গেলে শব্দটা কমে যেত। নলছিটিতে যেমন শোনা যায়পটুয়াখালির সমুদ্রমোহনায় আর সেরকম শোনা যায় না। 


আমি তোমায় হেঁটে যেতে দেখছি ঠাকুরদা। তোমার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছেন বরিশালের সতীন সেন। আমিও তোমার পেছনে হাঁটছিপূর্বমানুষ। দ্যাখো আমায়আমি তোমার ছায়াকে অনুসরণ করে হেঁটে চলেছিপূর্বমানুষ।

এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তুমি ইলেকট্রিক চুল্লীতে ঢুকে যাবেপ্রিয় দ্বিজেন দাশগুপ্ত।

তোমার পিছু পিছু এই পর্যন্তই আসা যায়। এর পরে জীবিতের যাওয়া বারণ।



(তোমার ছায়াপূর্বমানুষ একটি ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস । অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র এবং তথ্য থাকলেও এই কাহিনীর কাঠামোটি সর্বৈব কাল্পনিক। এটি লেখকের আগের বছরের উপন্যাস ছায়া দীর্ঘ হয়-এর ঠিক সিকোয়েল না হলেও,  কাহিনীর একটা যোগসূত্র ও ঘটনাপরম্পরা আছে)

[সপ্তডিঙা কালীপূজা সংখ্যা ২০১৬তে প্রকাশিত]


*******