Monday 7 March 2016

বঙ্কিম কি মুসলমান-বিদ্বেষী ছিলেন? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে


তমাল দাশগুপ্ত




সেই ক্লিশে প্রশ্ন, আবার। বঙ্কিম কি মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন?

বঙ্কিম সম্বন্ধে প্রায়ই বলা হয়, তিনি মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন। এ বক্তব্যটি প্রায় মিথিক্যাল হয়ে গেছে।

অন্য সমস্ত মিথের মতই, এ কথাটা কতটা যথার্থ ইতিহাস, আর কতটা কল্পনা, এই প্রবন্ধে আমরা সেটা খোঁজার চেষ্টা করব। বঙ্কিম উদারমনস্ক ছিলেন, জাতীয়তাবাদী ছিলেন অবশ্যই। তিনি আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্মাতা (বন্দে মাতরম বঙ্গমাতার উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল; সপ্ত কোটি কণ্ঠ নয়ত লিখতেন না)। তাঁর অসামান্য অবদান আছে বাংলার হিন্দু পুনর্জাগরণ বা হিন্দু রিভাইভালে। তবে প্রশ্ন হল, তিনি সঙ্কীর্ণভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি কোনও বিদ্বেষ পোষণ করতেন কি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অনেকগুলো ডাইমেনশন চলে আসে। যে জায়গাগুলোকে সাধারণভাবে মুসলিম বিদ্বেষ হিসেবের নজির হিসেবে দেখা যায়, সেগুলোর যথাযথ বিচার করলে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, আসলে তিনি বহিরাগত আগ্রাসনের বিরোধিতা করছেন। বাংলার দেশজ মুসলমানের প্রতি নয়, বঙ্কিম বিরোধিতা করছেন তুর্কি আর মোগল আগ্রাসনের, বহিরাগত শাসকের। যে কোনও আগ্রাসনের বিরোধিতা করা, বিদেশী-বিজাতীয় শাসকের বিরোধিতা করাটা সৎ জাতীয়তাবাদীর কাজ, তাই তিনি করেছেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনও বিশ্বমানবিক ভণ্ডামি ছিল না। বিস্তারিতভাবে এই প্রসঙ্গে আমরা আসব। প্রশ্ন হল, এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করার জন্য তাকে সাধারণভাবে মুসলমান বিদ্বেষী বলা যায় কি?

এখানে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে। সাহিত্যের আলোচনায় এই কি বিবেচ্য হবে যে সে সাহিত্যে কোনওপ্রকার বিদ্বেষ আছে কি নেই? এটা কি মাপকাঠি হতে পারে সাহিত্যগুণের, যে সাহিত্যকে হতে হবে পলিটিক্যালি কারেক্ট? বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থে রেজাউল করীম বলছেনঃ

তুমি কাহাকে আক্রমণ করিয়াছ, কাহার বিরুদ্ধে লেখনী চালনা করিয়াছ, তাহা দেখিবার বিষয় নহে। সেই আক্রমণের মধ্যে তুমি রসসৃষ্টি করিতে পারিয়াছ কি না, তাহাই দেখিতে হইবে। ... ঠিক এইভাবে বঙ্কিম- সাহিত্যকে আলোচনা করিতে হইবে। বঙ্কিমচন্দ্র কতকগুলি নবাব-বাদশাহ্‌ সম্বন্ধে কি কথা বলিয়াছেন, তাহা বড় কথা নয়, তাহা মোটেই ধর্ত্তব্যের বিষয় নহে। তিনি রসসৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন কি না, কেবল তাহাই দেখিতে হইবে; যদি পারিয়া থাকেন, তবে তিনি প্রত্যেক যুগের সাহিত্য-রসিকের নিকট চির- আদরণীয়, চির-বরণীয় হইয়া রহিবেন। (১৬-১৭)


যুক্তিটি সাহিত্য সমালোচকদের কাছে সুপরিচিত। এই যুক্তির উৎস “আর্ট ফর আর্টস সেক” তত্ত্বে। শিল্পকলাকে শুধু শৈল্পিক মাপকাঠিতেই বিচার করতে হবে, সেখানে এই জাতীয় বিষয় গৌণ। কিন্তু এখানে তিনটি সমস্যাজনক প্রশ্ন চলে আসে, যেগুলো নিয়ে রেজাউল সচেতন নন।

এক, বঙ্কিম যেগুলো বলছেন, সেগুলো কি ভুল? এইসব নবাব-বাদশাহ্‌ নিয়ে যা যা বলেছেন, সেগুলো বলে বঙ্কিম কি অন্যায় করেছেন? এইসব নবাব-বাদশাহ্‌দের কি হিন্দুবিদ্বেষ ছিল? তারা কি অত্যাচারী ছিলেন এ দেশের মানুষদের প্রতি? তারা কি বহিরাগত, বিদেশী শাসক হিসেবে এ দেশের মানুষ ও এ দেশের সংস্কৃতির প্রতি হোস্টাইল থেকেছেন? যদি থেকে থাকেন, সেক্ষেত্রে বঙ্কিমের পক্ষে তাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়াটা কতটা অন্যায় হয়েছে?

দুই, বঙ্কিমের সাহিত্যের রাজনৈতিক ব্যবহার বহুলভাবে হয়েছে। কোনও বিমূর্ত শৈল্পিক আলোচনা হতে পারে বন্দেমাতরমকে নিয়ে, তার ইনটেন্‌স্‌ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে এড়িয়ে? বস্তুতঃ, কোনও সাহিত্যই কি রাজনীতি বিচ্যুত? এভাবে সাহিত্যের সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কনটেক্সট এড়িয়ে গিয়ে কেবল রসের আলোচনা এমনিতেও সাহিত্যচর্চায় বহুদিন যাবৎ বাতিল হয়ে গেছে। অতএব, এই যুক্তিটি ব্যবহার করা আমাদের পক্ষে আজকে কতটা যুক্তিযুক্ত?

এবং, তিন, এভাবে কি রেজাউল প্রকারান্তরে বঙ্কিমের লেখায় মুসলমান বিদ্বেষ আছে, সেটা স্বীকার করে নিলেন? যদি নিলেন, তাহলে আলোচনা ফুরোয়, তাহলে আর তিনি লিগপন্থীদের আনন্দমঠ পোড়ানোর বিরোধিতা করবেন কিভাবে? বিরোধিতা যদি শুধু রসের যুক্তিতে করেন, সে বিরোধিতা বলা বাহুল্য জোরদার নয়, এবং মুষ্টিমেয় সাহিত্যরসিকের বাইরে সে যুক্তিতে কেউ কর্ণপাত করবে না। বস্তুত সাহিত্যরসিকদের মধ্যেও ওই রসের যুক্তিতে আনন্দমঠের সর্বজনগ্রাহ্য কোনও পাঠ নেই। বঙ্কিমের এই উপন্যাসটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক মূল্যায়ন কিন্তু খুব একটা উঁচু ছিল না, তিনি এটিকে প্রচারধর্মীই মনে করেছিলেন, চরিত্রগুলো খুব একটা খোলতাই হয়নি, তারা রক্তমাংস পায়নি, স্রেফ একটা আদর্শের ধারক বাহক হয়েই থেকে গেছে, এরকমটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের মত। রবীন্দ্রনাথের এই মতের বিস্তারিত সমালোচনা বর্তমান প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই মতামত উদ্ভূত হচ্ছে পশ্চিমী ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে। আনন্দমঠ একদল সঙ্ঘবদ্ধ বিপ্লবীর কথা বলছে, অর্থাৎ এখানে সমষ্টি ব্যক্তির ওপরে স্থান পাচ্ছে। সেরকমটা না হলে কোনও পরাধীন দেশে স্বাধীনতার লড়াই করা সম্ভবপর নয়। এখানে ইতিহাস ও রাজনীতির কষ্টিপাথরে সাহিত্যকে যাচাই করার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিনির্ভর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গত কারণেই সমষ্টিনর্ভর আনন্দমঠ ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু তার মানে এই না যে সাহিত্যের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত মতামতই আনন্দমঠকে খরচের খাতায় লিখে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমরা দেখি, রেজাউল কিন্তু এই প্রবলেম্যাটিকস্‌ নিয়ে একদমই ভাবছেন না। তার এই বিষয়ে একটা সরলীকরণ আছে, সেটা তার বক্তব্যকে দুর্বল করেছে। বঙ্কিম হলেন রসস্রষ্টা, স্রেফ এই যুক্তিতে একদল উন্মত্ত বন্দেমাতরম-বিদ্বেষী, বঙ্কিম-বিদ্বেষীকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না, আজও সম্ভব নয়। রেজাউল এক অর্থে প্রতিপক্ষের কাছে পরাজয় স্বীকার করেই বসে আছেনঃ “বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম-বিদ্বেষ আছে! থাকিলই বা, তাহাতে কি আসিয়া যায়? তাহা অতি সামান্য বিষয়। রুশো, ভল্‌টেয়ারকে যেমন আমরা ক্ষমা করিয়াছি, বঙ্কিমকেও সেইরূপ ক্ষমা করিতে হইবে। কারণ বঙ্কিম-সাহিত্যের চারিদিকে হীরা জহরৎ এমনভাবে ছড়াইয়া আছে যে, তাহার প্রলোভনে সামান্য একটু কাদাময়লাকে ভয় করিলে চলিবে না” (১৭)।

বঙ্কিমে কাদাময়লা আছে, এই কথা বলে ফেলার পরে রেজাউল যদি আশা করেন তার সওয়াল জবাবে খুব একটা কাজ দেবে, তাহলে তাঁর সারল্যের প্রশংসাই করতে হয়। কিন্তু তাহলে সত্যিই কি বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলমান বিদ্বেষের “কাদাময়লা” আছে?

এই জাতীয় আরেকটা বক্তব্য রেখেছেন রেজাউল, এইবার আনন্দমঠের অন্তর্ভুক্ত বন্দেমাতরম সঙ্গীতের জাতীয় আন্দোলনের প্রতীকী স্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রসঙ্গেঃ “পারস্যের অমর কবি হাফেজ যখন তাঁহার অমর গ্রন্থের প্রথম একটি লাইন পাপাত্মা এসিজের কবিতা হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন অনেকেই তাহাতে রাগান্বিত হন। তদুত্তরে কবি বলেন, মুক্তা কুড়াইয়া লইতে হইলে স্থানের বিচার করিতে হয় না। আমরা 'বন্দেমাতরম' সঙ্গীত সম্বন্ধেও সেই কথাই বলিতে পারি” (৬২)। মুক্তো যত্রতত্র থেকে কুড়িয়ে নিতে হবে, এটা এক লুণ্ঠক সভ্যতার আদর্শ মোটো হতেই পারে। কিন্তু বঙ্কিমের আনন্দমঠের সঙ্গে পাপাত্মা এজিদের তুলনা করে রেজাউল কাদের খুশি করতে চাইছিলেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না। রেজাউল এভাবে আলগোছে বঙ্কিমের নিন্দা করে কাদের মন পেতে চাইছেন, কাদের তোষণ করছেন, সেটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। তিনি বন্দেমাতরমকে ডিফেণ্ড করছেন শুধুমাত্র “অন্তর্নিহিত মাধুর্য্যের কারণে” (৬৩)। সেটাও অত্যন্ত ব্যতিক্রমী, যখন আমরা মনে রাখি যে বঙ্কিম, আনন্দমঠ, বন্দেমাতরম এগুলোর প্রতি একটা নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা এসেছে মুসলমানদের মধ্য থেকে, বাংলার ভেতরে ও বাইরে।

রেজাউল কিন্তু এখানে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। সেটা হল, মুসলমান শাসক, মুসলমান নবাব-বাদশাহ্‌দের বিরুদ্ধে লিখলে সেটাকে কোনও মতেই ইসলাম বিরোধিতা বলা যায় না।

কেহ কি দেখাইতে পারিবেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার সমগ্র গ্রন্থে কোথাও ইস্‌লাম ধর্ম্মকে আক্রমণ করিয়াছেন? ইস্‌লামের শিক্ষা, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্ম্মগ্রন্থ – এ সকলকে কি তিনি কোথাও আক্রমণ করিয়াছেন? হজরত মহম্মদের প্রতি কি তিনি কোথাও অশ্রদ্ধার ভাব দেখাইয়াছেন? ইস্‌লামের রীতিনীতি, সৌন্দর্য্য প্রভৃতির প্রতি তিনি কি ব্যঙ্গোক্তি করিয়াছেন? তাহা যদি না করিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে ইস্‌লাম বিদ্বেষী অথবা মুসলমানের শত্রু মনে করিবার কোন কারণই থাকিতে পারে না। তিনি যদি কাহাকেও আক্রমণও করিয়া থাকেন, তবে তাহারা ত এক-একজন ব্যক্তি। ভারতে মুসলমান নৃপতিদের কয়েকজন, তাঁহাদের শাসন-পদ্ধতির কয়েকটি নীতি, সেনা-বিভাগের কয়েকজন কর্ম্মচারী, অথবা নবাব-বাদশাহ্‌দের কুমার-কুমারী - ইহারাই তাঁহার আক্রমণের বিষয়। ইহাদিগকে লইয়া কি সমস্ত ইস্‌লামের কাঠামো রচিত যে, ইহাদের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ মন্তব্য প্রকাশ করিলেই লেখককে ইস্‌লাম-বিরোধী বলিতে হইবে? (১৮)

রেজাউলের যুক্তি এক্ষেত্রে অকাট্য, যদিও বেশ ইন্টারেস্টিংভাবে এবার আর রসের যুক্তির অবতারণা করা হচ্ছে না। অর্থাৎ ইসলামের সমালোচনা বঙ্কিম যদি সত্যিই করে থাকতেন, তাহলে সম্ভবত রেজাউলও রসের কথা বলে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ড করতেন না। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, সত্যিই বঙ্কিমের কোনও লেখায়, কোথাও ইসলাম বিদ্বেষের বিন্দুমাত্র নমুনা নেই। আনন্দমঠ বা বঙ্কিমের অন্য যে কোনও লেখার বিরুদ্ধেই ইসলাম বিদ্বেষের অভিযোগ আনা যায় না।

দ্বিতীয় একটা কথা বলছেন রেজাউল, যে মুসলমানদের প্রতি বঙ্কিমের কোনও “ব্যক্তিগত আক্রোশ” ছিল না (১৮)। আমরা এই প্রবন্ধে দেখব, এ কথাটাও সত্যি, এবং এর প্রমাণ আছে। রেজাউল আরেকটা কথা বলছেনঃ বন্দে মাতরম সঙ্গীতটি হিন্দুয়ানি প্রচারের জন্য নয়, দেশভক্তি প্রচারের জন্য লেখা। রেজাউল একজন মুসলমান হিসেবে লিখছেন যে তিনি দেশের বন্দনা করাকে পৌত্তলিকতা বলার বিরোধী : “'বন্দেমাতরমে' কোনও দেবদেবীর পূজাও করা হয় নাই, অথবা তাহাদের স্তব-স্তূতিও করা হয় নাই। উহাতে দেশমাতৃকার বন্দনা করা হইয়াছে মাত্র। ... ইহা ইস্‌লামের দৃষ্টিতে আদৌ নিন্দনীয় নহে” (৬২)।

সমস্যা হল, ইসলামে শির্ক্‌ বিষয়টা সহ্য করা হয় না (হয়ত আরও বেশ কিছু জিনিস সহ্য করা হয় না)। বন্দেমাতরমে শির্ক্‌ আছে, এটা একটা বড় অভিযোগ। করীম সরাসরি শির্কের উল্লেখ করেন নি, কিন্তু বিষয়টা ছুঁয়েছেন। বিষয়টা মোটামুটি এরকমঃ হিন্দুধর্মে বহুত্ববাদ স্বীকৃত, অনেকের পূজা করা যায়, না-ও করা যায়। কিন্তু ইসলামে আল্লা ছাড়া অন্য কারও পূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লার সঙ্গে অন্য কোনও দেব-দেবীর পুজো করাকে বলা হয় শির্ক্‌।

মুসলমানকে বিশ্বের সর্বত্রই কেবল যদি আরবী ভাষা ব্যবহার করিতে হইত, তাহা হইলে শব্দ নির্ব্বাচনে এইরূপ কড়াকড়ি নিয়ম পালন করা সম্ভব হইত। কিন্তু বিভিন্ন দেশে গিয়া সে যখন তত্রত্য ভাষাকে নিজের ভাষা বলিয়া গ্রহণ করিল, তখন ... মুসলমানকে ভাষার সেই দেশ-প্রচলিত বিধি মানিয়া চলিতে হইবে। উদাহরণস্বরূপ একটি শব্দের উল্লেখ করিতেছি। 'পূজা' কথাটা বাংলা ভাষায় নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। ... কিন্তু আরবী ভাষায় ঈশ্বর বা খোদাতালাকে পূজা করার অর্থে একটা বিশেষ শব্দ আছে, যাহা অন্য কাহারও জন্য ব্যবহৃত হয় না - সে শব্দটা হইতেছে 'এবাদত্‌'। কোনও মানুষের 'এবাদত্‌' করা হয় না, 'এবাদত্‌' কেবল খোদার জন্য। প্রত্যেক হিন্দু সন্তান জানে যে, ঈশ্বরপূজা, দুর্গাপূজা, দেশপূজা, আর পিতৃপূজা এক বস্তু নয়, বা এক অর্থে ব্যবহৃত শব্দ নয়। এখানে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। প্রত্যেক ইংরাজ সন্তান জানে যে, ঈশ্বরকে worship, আর রাজাকে worship এক বিষয় নহে। ফারসী ভাষায় বন্দেগী শব্দটাও ঠিক এই ধরণের। মুসলমান যখন বাংলা, ইংরাজী প্রভৃতি ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে, তখন সেই সব ভাষার বিধি-নিষেধ ও দোষগুণ সবই তাহাকে মানিতে
হবে। … মাতাপিতা ও গুরুজনের পূজা কর – একথা যেমন সে ব্যবহার করিতে পারে, সেইরূপ ঈশ্বরের বা খোদাতালার পূজা কর, ইহাও তাহাকে বলিতে হইবে। এরূপ করিলে ইস্‌লামের দৃষ্টিতে সে পাপী বলিয়া বিবেচিত হইবে না। (৬৯)

এই যুক্তি অকাট্য নয়, কারণ হিন্দুধর্মের বহুপূজক বা পলিথেইস্ট চরিত্রটি করীম সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন। বস্তুত, গুরু বা মাতাপিতাকে দেবতার মর্যাদা সরাসরি দেওয়া হয়ে থাকে। এবং দেবত্ব ওরকম কঠিন কঠোর বেড়াজালে আবদ্ধ নয় এই দেশের সংস্কৃতিতে, “প্রিয়েরে দেবতা করি, দেবতারে প্রিয়” হল আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। দেশমাতৃকার অবশ্যই দেবীজ্ঞানে পুজো হচ্ছে, এবং বঙ্কিম কোনও 'সাম্প্রদায়িক' অন্যায় করেন নি, তিনি এই প্রকৃতিপূজক দেশের আদি ঐতিহ্যকে সেলিব্রেট করেছেন, তার জন্য তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হলে বড় অপমানজনক হয়। এই ভূমিতে মাতৃপূজার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, এর শেকড় সাংখ্যের পুরুষ প্রকৃতি দ্বৈতবাদে। যাই হোক, করীমও বলছেন, এ দেশের ভাষা (ধরে নিতে দোষ নেই যে ফরম্যালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে মাতৃপূজা একটি ভাষা বা রেজিস্টার) গ্রহণ করতে হবে মুসলমানকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন জাগে। করীম বলছেন যে মুসলমান যেখানকার অধিবাসী, তাকে সেই দেশের ভাষা গ্রহণ করতে হবে। এখন যদি কেউ একধাপ এগিয়ে বলেন, যে সেখানকার সংস্কৃতিও গ্রহণ করতে হবে (কারণ একটি জাতির সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হয় একটি জাতির ভাষাকে গ্রহণ করতে গেলে, যেমন ইংল্যাণ্ডে বসে ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করতে গেলে ইংরেজি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হবে, নয়ত সে ভাষাটির সঠিক প্রয়োগ করাই যাবে না), তাহলে যে সমস্যার উৎপত্তি হবে, সেটাই তো ওয়াহাবি বা ফারাজি আন্দোলনের উত্থানের কারণ। অর্থাৎ ইসলাম আর বিশুদ্ধ থাকছে না, অতএব ইসলামের চ্যাম্পিয়ন ওয়াহাবি আবির্ভূত হচ্ছে, সমস্ত কাফের মিশ্রণ ও অশুদ্ধতা থেকে ইসলামের রক্ষার্থে। করীম এই জটিলতায় যান নি। কিন্তু একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন। বন্দেমাতরম সঙ্গীতের সেযুগে প্রধান বিরোধী, মৌলানা আকরম খাঁ, যিনি সম্ভবত দেশকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করাকে কাফিরি প্রথা বলে নিন্দামন্দ করে থাকতেন, সেই ব্যক্তি নিজেই তার একখানা কাব্যগ্রন্থ, 'মোস্তাফা চরিত'-এ লিখেছেন “ধরিয়াছ বক্ষে মাগো, কার পদলেখা/ হে আরব, মানবের আদি মাতৃভূমি” (করীম ৭০)। অর্থাৎ আরব দেশকে মাতৃজ্ঞানে পুজো চলতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, কোন ধরণের মানসিকতা কাজ করেছে বন্দেমাতরমের বিরোধিতায়।

আমাদের বিষয়ে আবার ফিরি। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তকে যিনি সমদৃষ্টিতে দেখেন, তিনি আনন্দমঠে কেন "ভাই, ইংরাজ ভাঙিতেছে, এস আক্রমণ করি" পালটে "ভাই, নেড়ে ভাঙিতেছে, এস আক্রমণ করি" লিখেছিলেন, সেই ইতিহাসও মোটামুটিভাবে আমাদের জানা আছে। যখন রেজাউল করীম ওঁর বইটি লেখেন, তখনও সেটা দেখা যাচ্ছে কমন নলেজ ছিল, তাই রেজাউল বলছেনঃ “ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কথিত বাক্যগুলি বাহিরের আবরণ মাত্র – আইনের বেড়া-জাল হইতে পুস্তকটিকে বাঁচাইবার কৌশল মাত্র” (৪৯)। এছাড়া, স্বদেশপ্রীতি বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সরাসরি ইংরেজবিরোধিতার মাধ্যমে প্রচারিত হওয়া ছিল বেশ কঠিন, রেজাউল সেটাও আমাদের মনে করাচ্ছেনঃ  পাঠকগণের হয়ত স্মরণ আছে যে, বহুদিন পর্য্যন্ত স্বর্গীয় গিরীশচন্দ্র ঘোষের সুপ্রসিদ্ধ নাটক 'সিরাজদ্দৌলার' অভিনয় বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। স্বর্গীয় সখারাম গণেশ দেউস্করের 'দেশের কথা' বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। এই সেদিন পর্য্যন্ত শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' নিষিদ্ধ পুস্তকের মধ্যে গণ্য হইয়াছিল। এই সব কারণে একটু বুদ্ধিমান লেখকগণ এমন কৌশলে গ্রন্থ রচনা করিতেন যে তাহা সহজে আইনের ধারায় পড়িত না। স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'মেবার পতন', দুর্গাদাস', 'প্রতাপসিংহ' এই শ্রেণীর গ্রন্থ। বঙ্কিমের লেখাও এই ধরণের ছিল। এই সব লেখক সাক্ষাৎভাবে আক্রমণ করিতেন মুসলিম যুগের অনাচারকে। সেই অনাচারের বিরুদ্ধে যাহারা লড়িত, তাহাদিগকেই “হিরো” করিয়া সমগ্র গ্রন্থ রচিত হইত। কিন্তু ইহাদের অন্তর্নিহিত ভাব ছিল স্বদেশপ্রীতির আদর্শ। (৩৪)

এ বক্তব্য সারযুক্ত, যদিও বঙ্কিমের সঙ্গে তাঁর অনেক পরে আবির্ভূত সাহিত্যিক নাট্যকারদের তুলনা করা উচিত নয়, বঙ্কিমের সময়টা অন্যরকম ছিল, ইংরেজের প্রকাশ্য সমালোচনা বা স্বাধীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা প্রায় অসম্ভব ছিল বলা যায়। কিন্তু বঙ্কিম সাক্ষাৎ ভাবে ইংরেজকে কিছু আক্রমণ করেছিলেন আনন্দমঠের প্রথম সংস্করণে, আমরা জানি। তাই আনন্দমঠ লেখার অব্যবহিত পরেই বঙ্কিমকে কলকাতা থেকে কটকে বদলি করে দেওয়া হয়, এবং এ ছিল ইংরেজের “অসন্তোষের” ফল, অমিত্রসূদন বলছেন বঙ্কিমচন্দ্রজীবনীতে (৬১৫)।

রেজাউল কিন্তু সেই অর্থে বঙ্কিমের আদর্শে দীক্ষিত, বা অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। তার বইতে একজায়গায় তিনি লিখছেনঃ “আজ রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী এবং জওহরলালকে দেখিয়া মনে হইতেছে, বঙ্কিমচন্দ্র কেন সেরূপ হন নাই?” (৩৫)। যখন দেখি এই বাক্য রচিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে, যেসময়ে সারা বাংলার সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষ এক হয়েছিল সুভাষের পেছনে, এবং সুভাষ কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন যেটা বোঝা যায়, রেজাউল বঙ্কিম সাহিত্যের একজন অনুরাগী এবং কংগ্রেসের সমর্থক হলেও বঙ্কিমের আদর্শের প্রতি সেভাবে সহমর্মী ছিলেন না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলার মুসলমান লেখকদের মধ্যে আজ পর্যন্ত আবির্ভূত বঙ্কিমের সবথেকে বড় সমর্থকও বঙ্কিমের আদর্শ সম্পূর্ণ গ্রহণ করেন নি। কোথাও একটা সমস্যা আছে, কিন্তু সে সমস্যার জন্য বঙ্কিম দায়ী নন সম্ভবত।

আমরা এখন জানি যে বঙ্কিম এই উপন্যাসটি লিখে রাজরোষে পড়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উৎস সন্ধানে বইটি আমাদের এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছে। এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে একাধিক জায়গায় ইংরেজবিরোধিতা আছে বলেই তদানীন্তন ইংরেজ শাসক মনে করেছিল। এবং চিত্তরঞ্জন বলছেন, মারাঠি স্বাধীনতা সংগ্রামী বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের জীবন সম্পর্কে অবহিত হয়েই বঙ্কিম সন্তানদলের আদর্শটি অঙ্কন করেছিলেন, বস্তুত এটাই চিত্তরঞ্জনের বইটির প্রধান বক্তব্য। বঙ্কিমের চাকরি জীবন এই উপন্যাস লেখার ফলে পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং তাকে কেশব সেনের কাছে ছুটতে হয়েছিল (কেশব সেন ইংরেজদের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন, যেটা ইংরেজের চাকরি করেও বঙ্কিম কখনও হতে পারেন নি) এই মর্মে শংসাপত্র যোগাড় করতে যে উপন্যাসটি সত্যি সত্যি ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়ে লিখিত নয়। শেষে কেশবের ভাই কৃষ্ণবিহারী সেন আনন্দমঠের প্রশংসামূলক একখানা রিভিউ করেন, এবং তাতে ইংরেজবিদ্বেষ নেই এই মর্মে সার্টিফিকেট দেন। তাই বঙ্কিম যখন রামকৃষ্ণের পরিহাস “বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভারে বাঁকা গো?” -এর উত্তরে বলেন “ইংরেজের জুতোর চোটে” (ভট্টাচার্য প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৩৪০-১), তার মর্মার্থ আমরা আনন্দমঠের প্রেক্ষিতে যেভাবে ফুটে উঠতে দেখি, অন্য কোনও উপন্যাসে সম্ভবত এতটা হয়নি। উপন্যাসটি পরবর্তী সংস্করণগুলি বিদেশী শাসকের জুতোর চোটে বেঁকে গেছে। এই উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম চাকরি জীবনে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তার ডিমোশন ঘটেছে (অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ হারিয়েছিলেন), এবং প্রচুর তিক্ততা নিয়ে চাকরি থেকে সময়ের আগেই অবসর নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বঙ্কিম নাকি এই উপন্যাসের সমাপ্তিতে ইংরেজের প্রতি রাজভক্তি দেখিয়েছেন, এ জাতীয় একটা কথা হাল্কা করে বাজারে চালু করেছেন কেউ কেউ। সপ্তডিঙা সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা বঙ্কিমকে বাঙালির বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে তুলে ধরেছি, এবং সেই জাতীয়তাবাদকে পোজিট করেছি বাঙালির মধ্যে দীর্ঘ কম্প্রাদর আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তখন কফি হাউস থেকে কিছু তাচ্ছিল্য শোনা গেছে, বঙ্কিম নিজেই তো কমপ্রাদর। ইংরেজের চাকরি করতেন। আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ আনুগত্য দেখিয়েছেন। এইরকমভাবেই নানা কুযুক্তি বঙ্কিমের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় (অর্থাৎ রামে না মারলেও রাবণে মারবে। মুসলমান বিদ্বেষ না থাকলে ইংরেজ আনুগত্য খুঁজে পাবেন এরা)।

মজার কথা হল, যে যুক্তিতে আনন্দমঠের শেষে ইংরেজের জয় দেখানো আছে বলে ওটি ইংরেজ অনুগত টেক্সট হয়ে যায়, ওই একই যুক্তিতে সীতারামের শেষে মোগলের জয় দেখানো হয়েছে বলে সেটিকে মুসলমান অনুগত টেক্সট বলা যায়। আসলে এই যুক্তিতে যেটা ধরা নেই সেটা হল ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসে শেষটা কিরকম হবে সে ব্যাপারে ঔপন্যাসিকের হাত আগে থেকেই বাঁধা আছে, এক যদি না তিনি ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতীয় কিছু একটা ডিভাইস ব্যবহার করেন। বঙ্কিমের সময়ে মধ্যগগনে ভিক্টোরিয়ান ধ্রুপদী রিয়েলিস্ট চিন্তাভাবনার সূর্য, সেযুগে ওইজাতীয় কিছু দেখানো সম্ভব ছিল না, যে এক অদ্ভুত ম্যাজিকের মাধ্যমে ইতিহাসই বদলে গেছে, এবং ভারতে ইংরেজ রাজত্বের বদলে সন্তান রাজত্বের স্থাপনা হয়েছে। আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ জিতে যায়, কারণ ইতিহাসেও তারাই জিতেছিল।

হ্যাঁ, বঙ্কিম ইংরেজের চাকরি করতেন। কিন্তু এটাকে কনটেক্সটের বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখাটা অত্যন্ত হাস্যকর। সেযুগে তার মত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। এবং এ দেশের ভাগ্য যে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও স্বদেশের টানে ধরা দিয়েছিলেন। বস্তুত, শিক্ষিত বাঙালিকে সে যুগে অ্যাড্রেস করতে গেলে বঙ্কিমের মত প্রতিভারই প্রয়োজন ছিল, যিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দুটি সভ্যতাকেই অধ্যয়ন করেছেন। ফলেন পরিচয়তে বলে একটা কথা আছে। বঙ্কিম কমপ্রাদর কি না, সে তার লেখা পড়লে, আর তার সাহিত্যের ফলাফল হিসেবে বিপ্লবী আন্দোলনের উত্থান বিচার করলেই জানা যাবে। বঙ্কিমের সমস্ত লেখা পড়ার পরে নিতান্তই গুণ্ডামি আর গা-জোয়ারি প্রয়োজন এ কথা বলার জন্য যে তিনি কম্প্রাদর ছিলেন। বরং ইংরেজের চাকরি করে বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর কাজটা কি অসামান্য কঠিন ছিল, তার লেখকজীবন সেটারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

শেকসপিয়ারের লেখায় ইহুদী বিদ্বেষ পাওয়া যায় (মার্চেন্ট অভ ভেনিস, অবশ্য ইহুদীদের প্রতি সহানুভূতিও পাওয়া যায় ওই লেখাতেই), কিন্তু সেজন্য তার মুণ্ডুপাত করা হয় না, তার লেখাও জ্বালানো হয় নি। ইউরোপের বিখ্যাত লেখক এজরা পাউন্ড বা নুট হামসুন নাজি সিমপ্যাথাইজার ছিলেন। সেজন্য এদের লেখার বাপান্ত করা হয় না, বা তাদেরকে সাহিত্যসভা থেকে ঠেলে বের করে দেওয়ার অভিনব প্রস্তাব বিবেচিত হয় না পশ্চিমে।

বঙ্কিম নাজি নন, ফ্যাসিস্ট নন। বঙ্কিমের চিন্তাভাবনা উদার, যুক্তির আস্তরণ তাঁর লেখার পরতে পরতে। বঙ্কিম নেহাতই বাঙালি জাতীয়তাবাদী, কিন্তু সেটুকুও, দুর্ভাগ্য এই জাতির, সেটুকু সহ্য করাও আমাদের লেফট লিবেরালদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যিনি বাঙালি আত্মপরিচয়ের হোতা, তাকেই এরা একযোগে উচ্ছেদ করতে ব্রতী হন।

তবে এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, চিরাচরিতভাবেই রাবীন্দ্রিক। সাহিত্য থেকে লেখকের ব্যক্তিগত পছন্দকে নির্বাসন দেওয়া যায় না, বলছেন রবীন্দ্রনাথঃ “বঙ্কিমবাবুর মতো লেখকের গ্রন্থে মুসলমান বিদ্বেষের পরিচয় পাইলে দুঃখিত হইতে হয়, কিন্তু সাহিত্য হইতে ব্যক্তিগত সংস্কার সম্পূর্ণ দূর করা অসম্ভব। থ্যাকারের গ্রন্থে ফরাসি-বিদ্বেষ পদে পদে দেখা যায়, কিন্তু ইংরেজ সাহিত্যপ্রিয় ফরাসি পাঠক থ্যাকারের গ্রন্থকে নির্বাসিত করতে পারেন না। আইরিশদের প্রতি ইংরাজের বিরাগ অনেক ইংরাজ সুলেখকের গ্রন্থে পরিস্ফুট হইয়া উঠে” (অলোক রায় ১৮৫)। কিন্তু লেখকের বক্তব্যগুলো যে নিছক, নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থেকে উদ্ভূত, সেটা বলাটা অত্যন্ত অনৈতিহাসিক। লেখক হাওয়ায় বিচরণ করেন না। মজার ব্যাপার হল, এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আমাদের পশ্চিমবাংলায় আজও চলেছে বামপন্থার নামে। ফলে ব্যক্তি বঙ্কিমের মুণ্ডুপাত করেন দেবেশ রায়, বঙ্কিম সৃষ্ট সাহিত্য কেন সাবলীল লৌকিক নয়, কেন তা পশ্চিমী প্রভাব বহন করে, এই তার অভিযোগ। বঙ্কিমের ওপরে ভিক্টোরীয়, পশ্চিমী প্রভাব নিয়ে মূলত এই সমালোচনা। দেবেশ রায় বলছেনঃ “বাংলা উপন্যাসে সঞ্চারিত হয়নি লোকায়তের পৌরুষ, বাংলা উপন্যাসের কাহিনীতে আসেনি পুরাণ বা মিথ ভাষার লোকায়তিক পেশি, বাংলা উপন্যাসের সংলাপে আসেনি আমাদের প্রতি ক্রোশে আলাদা উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও ব্যঙ্গশেষরসিকতার মান” (অলোক রায় ১৮৮)। সে যুগে সাবলীল লৌকিক আর্ট ফর্ম কবিগান নিয়ে কাজ করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত, তিনি শেষ খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন, বঙ্কিম বলছেন। খাঁটি বাঙালি কবি আর জন্মাতে পারে না যে যুগে, সেই যুগের লেখক বঙ্কিম লৌকিক আর্ট ফর্ম নিয়ে কাজ করবেন কি ভাবে? বলা দরকার, দেবেশ রায়ের এই যে সমালোচনা, এও নেহাতই ব্যক্তির হুইম থেকে উদ্ভূত, এর পেছনে কোনও ইতিহাস পাঠ কাজ করছে না, এ হল 'দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা' ধরণের সমালোচনা। এইজাতীয় বঙ্কিম সমালোচনা সুনীলও করেছেন।

১৯৭৮ সালে দেশ পত্রিকায় বঙ্কিমউপন্যাস পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সুনীল ব্যক্ত করেছিলেন পর পর কয়েকটি সংখ্যায়। সুনীলের মনে হয়েছিল বঙ্কিমের কয়েকটি উপন্যাস নিছক মনোরঞ্জক, বাকিগুলি প্রচারধর্মিতায় ইতোভ্রষ্ট স্ততো নষ্টঃ ন পূর্বং ন পর। দুর্গেশনন্দিনী রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়, কপালকুণ্ডলায় মতিবিবির কাণ্ডকারখানা রোমাঞ্চকর, সেই সঙ্গে বিরক্তিকরও বটে - 'এটি অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যর্থ বই।' বঙ্কিমের উপন্যাসে লেখকের অভিজ্ঞতা ও সমকাল চেতনা নেই, এটাও অভিযোগের কারণ। 'বঙ্কিমের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করছি' এমন অভিযোগে দেশ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক লেখাটি মাঝপথে বন্ধ করে দেন। (অলোক রায় ১৮৮)

আসলে বঙ্কিমকে খুন না করলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্দেমাতরমের অবদান মোছা যায় না, অগ্নিযুগকে স্মৃতি থেকে উপড়ে ফেলা যায় না। বন্দেমাতরম গানটি স্বাধীন ভারতের অ্যাডিশনাল জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে (এ এক অপূর্ব স্টেটাস)। জন গণ মন গানটির সঙ্গে তার একটা চিত্তাকর্ষক তুলনা করেছেন (সম্ভবত ইচ্ছাপূর্বক নয়, আনকনশাস ভাবেই করেছেন) অমিত্রসূদনঃ

দেশের কোনো কোনো প্রান্ত থেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে কখনো-কখনো ভুল বোঝার ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। সেটা দুর্ভাগ্যের। … যে বন্দেমাতরম্‌ সঙ্গীত সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে তো দেশজননী দেশমাতৃকার বন্দনা। ভারতের ভাগ্যবিধাতা কে তা আমি জানি না; আমার মা-কে আমি জানি - আমার জন্মভূমিই আমার মাতৃভূমি - সন্তানের কাছে মায়ের চেয়ে বড়ো কে? ভারতবর্ষের প্রতিটি সন্তানের জননীই তো ভারতমাতা। আমার মা-ই আমাদের দেশ, আমার দেশই আমার মা। (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৪৫৪)

অনস্বীকার্য, বন্দে মাতরম সঙ্গীতে একটা ধরা যায় ছোঁয়া যায় এরকম দেশপ্রেমের আবাহন আছে। জন গণ মন গানটি সেদিক থেকে সম্ভবত বন্দে মাতরমের কার্যকারিতা, জনপ্রিয়তা ও আবেদনের একশো মাইলের মধ্যে আসবে না। এ দুয়ের ফারাক আসলে সিভিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদেরই মধ্যেকার বিভাজন। নিরাকার পরমব্রহ্মের সঙ্গে এই হল মা দুর্গার পার্থক্য। এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে (অন্যথায় যিনি গোঁড়া রবীন্দ্রানুরাগী) অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।

কিন্তু, এই যে ভুল বোঝার কথা বলা হচ্ছে, খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ডরত সাহিত্যরসিকেরাই এই বিষয়ে ভুল বুঝছেন। রেজাউল করীমের লেখা পড়লে আমরা বুঝতে পারি, বঙ্কিমের বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এটা ছিল না যে সেই গান হিন্দুয়ানির প্রচার করছিল। যারা বন্দেমাতরমের বিরোধিতা করেন আজও, গত একশো দশ বছর ধরে করছেন (বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়েই প্রথম বন্দেমাতরম রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে ওঠে, এবং সেইসময় থেকেই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তিকে উস্কিয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু হয়), তারা প্রাথমিকভাবে এজন্য করেন না, যে বন্দেমাতরম কাফের লেখকের লেখা, কাফের ধর্মের সঙ্গীত। বন্দেমাতরম বলা হচ্ছে, বন্দে দুর্গামাতরম তো বলা নেই। এই গানটির পরের স্তবকগুলোর কথা আলাদা (যেমন, “তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে”), সেখানে সরাসরি ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে, কিন্তু অমিত্রসূদন যেমন বলেছেন, অত বেশি বায়বীয় হতে গেলে গানটি দাঁড়াত না। বাংলার হিন্দু সংস্কৃতি সেযুগের জায়মান জাতীয়তাবাদের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যারা এতে আপত্তি করেন, তারা ভুলে যান যে পাসপোর্ট জাতীয়তাবাদ, বা সিভিক জাতীয়তাবাদ দিয়ে স্বাধীন স্বাবলম্বী দেশের কাজ চলে গেলেও, পরাধীন দেশে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে তা নিতান্তই অকেজো। সেখানে একটা ঠাসবুনোট চাই। যাই হোক, কথাটা হল, বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে মূল আপত্তি অন্য জায়গায়। শির্ক, যে কথা আমি আগেই বলেছি। হিন্দু উপাসনার কথা বলা আছে এই গানে, অতএব আপত্তি, ব্যাপারটা তা নয়, কারণ সেভাবে হিন্দু উপাসনার কথা নেই, যদিও কাফেরধর্ম, বা বুতপরস্তি (পৌত্তলিকতা) অবশ্যই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে। মেনে নিলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও বিধান আছে। কিন্তু তার থেকে বড় কথা হল, বন্দেমাতরম শব্দবন্ধেই রয়েছে শির্ক্‌। আল্লার কোনও অংশীদারী হয় না। সত্যিটা হল, দেশকে ইবাদত করা, বা এমনকি নিজের মা-কে ইবাদত করাটাও ইসলাম অনুযায়ী শির্ক্‌।

এই জায়গায় বঙ্কিম যদি ইসলামের দরবারে অপরাধ করেও থাকেন, আগেই বলেছি, সেজন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা অত্যন্ত অপমানজনক। তিনি স্বদেশকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু সেজন্য বলা যায় না তার মনে কোনও রকম ইসলাম বিদ্বেষ ছিল। ইসলাম অনুযায়ী তাঁর বিচার করা যায় না, কারণ তিনি মুসলমান নন, ইসলামের বিধিনিষেধ তাঁর ওপরে আরোপ করাটা অদ্ভুত। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্কিমের মনে সমস্ত ধর্মের প্রতি একটা টিপিক্যাল ভারতীয় শ্রদ্ধা ছিল। তার প্রমাণ পাই সীতারামে।

আমরা সীতারামে এরকম দেখিঃ

উদ্‌ভ্রান্তচিত্তে সীতারাম কতকগুলি নীচব্যবসায়ী নীচাশয় অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “রাজ্যে যেখানে যেখানে যে সুন্দরী স্ত্রী আছে, আমার জন্য চিত্তবিশ্রামে লইয়া আইস।” তখন দলে দলে সেই পামরেরা চারি দিকে ছুটিল। যে অর্থের বশীভূতা, তাহাকে অর্থ দিয়া লইয়া আসিল। যে সাধ্বী, তাহাকে বলপূর্বক আনিতে লাগিল। রাজ্যে হাহাকারের উপরে আবার হাহাকার পড়িয়া গেল।

এই সকল দেখিয়া শুনিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুর এবার কাহাকে কিছু না বলিয়া তল্পি বাঁধিয়া মুটের মাথায় দিয়া তীর্থযাত্রা করিলেন। ইহজীবনে আর মহম্মদপুরে ফিরিলেন না।

পথে যাইতে যাইতে চাঁদশাহ ফকিরের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। ফকির জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরজি, কোথায় যাইতেছেন?”

চন্দ্র। কাশী। - আপনি কোথা যাইতেছেন?

ফকির। মোক্কা।

চন্দ্র। তীর্থযাত্রায়?

ফকির। যে দেশে হিন্দু আছে, সে দেশে আর থাকিব না। এই কথা সীতারাম শিখাইয়াছে।(বঙ্কিম ১, ৭৮৩)


হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের কথা তো আদ্যোপান্ত ইকোনমিক কনটেক্সটে লেখা। সেখানে দুজন রায়তের কথা বলা হচ্ছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দুজনেরই শ্রেণী পরিচয় এক। সেটা থেকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় না যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নে বঙ্কিম হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য করতেন না। কিন্তু এই উপরের উদাহরণটি নিঃসন্দেহে বোঝাচ্ছে, বঙ্কিম মক্কা ও কাশীকে সমদৃষ্টিতে দেখছেন, তিনি চন্দ্রচূড় ঠাকুর এবং চাঁদশাহ ফকিরের প্রতি সমদর্শী। আধ্যাত্মিক বিষয়ে ভারতের এই সমদর্শিতার দীর্ঘ উত্তরাধিকার আছে। বস্তুত এ না হয়ে উপায় ছিল না, প্রাচীন কাল থেকে এদেশে বহু সংস্কৃতি, বহু ঈশ্বর, বহু সাধনাপদ্ধতি পাশাপাশি সহাবস্থান করে এসেছে। ইসলামকেও এর অংশ হিসেবেই স্থান দেওয়া হয়েছিল, রিচার্ড ঈটনের রাইজ অভ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার বইটি এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য। বঙ্কিম সেই কারণেই মক্কা ও কাশীর ইকুইভ্যালেন্স ঘটিয়েছেন। সীতারামের রাজধানীর নাম ছিল মহম্মদপুর, সেও এইপ্রকার সংশ্লেষের উদাহরণ। তবে সেটা কিছুটা রাজনীতিও ছিল, একটা আনুগত্যের বার্তা ছিল মুসলমান বাদশার প্রতি।

অমিত্রসূদন প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ -এ বলছেনঃ

'প্রচার' পত্রিকায় তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস সীতারামে ফকিরের মুখ দিয়ে গল্পের নায়কের প্রতি বঙ্কিমের উক্তিঃ বাবা। শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য স্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু-মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু- মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে। সেই একজনই হিন্দু-মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন; … উভয়েই তাঁহার সন্তান; উভয়েই তোমার প্রজা হইবে। অতএব দেশাচারের বশীভূত হইয়া প্রভেদ করিও না। প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ। পাপের রাজ্য থাকে না।' এমন উদারমনস্ক মুক্তমনা বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যস্রষ্টা যে-কোনো কালের পক্ষেই দুর্লভ। (৪৫৫)

অমিত্রসূদন যথার্থই বলছেন, বঙ্কিমের সীতারাম নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, যে বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতেন না। তার ক্ষোভ সমস্তটাই বিজাতীয়, বিদেশী মুসলমানের বিরুদ্ধে। এখানে দ্রষ্টব্য যে বঙ্কিম তার সমসাময়িক মুসলমানের সমালোচনা করেন নি, যদিও ওয়াহাবি আন্দোলনের দাপট তখন মাথাচাড়া দিয়েছে। ঈশ্বর গুপ্ত পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করেছিলেন বিস্তারিতভাবে, সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক হিসেবে। তিনি সমসাময়িক ওয়াহাবির উত্থান (তিতুমীরের পতনের পরে বাংলায় ওয়াহাবি আগ্রাসন পরিচালিত হয়েছে দুদু মিয়ার ফরাজীদলের দ্বারা, এবং তিতু যদিও পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, অধিকতর সফল দুদু মিয়ার পুরো কাজটাই পূর্ববঙ্গে) সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাদের বিভিন্ন আক্রমণ, লুটপাট, অত্যাচার, নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক ধর্মান্তর বিষয়ে জানতেন। বঙ্কিমের কোনও লেখায় আমরা সে প্রমাণ পাই না, সম্ভবত পূর্ববঙ্গে কখনও না যাওয়ার কারণে তিনি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না (যশোর খুলনা ঠিক পূর্ববঙ্গ নয়)। এটা আরও একটা কারণ, যে বঙ্কিম তার সমসাময়িক মুসলমানের, বা বাংলার দেশজ মুসলমানের প্রতি কোনও বিরূপ সমালোচনা করেন নি। বঙ্কিমের লেখায় যেগুলো মুসলমান বিদ্বেষের উদাহরণ হিসেবে খুঁজে বের করা হয়, সেগুলোর একটাও সমসাময়িক মুসলমানের বিষয়ে নয়। ওয়াহাবি, ফরাজী সম্পর্কে জানতে পারলে তিনি কি বলতেন, সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন (বা হয়ত খবর পেলেও সেভাবে তার গুরুত্ব অনুধাবন করেন নি, আশ্চর্যের কিছু নয়, সেযুগে কেউই করেন নি)। কথা হল, বঙ্কিম যা বলেছেন সেগুলো সবই মধ্যযুগের মুসলমান সম্পর্কে। এবং তাদের প্রায় সবাই ব্যতিক্রমহীন ভাবে পাঠান মোগল, বা পাঠান মোগলের বংশধর দোয়াঁশলা মুসলমান। তারা যখন নঞর্থকভাবে চিত্রিত হয়, সেগুলোকে বিজাতীয় ভ্রাতৃগর্বে গর্বিত দেশজ মুসলমান অনেকটা “বাঁশ কেন ঝাড়ে, আয় আমার ঘাড়ে” বলেই নিজেদের গায়ের ওপরে নিয়ে ফেলেছেন।

কিন্তু অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য এই খুঁতটুকুও রাখতে রাজি নন। বঙ্কিম যে মোগলের প্রতিও এমনকি বিদ্বিষ্ট নন, সেটাও তিনি প্রমাণ করতে চান। “সংস্কার-মুক্ত চিন্তাধিনায়ক এই বঙ্কিমচন্দ্রই বলতে পারেন – ব্রাহ্মণ শাসিত প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন, আর মুঘল-সম্রাট-মহামতি-আকবরের রাজত্বকালই ছিল প্রকৃত স্বাধীন ভারতবর্ষ।” (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৪৫৫)। এখানে অমিত্রসূদনের বক্তব্যের ভিত্তি হল বঙ্কিমের প্রবন্ধ “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা”। অমিত্রসূদন এটাও বলে রেখেছেনঃ “যদি হিন্দুর রাজত্বে (sic) দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক না হয় তবে সে রাজত্বের প্রতিষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র চান না। যদি মুসলমানের রাজত্ব (sic) দেশ সুখী ও সমৃদ্ধ হয় তবে সেই রাজত্বকে সমাদরপূর্বক বরণ করে নিতেও বঙ্কিমচন্দ্র কিছু মাত্র দ্বিধা করেন না; আবার হিন্দু নয় মুসলমান নয়, ইংরেজের শাসনকার্যই যদি দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় তো,(sic) তবে ইংরেজকেই দেশের রাজা করতে হবে বলে বঙ্কিম দাবি তোলেন”(৪৫৪)।



এখানে কতগুলি কথা বলার আছে। এক, বঙ্কিম কিন্তু সেখানে ঠিক এইভাবে ব্রাহ্মণশাসিত ভারতের সঙ্গে আকবরের ভারতকে তুলনা করেন নি। বক্তব্যটা সেখানে এরকম। বঙ্কিম বলছেন, পরতন্ত্রতা মানেই পরাধীনতা নয়। “শাসনকর্ত্তা ভিন্ন জাতীয় হইলেই রাজ্য পরতন্ত্র হইল না। পক্ষান্তরে, শাসনকর্ত্তা স্বজাতীয় হইলেই রাজ্য যে স্বতন্ত্র হয় না, তাহারও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে” (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৫)। এরপরে বলছেন, “পরতন্ত্র রাজ্যকেও কখন স্বাধীন দেশ বলা যাইতে পারে। যথা, প্রথম জর্জের সময় হানোবর, মোগলদিগের সময়ে কাবুল। পক্ষান্তরে কখন স্বতন্ত্র রাজ্যকেও পরাধীন বলা যাইতে পারে; যথা নর্ম্মানদিগের সময়ে ইংলণ্ড, ঔরঞ্জেবের সময়ে ভারতবর্ষ। আমরা কুতুবউদ্দিনের অধীন উত্তর ভারতবর্ষকে পরতন্ত্র ও পরাধীন বলি, আক্‌বরের শাসিত ভারতবর্ষকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলি” (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৫-১৬)। এখানে লক্ষ্যণীয়, আকবরের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্যশাসনের তুলনা তিনি করেন নি, করেছেন কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে।



দুই, প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণশাসনের সঙ্গে বরং তুলনা হয়েছে আধুনিক ভারতের ইংরেজশাসনের। এবং সে তুলনায় উভয়েই তুল্যমূল্য। “ইংরেজের রাজ্যে যেমন ইংরেজ দেশী লোক কর্ত্তৃক দণ্ডিত হইতে পারে না, প্রাচীন ভারতেও সেইরূপ ব্রাহ্মণ শূদ্র কর্ত্তৃক দণ্ডিত হইতে হইতে পারিত না” (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৭)। হ্যাঁ, বঙ্কিম ব্রাহ্মণ শাসিত প্রাচীন ভারতের তুলনায় ইংরেজশাসিত ভারতে শূদ্রের অধিকার বেড়েছে সেটা বলছেন এই প্রবন্ধে, কিন্তু এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে এই মত তিনি পরিহার করেছিলেন এরপরে। হাসিম শেখ এবং রামা কৈবর্ত যে ইংরেজশাসনে ভালো নেই, সেটাই বঙ্কিমের সর্বশেষ মত বলে ধরতে হবে। বঙ্কিমের ওই “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা” প্রবন্ধে ইংরেজশাসনের প্রশংসা করার পেছনে অনেক মোটিভ কাজ করে থাকতে



পারে, কিন্তু তাকে বঙ্কিমের অপরিণত মতামত বলে ধরলেই ভালো। তবে যাই হোক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বঙ্কিম যদি মুসলমান বিদ্বেষী হতেন, তবে আকবর সম্পর্কে এমন উচ্চপ্রশংসা করতেন না।



বঙ্কিম অভিন্ন আইন চেয়েছিলেন, যখন বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রদ করার জন্য শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিম বলছেন যে বাংলার অর্ধেক মুসলমান, সেক্ষেত্রে পুরুষের যদি বহুবিবাহ খারাপ হয়, সেজন্য নৈতিকতার যুক্তি দেওয়া হোক, হিন্দুশাস্ত্রের দোহাই কেন দেওয়া হবে? যদি আইন হয়, শুধু অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য কেন হবে, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবার জন্য আইন হওয়া উচিত।



বঙ্কিম এখানে আধুনিক আইন চাইছেন। দ্রুত একবার দেখে নেওয়া যাক, বিচারক বঙ্কিমচন্দ্র কোনওরকম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভুগতেন কি না। উল্টোটাই জানা যাচ্ছে গোপাল চন্দ্র রায়ের বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারক জীবনের গল্প বইটিতে। বঙ্কিম যখন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট, সেসময় চরডাকাতিয়া গ্রামের হিন্দু জমিদার রামসাগর সেন (প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জমিদারের প্রতিভূ, জমিদার ছিলেন তার শ্যালক শিবশঙ্কর দাশগুপ্ত, যিনি গ্রামে থাকতেন না, বরিশাল শহরে মোক্তারি করতেন) পার্শ্ববর্তী গ্রাম চিতলমারির মুসলমান জমিদারের হাটে ডাকাতি করান। বঙ্কিম সেই হিন্দু জমিদারকে গ্রেফতার করেন (এর জন্য প্রচুর তল্লাশি চালাতে হয়েছিল কারণ তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন), এবং দায়রায় সোপর্দ করেন (৯৪-৯৭)। রামসাগর সেন হাজতেই বিচারকালীন অবস্থায় মারা যান।



শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করছেন, রহিম উল্লা নামক এক গ্রামবাসী যখন মরেল নামক কুখ্যাত নীলকর সাহেবের দলবলের হাতে নিহত হয়, বঙ্কিম তখন নিজে উদ্যোগ নিয়ে ঘটনার তদন্ত করেন, এবং দোষীদের সাজার ব্যবস্থা করেন (১২৪-৫)। খুলনার ঘটনা। এর জন্য বঙ্কিমের প্রাণসংশয় পর্যন্ত হয়েছিল, সে তথ্যও শচীশ দিয়েছেন।

এখানে উল্লেখ্য, এই দুজন লেখকেরই কিন্তু কোনও দায় ছিল না বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ অপ্রমাণ করার। এরা কেউই সেই সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখেননি, বঙ্কিমের ডেপুটি জীবনের কাহিনী বর্ণনার সময়ে নিতান্তই ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবে এই তথ্য পরিবেশন করেছেন।



মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরালে দেখা যায়, বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন না। বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে জানিয়েছিলেনঃ মুসলমান হলেই খারাপ হয় না, হিন্দু হলেই ভালো হয় না। পক্ষান্তরে, হিন্দু হলেই খারাপ হয় না, মুসলিম হলেই ভালো হয় না। আবারসীতারাম বঙ্কিমের এমন একটা উপন্যাস যেখানে বঙ্কিম দেখিয়েছেন, হিন্দুধর্ম সমস্ত আধ্যাত্মিকতাকেই সম্মান দেয়। সীতারাম গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে বঙ্কিম দেখিয়েছেন, মধ্যযুগের ইসলামিক শাসনের মধ্যে যে আগ্রাসী প্রবণতা ছিল, যে দর্প ছিল, তার বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলিম বিদ্বেষী বা ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ার প্রয়োজন নেই।



বঙ্কিম শেষবিচারে বাঙালি জাতীয়তাবাদী। বহিরাগত, এলিট মুসলমান নিজেকে বাঙালি ভাবতে শুরুই করেছে অনেক পরে। বঙ্কিমের সমসাময়িক মুসলমান নিজেকে বাঙালি বলে ভাবত কি? রেজাউল করীম এই সময়ের


শিক্ষিত মুসলমান সম্পর্কে বলছেন, “সে উর্দ্দু-ফারসীর মোহ ত্যাগ করিতে পারে নাই। বাংলার মৃত্তিকায় সে তখনও আফগানিস্তানের পেস্তা-বাদামের চারা রোপণ করিবার কল্পনায় বিভোর ছিল” (৩৮)। এই তথ্য যেন আমরা বিস্মৃত না হই।



বঙ্কিম মুসলিম বিদ্বেষী নন, যদি এর এসেনশিয়ালিস্ট অর্থ করা হয়, অর্থাৎ যদি বলা হয় বঙ্কিম মুসলমান সত্তার বিরোধী, ব্যক্তি মুসলমানের বিরোধী, জন্মসূত্রে মুসলমান এমন সমস্ত ব্যক্তির বিরোধী। এ চূড়ান্ত অসত্য।



বঙ্কিম সাহিত্যে যেখানে আপাত মুসলমান বিদ্বেষ আছে বলে মনে হয়, সেখানে মুসলমান হল আগ্রাসনের মেটাফর। অর্থাৎ বঙ্কিম রচনায় মুসলমানের উল্লেখ সর্বদাই কোয়ালিফায়েড, তার অনেকগুলি রাইডার আছে, তাকে কনটেক্সটের বাইরে বিচার করা অন্যায়।



আবার বলি, বঙ্কিমের মুসলমান হল মধ্যযুগের মুসলমান। বঙ্কিম তার সমসাময়িক বঙ্গদেশের মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, এ প্রমাণ বঙ্কিমের লেখা তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেও কেউ খুঁজে পাবেন না। যেখানে বঙ্কিম গর্দভস্তোত্রে বলেন, তুমি কলিকালে বৃদ্ধ সেনরাজা, নয়ত বঙ্গদেশে মুসলমান কেন, এ মুসলমান তো স্পষ্টতই বখতিয়ার খিলজি এবং বখতিয়ার খিলজির লেগেসি। অলোক রায় উদ্ধৃত করছেন আহমদ শরীফের মতামত এই প্রসঙ্গেঃ “মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পিত ক্ষোভ ও নিন্দা বাস্তবেও মিথ্যে ছিল না। তুর্কী মুঘলের জ্ঞাতিত্ব-গর্বী দেশী মুসলমান অকারণে এ নিন্দা-গালি নিজেদের গায়ে মাখে” (১৮৫)।



বঙ্কিমকেই, আমরা দেখছি, বারবার অন্যায় বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বঙ্কিম স্বাধীনতাপূর্ব যুগে এক ত্রিফলা আক্রমণের চক্রব্যূহে অভিমন্যু হিসেবে প্রতীত হন।

বঙ্কিমচন্দ্রকে ত্রিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। হিন্দুয়ানির রক্ষাকর্তারা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে দেখেছেন অহিন্দু মনোভাবের প্রকাশ, ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানেরা তাঁর উপন্যাসে দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ অর্থাৎ মুসলমানবিদ্বেষ, আর শুদ্ধ-শিল্পের প্রবক্তারা সেখানে দেখেছেন নীতিধর্ম- সমাজধর্ম-হিন্দুধর্মের নির্দেশে শিল্পধর্ম বিসর্জনের প্রয়াস।

১৮৮৮ সালে সেখ আবদোস সোবহান হিন্দু মুসলমান নামে একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে বঙ্কিম উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রের বিকৃতিতে প্রথম ক্ষোভ প্রকাশ পায়। তার পর ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সৈয়দ আবুল মোহাম্মদ, তসলিমুদ্দিন আহমদ্‌, আবুল কালাম মোহম্মদ শামসুদ্দীন, এস এম আকবর, ইমদাদুল হক, গোলাম মোস্তাফা প্রমুখ অনেক লেখক এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন (অলোক রায় ১৮৪)।



বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে এর আগেও অনেক লেখা হয়েছে, এর পরেও হবে। অনেকে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ড করবেন, অনেকে আক্রমণ করবেন। প্রশ্ন হল, অন্যান্যদের বঙ্কিম বিদ্বেষ নিয়ে কবে একটা কমপ্রিহেনসিভ কাজ হবে? স্মর্তব্য, “মুসলমান লেখকদের রচনায় বঙ্কিম-বিদ্বেষ সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত কম বেশি পরিমাণে বিদ্যমান” (রায় ১৮৫)। আর শুধু তো লেখকদের প্রশ্ন নয় এটা। সারা ভারতে মোট কতবার, কি কি পদ্ধতিতে বন্দেমাতরম গানে বাধা দেওয়া হয়েছে, সেই গানের সমালোচনা হয়েছে, কি রকম ভাষায় সমালোচনা হয়েছে?


কতবার আনন্দমঠের ও অন্যান্য বঙ্কিম উপন্যাসের নাট্যাভিনয় নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্যহত হয়েছে? আনন্দমঠ পোড়ানোও হয়েছে একাধিকবার, তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তো কেউ লিপিবদ্ধ করছেন না। বঙ্কিমের প্রতি বাকিদের বিদ্বেষ নিয়ে কিন্তু আলোচনা দরকার। অবশ্য সেটা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে।



বঙ্কিমের সবথেকে বেশি বিতর্কিত উপন্যাস আনন্দমঠ। এই উপন্যাস নিয়ে রেজাউল বলছেনঃ



আনন্দমঠ শুধু আনন্দ দেয় নাই, -দিয়াছে প্রাণ, দিয়াছে উৎসাহ, প্রাণের পরতে পরতে ছুটাইয়াছে আগুনের ফোয়ারা। প্রাণে জাগাইয়া দিয়াছে দেশাত্মবোধের মহান আদর্শ। দিশেহারা লোক পাইয়াছে একটা অবলম্বন -একটা আশ্রয়। সে আশ্রয় ও অবলম্বন পাইয়া হয়ত কেহ কেহ উদ্ভ্রান্ত হইয়াছে - হয়ত কেহ বিপথে চলিয়া গিয়াছে, -কিন্তু অধিকাংশ লোকই সত্যিকারের আদর্শ পাইয়াছে। 'আনন্দমঠ' না থাকিলে পরবর্তী যুগের কোন আন্দোলন (যেমন - স্বদেশী, হোমরুল, খেলাফত, অসহযোগ-সংগ্রাম) সার্থক ও পূর্ণ হইত না; গৌরবান্বিত স্বদেশীযুগের ইতিহাসও রচিত হইত না। স্বদেশী যুগ হইতে এ পর্যন্ত জাতীয় জাগরণের জন্য যে সব আন্দোলন হইয়াছে, 'আনন্দমঠ' পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তাহার সবটাতে অনুপ্রেরণা যোগাইয়াছে। স্বদেশী যুগে কোন আদর্শ বিবদমান ও কলহসর্বস্ব জাতিকে একত্র করিয়াছে ? দেশ আগে, তারপর সম্প্রদায় - এই ভাব কোন আদর্শ দেশবাসীর মনে জাগাইয়াছে? দেশে দেশে কোন পুস্তক আগুন ছুটাইয়াছে ? দিগ্বিদিকে ভারতের আশা আকাঙ্ক্ষার দাবী প্রচার করিয়াছে? বস্তুতঃ 'আনন্দমঠের' কল্যাণে ইহা সম্ভব হইয়াছে। 'আনন্দমঠের' সুমধুর 'বন্দেমাতরম' ধ্বনির তালে তালে জাতি ভেদাভেদ ভুলিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে কর্তব্যের আহ্বানে - দেশের উদ্ধারের কাজে। আসমুদ্র-হিমাচল প্রকম্পিত করিয়াছে অমর বঙ্কিমচন্দ্রের একটি মাত্র সঙ্গীত 'বন্দেমাতরম'। " (৫২)

তাও বন্দেমাতরমকে একদল নিষিদ্ধ করবে, তাও আনন্দমঠ পোড়ানো চলবে। কলকাতায় আনন্দমঠ পোড়ানোর উৎসব করেছিল মুসলিম লিগ ১৯৩৮ সালে (জন্মশতবর্ষের উপহার হয়ত)। সে সম্পর্কে রেজাউল করীম বলছেনঃ



সভ্য-জগৎ স্তম্ভিতচিত্তে দেখিল, ভারতের একটি সুবৃহৎ নগরে, বহু শিক্ষিত ও সাহিত্য সেবকের সম্মুখে ও সম্মতিক্রমে এমন একটি অনাচার হইয়া গেল, যাহা বর্বরতায় মধ্য-যুগের ধর্মান্ধ জ্ঞানবৈরীদের সমস্ত অত্যাচারকে ম্লান করিয়া দিল। সাহিত্য-সেবক, কবি ও লেখকগণ, সাহিত্যামোদী পাঠকগণ কিরূপ মত্ত উল্লাসে করতালি দিতে দিতে এই বহ্নি-উৎসব উপভোগ করিলেন, তাহা দেখিবার বস্তু বটে। 'আনন্দমঠ' সাজানো হইল, পরে তাহাতে অগ্নি-সংযোগ করা হইল - সেই অগ্নি বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, আর তাহারই চারিদিকে কবি, লেখক, সাহিত্যিকগণ, আইন-সভার সদস্যগণ এবং মুসলিম বাংলার তরুণদলের প্রতিনিধিগণ আনন্দে করতালি দিতে দিতে সেই দৃশ্য পরম সন্তোষ ও তৃপ্তির সহিত উপভোগ করিলেন এবং কম্বুকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, মুসলিম-বাংলায় নবযুগ আসিয়াছে... (৫৩)





পুস্তকতালিকা



প্রাথমিক তালিকা



চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিম রচনাবলী। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতাঃ রিফ্লেক্ট, ১৯৯৯।



মাধ্যমিক তালিকা



কর, শিশির। ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই। কলকাতাঃ আনন্দ, ২০১২।

করীম, রেজাউল। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ। কলকাতাঃ র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১৪।

চট্টোপাধ্যায়, শচীশচন্দ্র। স্বর্গীয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন চরিত। কলকাতাঃ ইউনিভার্সাল লাইব্রেরি, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ।

বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন। আনন্দ মঠঃ উৎস সন্ধানে। কলকাতাঃ আনন্দ, ১৯৮৩।

ভট্টাচার্য, অমিত্রসূদন। প্রবন্ধ পঞ্চাশৎঃ বিষয় বঙ্কিমচন্দ্র। কলকাতাঃ প্রতিভাস, ২০১৪।

---। বঙ্কিমজীবনী। কলকাতাঃ আনন্দ, ২০১২।

রায়, অলোক। বঙ্কিম মনীষা। কলকাতাঃ এবং মুশায়েরা, ২০১৪।

রায়, গোপালচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারক জীবনের গল্প। কলকাতাঃ পারুল প্রকাশনী, ২০১২

রায়চৌধুরী, সত্যব্রত। “বঙ্কিমচন্দ্র ও জাতীয়তাবাদ”। জাতীয়তাবাদ ও বাঙালী চিন্তাবিদ। সম্পাঃ ডঃ সত্যব্রত রায়চৌধুরী ও ডঃ এ কে বসু। কলকাতাঃ সুজন পাবলিকেশন্স, ১৯৯৭। পৃঃ ৯-১৬।

Chatterjee, Bhabatosh (Ed). Bankimchandra Chatterjee: Essays in Perspective. New Delhi: Sahitya Akademi, 1994.





সতীন সেন

তমাল দাশগুপ্ত


অবিভক্ত বঙ্গের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ বৈদ্যবংশে সতীন সেনের (সতীন্দ্রনাথ সেন) জন্ম। তাঁর পিতামহের নাম রামসেবক সেন, পিতার নাম নবীনচন্দ্র সেন। নবীনচন্দ্র পটুয়াখালী মহকুমা আদালতে (বরিশাল জেলার অন্তর্গত) মোক্তারি করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। রামসেবকের জ্যেষ্ঠ পুত্র (নবীনচন্দ্রের দাদা) কৈলাসচন্দ্র ছিলেন সেই অঞ্চলের বিখ্যাত মোক্তার। সতীন্দ্রনাথ সেনের জন্ম কোটালিপাড়ার অন্তর্গত বাগান উত্তরপাড়া গ্রামে, ১৮৯৪ সালে, জীবনীতে তারিখের উল্লেখ নেই (জন্মতারিখ একটি ওয়েবসাইটে জানা যাচ্ছে ১৫ই এপ্রিল <http://www.somewhereinblog.net/blog/sumonzahid/29878233>)।



মাত্র এগারো মাস বয়েসে সতীন মাতৃহীন হন।

সতীন্দ্রনাথের পিতা নবীনচন্দ্র পটুয়াখালীর একজন সমাজপতি ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল সংযত বাক্য, সহজাত গাম্ভীর্য্য এবং পরোপকারের প্রবৃত্তি।

পটুয়াখালী সম্পর্কে সতীন সেনের জীবনীকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখছেনঃ
“বঙ্গদেশের এক দুর্গমস্থান হইল পটুয়াখালী মহকুমা। সমগ্র বরিশাল জিলায় রেল সংযোগ ছিল না, ইহার উপর পটুয়াখালী মহকুমার ৭ টি থানার সহিত ছিল না যোগাযোগের কোন উপযুক্ত রাস্তা-পথ। চতুর্দ্দিকের বিশাল নদী, খাল বিল প্রভৃতির মাধ্যমে চলিত যোগাযোগ। নৌকাযোগে চলিতে হইলেও নির্ভর করিতে হইত জোয়ার-ভাঁটার উপর। জন-সংখ্যায় মুসলমান সম্প্রদায় ছিল শতকরা ৯৫ জন।” (৩৩-৩৪) (আশুতোষ অবশ্য কোন বছরের সেন্সাস অনুযায়ী ৯৫%, সেটা জানান নি।)

স্কুলজীবন

সতীন্দ্রনাথের শৈশব ও বাল্যকাল অতিবাহিত হয় পটুয়াখালীতে। তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় পটুয়াখালী জুবিলি হাই স্কুলে। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরদাকান্ত সেনগুপ্ত ছাত্র সতীন্দ্রনাথের ওপরে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলেন। সতীন্দ্রনাথ খুব ভালো ইংরেজি জানতেন, অনায়াস ও সাবলীল উচ্চারণ ছিল তাঁর, এবং এটি বরদাকান্ত সেনগুপ্তের প্রভাবে হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বরিশাল জেলা স্বদেশী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে ওঠে। এই সময়ে বরিশাল জেলায় কালীশ পণ্ডিতের Little Brothers of the Poor , আচার্য জগদীশ মুখোপাধ্যায়ের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম এবং ব্রজমোহন বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে স্বদেশী ও বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠে। মহাত্মা অশ্বিনী দত্ত এইসময়ে ভক্তিযোগের আদর্শে জাতীয় চরিত্র বিকাশের আহ্বান জানান। বরিশালেরই চারণকবি মুকুন্দ দাসের সঙ্গীত গণ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। এইসময়ে বরিশাল শঙ্কর মঠের তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বিপ্লবী আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে সন্ন্যাস জীবন ও বিপ্লবী জীবনের সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশের কাজে উৎসর্গপ্রাণ একদল যুবকের নেতৃত্ব দেন।

মুকুন্দ দাসের গান শুনে সতীন বাড়ি ছাড়েন এবং সোজা মুকুন্দের কাছেই গিয়ে উপস্থিত হন এবং ভবিষ্যতে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে চান। সতীনের বয়েস তখন দশ বছর। এরপর অবশ্য অশ্বিনী দত্তের হস্তক্ষেপে সতীনকে পটুয়াখালী ফেরত পাঠানো হয়।

সতীন যখন ছাত্র, তখন বরিশালের মিউনিসিপ্যালিটির তরফ থেকে কুকুর নিধন অভিযান চালানো হচ্ছিল, সতীন এতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি পশুপ্রেমী ছিলেন, সে যুগে যা খুব একটা দেখা যেত না।

পটুয়াখালীর স্কুলজীবনে সতীনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন মেধাবী ক্লাসমেট সুধীর কুমার দাশগুপ্ত। মূলত সুধীরের উদ্যোগে এই সময়ে একটি ছাত্রচক্র স্থাপিত হয়। সেখানে এঁরা শাস্ত্রচর্চা, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনপাঠ, যোগব্যায়াম অভ্যাস, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দুঃস্থ নিঃসহায় মানুষজনের সেবা ইত্যাদি করতেন, এবং সুধীরের সঙ্গে প্রজ্ঞানানন্দের যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে এঁরা নিয়মিত বিপ্লবী পুস্তক ও পত্রিকা পড়া শুরু করেন।

১৯০৫ সালের বঙ্গীয় কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বরিশাল শহরে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সভাপতি। নির্মম দমন পীড়ন চলে, যার ফলে গোটা বরিশাল জেলাতেই বিক্ষোভের পরিবেশ তৈরি হয়, নিঃসন্দেহে তার আঁচ লেগেছিল সতীন এবং তাঁর সহপাঠীদের গায়েও।

এরপরে ১৯০৭ সালে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সম্মেলন সরকারী আদেশে বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাজেয়াপ্ত হয় সম্মেলনের সভাস্থল নির্মাণে ব্যবহৃত যাবতীয় টিন ও কাঠ, যা দিয়ে একটি সরকারী ক্লাব বানিয়ে ফেলা হয়। সতীন এবং তাঁর বন্ধুরা সেই ক্লাবটি রাতের বেলায় আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করেন। এই সময় সতীনের বয়েস মাত্র বারো।

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ঘনিষ্ঠ ছিলেন যুগান্তর দলের সঙ্গে। বিপ্লবী নেতা যতীন মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন), যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরিকুমার চক্রবর্তী, ভূপতি মজুমদার, অমর ঘোষ -এঁদের সঙ্গে প্রজ্ঞানানন্দের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
প্রজ্ঞানানন্দের কাছে দীক্ষা নেন অনেকেই, এবং বরিশালের বাইরে থেকেও অনেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সুধীর দাশগুপ্ত ও সতীন সেন দুজনেই প্রজ্ঞানানন্দের কাছে দীক্ষিত হন। জানা যায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও দীক্ষিত হয়েছিলেন প্রজ্ঞানানন্দের দ্বারা।

কলেজজীবন

১৯১২ সালে পটুয়াখালী জুবিলি হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় সুদূর হাজারিবাগের সেইন্ট কলম্বাস কলেজে। তাঁর আত্মীয়স্বজনরা সতীনের স্বদেশী মানসিকতায় উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, এবং সঙ্গীসাথীদের থেকে, স্বদেশী ও বিপ্লবী আন্দোলনের থেকে দূরে পাঠালে সে মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে এবং সতীন পড়াশোনায় মন দেবেন এবং ‘কেরিয়ার’ গড়বেন, এই আশায় তাঁকে হাজারিবাগে পাঠানো হয়, কলকাতায় বা বঙ্গের অন্যত্র না পাঠিয়ে। কিন্তু সতীন এই মিশনারি কলেজে এসে আরও বেশি করে দেশীয় রীতিনীতিকে আঁকড়ে ধরেন, ধুতি চাদর পরিধান শুরু করেন, স্ব-পাক নিরামিষ খেতে শুরু করেন। শোনা যায় কলেজের অধ্যক্ষ টমসন এই অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে এসে সতীনের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে যান, এবং বলেন, দিস বয় ইজ আ ট্রু ক্রিশ্চিয়ান। এর তাৎপর্য সম্ভবত এইঃ সতীন যুক্তিতে তুখোড় ছিলেন, এবং কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে চাননি। তার যুক্তিজালে অধ্যক্ষ পরাস্ত হন, এবং সতীন তার প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন।

সতীন এরপরে বটানি নিয়ে পড়তে আগ্রহী হন। হাজারিবাগের কলেজে সেই ব্যবস্থা না থাকায় তিনি কলকাতায় এসে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এইসময় থেকে সতীন্দ্রনাথের সক্রিয় বিপ্লবী জীবন শুরু, যদিও প্রজ্ঞানানন্দের সংস্পর্শে আসার ফলে আগেই বিপ্লবী ভাবধারায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল।


বিপ্লবী জীবন

বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করার সময় সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একটি বাড়িতে থাকতেন সতীন। এটি ক্রমে যুগান্তর বিপ্লবীদের আখড়া হয়ে ওঠে। এম এন রায় (তখন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) ভারত ত্যাগের পূর্বে এই বাড়িতে এক রাত কাটান।
এই সময়ে সতীন সাইকেল-আরোহী ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে ইউরোপীয় নাবিকদের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতেন বিপ্লবী দলের জন্য।

এই সময়ে, ১৯১৫ সালে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি স্বদেশী ডাকাতি সঙ্ঘটিত হয় হাওড়ার শিবপুরে, এই দলে সতীনও ছিলেন। পুলিস এসে যাওয়ায় বিপ্লবীরা গঙ্গাবক্ষে একটি ডিঙিতে চড়ে পলায়ন করেন। সতীন এই সময়ে এক হাতে পিস্তল চালিয়েছিলেন এবং অন্য হাতে ডিঙির হাল ধরেছিলেন।

এপ্রসঙ্গে বলা দরকার, অমলেন্দু ঘোষ মনে করেছেন যে পুলিস মিথ্যে মামলা দিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে, কিন্তু অমলেন্দুর বর্ণনা পড়লে মনে হয় যে সতীন তখনও পটুয়াখালীতেই ছিলেন, যা সত্য নয়, সতীন তখন কলকাতায় থাকেন। উপরোক্ত ডাকাতির বর্ণনা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রদত্ত, যা বেশি গ্রহণযোগ্য, কারণ আশুতোষ সতীনের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন, এবং ব্যক্তিগতভাবে সতীনের সহযোগী ছিলেন।

এই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত অভিযোগে সতীন, তাঁর পটুয়াখালীর সহপাঠী সুধীর দাশগুপ্ত সহ অনেক বিপ্লবীকেই পুলিস গ্রেপ্তার করে, তাদের মধ্যে এই স্বদেশী ডাকাতির নেতা নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীও ছিলেন। বিচার শুরু হয়।

সতীনের পিতা অকাতরে অর্থব্যয় করেন, দুঁদে ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে নিয়োগ করেন, এবং সতীন (এবং সুধীর দাশগুপ্ত) প্রমাণাভাবে খালাস পান (নরেন্দ্রনাথের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়)। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। জেল গেটের বাইরে আসামাত্রই কুখ্যাত ভারতরক্ষা আইনে সতীনকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়।

বন্দী জীবন

এইসময় সতীন প্রথমে খুলনার কালীগঞ্জে অন্তরীণ থাকেন। সেখানকার আবহাওয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে বহরমপুর জেল এবং তারপরে মালদহ জেলার বামনগোলা থানার প্রেরণ করা হয়। সেখানে অসম্মান সহ্য না করতে চাওয়ায় জেলা পুলিস সুপারের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন, এবং শাস্তিস্বরূপ এবার তাঁকে জলপাইগুড়ির আলিপুরদুয়ারের একটি দুর্গম স্থানে অন্তরীণ করা হয়, এবং তারপরে সেখান থেকে পাঠানো হয় ভূটানসীমান্তে কুমারগ্রাম নামক ততোধিক দুর্গম স্থানে। পাহাড় ঘেরা, বনজঙ্গল পরিবৃত, হিংস্র জন্তুজানোয়ার অধ্যুষিত, ম্যালেরিয়া কবলিত সেই অঞ্চলে বর্ষার সময়ে বহির্জগতের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সতীন এই সময়ে পুলিসকে জানান, অবিলম্বে তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া না হলে তিনি নিজে পায়ে হেঁটে সেই স্থান ত্যাগ করবেন (সতীন এখানে জেলবন্দী ছিলেন না, অন্তরীণ ছিলেন, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সরকারি প্রহরায় থাকতেন)। এর ফলে তাকে আলিপুরদুয়ারের অন্যত্র অপেক্ষাকৃত সুগম অঞ্চলে রাখা হল।

এইসময়ে সতীনকে সরকারি চাকরির টোপ দেওয়া হয়, দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির ইংরেজ পুলিস সুপার লোম্যান। সতীন প্রত্যাখ্যান করেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ সরকার অন্যান্য স্বদেশী বন্দীদের সঙ্গে সঙ্গে সতীন্দ্রনাথকেও মুক্তি দেয়। সালটা ১৯১৯।

গান্ধীবাদের প্রভাব এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ

এই সময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, এবং এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি দেন। সতীন এইসময়ে গান্ধীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে বলা দরকার যে এটি মূলত চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানেই ঘটেছিল, এবং যুগান্তরের আরও অনেকে এইসময়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। প্রকাশ্য গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিপ্লবীদের জন্য এক নতুন ক্ষেত্র ছিল। বরিশালের পটুয়াখালীতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যোগ দেন সতীন। এর আগেই ১৯২০ সালে বিপিন পালের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে বরিশালে, সেখানে সতীন নিজের অনুগামীদের নিয়ে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছিলেন।

সতীন এইসময় থেকে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে পটুয়াখালীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত প্রান্তে সাপ্তাহিক হাটগুলোয় ঘুরে ঘুরে অসহযোগ ও খিলাফতের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

এরপরে অচিরেই কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দলকে ইংরেজ সরকার বে-আইনি ঘোষণা করে। গ্রেপ্তার হন সতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সহকর্মীরা। ১৯২২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি সতীন সেনকে আড়াই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় (তারিখটি জানাচ্ছেন অমলেন্দু ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর তারিখ উল্লেখ করেন নি)। সতীন অসহযোগের প্রকৃত আদর্শে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন নি, বিচারব্যবস্থাকেই অস্বীকার করেছিলেন, ফলে এই বিচার হয় একতরফা।

ফের বন্দীজীবন, ঐতিহাসিক অনশন

সতীন বরিশাল জেলে প্রেরিত হন। তদানীন্তন জেল প্রশাসন রাজবন্দীদের ন্যূনতম মর্যাদাও দিতেন না। “সরকার সেলাম” বলে একটি অত্যন্ত অপমানজনক প্রথা মানতে বাধ্য করা হত সমস্ত বন্দীদের (জেলার বা অন্য পরিদর্শক এলে বন্দীদের একসারিতে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে সেলাম জানাতে হত, একে বলা হত সরকার সেলাম)। হাড়ভাঙা খাটুনি, যাতা ঘোরানো, ছোলা পেষা, বাগানে কোদাল দেওয়া, ইত্যাদি কাজে বাধ্য করা হত অসহযোগ কর্মীদের। সেই সঙ্গে ডোরাকাটা জাঙিয়া ও ফতুয়া পরে, একহাতে থালা, অন্যহাতে একটি চর্মনির্মিত টিকিট (তাতে বন্দীর পরিচয় একটি ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট করা হত), এইভাবে দণ্ডায়মান থেকে সরকার সেলাম জানানোর বিরুদ্ধে সতীন বিদ্রোহ করলেন।

একদল অসহযোগী সতীনের এই বিদ্রোহকে সমর্থন জানান নি। পিরোজপুরের অনন্ত সেন, নরেন দাশগুপ্ত প্রমুখ কট্টর গান্ধীবাদীরা বললেন, জেলখানায় রাজবন্দীরা “সিভিল ডেড”। তাদের প্রতিবাদ করা চলে না, জেলের যা নিয়ম তা পালন করা উচিত। এর প্রত্যুত্তরে সতীন বলেছিলেন,
“’সিভিল ডেড’ অর্থ যদি মানবিক মর্য্যাদা বিসর্জন দেওয়া হয় তাহলে গান্ধীজি নিজ মুখে এসে বললেও আমি তা মানব না। আমরা শান্তভাবে প্রতিকার চাইব। না শুনলে সংগ্রাম করে আদায় করব। ইংরেজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য আমাদের জেলে পুরেছে। আমরা আন্দোলনকে স্তব্ধ হতে দেব না। জেলের বাইরে যেমন চলছে, জেলের ভেতরে তেমন চলবে। ওদেরকে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে শাসন চালাতে দেব না” (অমলেন্দু ঘোষ ১৭৯)।

সতীন সেনের মতই অধিকাংশ রাজবন্দীর মত দেখা যায়। সরকারপক্ষ এর পরে নির্মম দমন পীড়ন চালায়। সতীনের তিন সহযোগী, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, রাজেন দাস ও মকবুল মিঞাকে হস্তপদ আবদ্ধ করে নগ্ন অবস্থায় বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয় ইংরেজের পুলিসকর্তারা।

এরপরে সতীন অনশন শুরু করেন। সেই অনশন ঐতিহাসিক, তা ৬১ দিন ধরে চলেছিল। সতীন তাঁর অনশনের পরিসমাপ্তি ঘটান যখন অত্যাচারী পুলিস সুপার মানরোর বদলির নির্দেশ আসে, এবং সরকারের তরফ থেকে রাজবন্দীদের সবকটি দাবীদাওয়া মেনে নেওয়া হয়। এই সময় তাঁর বয়েস আঠাশ বছর। জেলের ভেতরে এই আন্দোলনের সময় সতীনের উল্লেখযোগ্য নিকট সহযোগীদের মধ্যে কলসকাঠির কানাইলাল ও নলিনী দত্ত, বাউফলের ফক্কু মিঞা, কোষাবরের জিতেন দত্ত, মহেন্দ্র রায়, বিহারী বিশ্বাস প্রমুখদের নাম বিশেষভাবে নেওয়া যায়।

এরপর বিশেষ শ্রেণীর বন্দীর মর্য্যাদা দেওয়া হয় রাজবন্দী অসহযোগীদের। সতীনকে বরিশাল থেকে সরিয়ে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এবং তারপরে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে কারারুদ্ধ অবস্থায় অনশন শুরু করেছে খবর পেয়ে সতীন কারা-কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন তাকে যেন হুগলি জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই অনুরোধ মান্য হয়, এবং হুগলি জেলে পৌঁছে সতীন নজরুলের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন।

জেলমুক্তি এবং বরিশাল জেলা কংগ্রেসের দায়িত্ব

১৯২৩ সালের প্রথম দিকে (আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী), মতান্তরে শেষের দিকে (অমলেন্দু ঘোষের বই অনুযায়ী) ইংরেজের জেল থেকে ছাড়া পান সতীন। ইতিমধ্যে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন গান্ধী, অন্যদিকে খিলাফত আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছে। এইসময়ে সতীন সেন দেখতে পান তার সঙ্গে যে মুসলমান সহকর্মীরা আগে ছিলেন, তারা সবাই ইংরেজবিরোধী আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন (“তাঁহার বিশ্বস্ত মুসলমান কর্মীগণের আর কাহাকেও তিনি পাইলেন না” – আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ৪৯)।

এরপর তিনি পটুয়াখালী জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে, স্কুলের মৃত্তিকানির্মিত ভবনটি তাঁর নিজের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। নিজেই এই স্কুলে শিক্ষকের কাজ করেছেন, তার জ্যাঠতুতো দাদা হেমচন্দ্র সেনকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছেন, কারণ শিক্ষক নিয়োগের জন্য সেসময় তাঁর কাছে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ ছিল না।
এরপরে ১৯২৪ সালে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। পিরোজপুর মহকুমায় এই সম্মেলন ঘটে, অনন্তকুমার সেন, মৃন্ময় গুপ্ত প্রভৃতির নেতৃত্বে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে। সতীনকে বরিশাল জেলার কংগ্রেস সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইসময় থেকেই সতীন সমগ্র বরিশালের রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠেন, প্রয়াত অশ্বিনী দত্তের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে উঠে আসেন তিনি। বরিশালে তিনি কংগ্রেস অফিসেই একটা ঘরে থাকতে শুরু করেন, সাত আটজন কর্মীকে নিয়ে। চাইলেই নিজের জন্য আরামদায়ক বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতেন, কিন্তু করেন নি।

বরিশালের ব্রজমোহন শিল্প বিদ্যালয়ের অধ্যাপক শৈলেন দাশগুপ্ত (রুনুবাবু নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন) ১৯২২ সালে তৈরি করেছিলেন তরুণ সঙ্ঘ, কিন্তু ১৯২৪-এ তিনি গ্রেপ্তার হলে সংগঠনটি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। এইসময় সতীন সেন তরুণ সঙ্ঘের হাল ধরেন। এই তরুন সঙ্ঘেই তিনি তাঁর দুই ভবিষ্যত নিকট সহকর্মী তারাপদ ঘোষ এবং শৈলেশ্বর চক্রবর্তীকে পেয়েছিলেন।
সুধীর কুমার দাশগুপ্ত এইসময়ে “বরিশাল” নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে তাঁর অবসরের পরে এই পত্রিকার দায়িত্ব নেন বিজয় ভূষণ দাশগুপ্ত (পরে যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক)। এই “বরিশাল” পত্রিকাকে অবলম্বন করেও সতীন অনুগামীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওঠেন।

১৯২৫ সালে গান্ধীর আগমন ঘটে বরিশাল জেলায়।

এই সময়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সতীন জানতে চান, ক্রমবর্ধমান মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্দু মুসলমানে ঐক্য গড়ে তোলা কিভাবে সম্ভব। গান্ধীজি বলেন, “হিন্দুরা ভীরু, এবং মুসলমানরা দুর্দান্ত। বন্ধুত্ব সম্ভব তখনই যখন উভয়েই হইবে সম-শক্তিমান” (আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ৫৯)।

সেসময়ে স্কুলে সরস্বতী পুজো পালন করতে দেওয়ায় বাধা আসছে বরিশাল জুড়ে। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সতীনকে গান্ধী বলেন, “হিন্দুস্থান হইল হিন্দু মুসলমান উভয়ের সমবেত প্রাঙ্গন – এজন্য কি হিন্দুদের কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রতিপালিত হইবে না?” (আশুতোষ ৫৯)।

হিন্দুরা এইজাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হলে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরামর্শ দেন গান্ধীজি। সর্বপ্রকার, অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

গান্ধী এসময়ে তিন দিন বরিশালে অতিবাহিত করেন। যেদিন তিনি বরিশাল ত্যাগ করেন, সেদিনই সন্ধ্যায় চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুসংবাদ টেলিগ্রাম মারফত পৌঁছয়। সতীন চিত্তরঞ্জনের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন না, কিন্তু গুণমুগ্ধ ছিলেন।

লাউকাঠিতে ট্যাক্স বিরোধী আন্দোলন

ইংরেজ সরকার এক নতুন আইনবলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপনে উদ্যত হয়, যার ফলে জনসাধারণের প্রদেয় ট্যাক্সের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। এর বিরুদ্ধে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল মেদিনীপুর অঞ্চলে কর-বন্ধ আন্দোলন পরিচালিত করেন। বরিশালের লাউকাঠিতেও এইরকম ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপিত হয় সরকারের অনুগত একদল লোকজনকে নিয়ে, এবং বর্ধিতহারে কর ধার্য হয়। এর বিরুদ্ধে সতীনের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিসের দ্বারা এই সময়ে সতীন আক্রান্ত হন, পুলিসের লাঠির বাড়িতে তাঁর মাথায় গুরুতর চোট লাগে, মাথা ফেটে যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি জনতাকে অহিংস রাখতে পেরেছিলেন, এবং জেলার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ই এন ব্ল্যান্ডী ঘটনাস্থলে এসে লাউকাঠি ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল ঘোষণা করেন। এর পরেই বরিশালের মুরাদিয়া, আউলিয়াপুর প্রভৃতি পাঁচ ছটি অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল করা হয়।

বরিশাল কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা

এইসময়ে বরিশাল কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধাদান করেন মুসলমানরা, পুজো করা চলবে না বলে জানান। এবং অবশেষে কলেজের মধ্যে পুজো না করে হিন্দু ছাত্ররা তাদের হোস্টেলের মধ্যে পুজো সম্পন্ন করেন। সতীন চাননি হিন্দুরা ভয়ে সরস্বতী পুজো করা বন্ধ করে দেয়। তিনি পুজো করার পক্ষে ছিলেন, এবং হিন্দু ছাত্রদের উৎসাহ ও পরামর্শ দেন, সাধ্যমত সাহায্য করেন। এদিকে শান্তিভঙ্গ হয়েছে এই অপরাধে সমস্ত হিন্দু ছাত্রদের পুলিস গ্রেপ্তার করে, ততক্ষণে অবশ্য পুজো সম্পন্ন হয়ে গেছিল (মুখোপাধ্যায় ৬৮-৭১)।

পটুয়াখালী সত্যাগ্রহঃ প্রেক্ষাপট

পটুয়াখালীর মিউনিসিপ্যাল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে একই কায়দায় সরস্বতী পুজোয় বাধা দেওয়া হয়। মুসলমানদের আপত্তির কারণে স্কুল গৃহে না করে, পুজো সম্পন্ন করা হয় স্কুল প্রাঙ্গনে। পরের দিন সরস্বতী মূর্তির সামনে একটি গরুর কাটা মাথা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
এর পরেই সরস্বতী পুজোয় বিসর্জনের শোভাযাত্রা বন্ধের দাবী করা হয়। কারণ শোভাযাত্রা যে পথ দিয়ে যাবে, সেই পথে একটি মসজিদ ছিল (ঠিক সেই রাজপথের ওপরে নয়, রাজপথ থেকে বেরোনো একটি সঙ্কীর্ণ গলিপথের শেষ প্রান্তে ছিল এই মসজিদ)। মসজিদের প্রার্থনার সময় তার সামনে দিয়ে যাওয়া কোনও শোভাযাত্রায় কোনও বাজনা বাজানো হবে না, সতীন এই আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সরস্বতীর বিসর্জনযাত্রার অনুমতি দেওয়া হল না।
এরপর ১৯২৬ সালে অগাস্ট মাসে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় একদল মুসলমান হামলা চালায়, পুলিস এসে শোভাযাত্রা আটকে দেয়, এবং শুধু হিন্দুদেরকেই শান্তিভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
এর প্রতিবাদেই শুরু হয়েছিল পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ। নির্যাতিত হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত সতীনের কংগ্রেসী রাজনৈতিক জীবনে এক বিরাট বড় ঝুঁকি, সম্ভবত এই কারণেই তিনি বরিশালের বাইরে কংগ্রেসের কোনও বৃহত্তর দায়িত্ব জীবনে আর পান নি।
পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ

রোজ আইন অমান্য আন্দোলন করেন সতীন সেনের অনুগামী যুবকদল। এরা নিষিদ্ধ স্থানে অর্থাৎ মসজিদের “সামনে” দিয়ে শোভাযাত্রা করে যান রোজ, এবং এভাবে প্রত্যহ গ্রেপ্তার হন। এইরকমের আন্দোলন বেশ অভিনব, ভারতে আর হয়েছে বলে জানা যায় না। এই আন্দোলনে সতীনের তরুণ সহকর্মীদের মধ্যে মনোরঞ্জন পাল, আশু মুখার্জী, হরিপদ দাস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

১৯২৬ সালে গৌহাটিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। সেখানে গিয়ে সতীন পটুয়াখালীর ঘটনা রিপোর্ট করেন। পটুয়াখালীর মত প্রত্যন্ত স্থান যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা খুবই কম, সেখানে এরকম কর্মসূচী নেওয়া বিপজ্জনক বলে অনেকে মত দেন। প্রত্যন্ত পটুয়াখালীতে না করে, এই জাতীয় আন্দোলন কলকাতায় করার পক্ষেও কেউ কেউ বলেন। এই জাতীয় “ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ” দ্বন্দ্বকে অস্বীকার না করলে স্বাধীনতার জন্য মিলিত লড়াই করা যাবে না বলেও অনেকে জানান। সতীন প্রত্যুত্তরে বলেন, ছোট বড় প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ অগ্রসর হয়, কোনও অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না।

ধীরে ধীরে এই পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ বিশাল সাড়া ফেলল সারা ভারত জুড়ে। অমৃতবাজার পত্রিকার পীযূষকান্তি ঘোষ পটুয়াখালী গিয়ে এই সত্যাগ্রহের পক্ষে সমর্থন জানান, এবং বলেন, তিনি আবশ্যক হলে নিজের অস্থিগুলিও এই আন্দোলনের জন্য প্রদান করবেন। এইসময়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন সতীনকে নিয়ে অমৃতবাজারে, এবং সমস্ত শিক্ষিত বাঙালির কাছে সেই প্রথম সতীন সেন একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।

এরপরে পাঞ্জাব থেকে ভাই পরমানন্দ, ডাঃ মুঞ্জে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পটুয়াখালীতে আসেন। মাখনলাল সেন, অমর চট্টোপাধ্যায় পটুয়াখালী পরিদর্শন করেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের জন্য সুদূর জাপান থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মদন মোহন মালবীয়, লালা লাজপৎ রায়, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। বাংলার নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুভাষচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সুরেশ মজুমদার এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন।

সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, তার সম্পাদক প্রথমে ছিলেন জগদীশচন্দ্র সরকার, এবং তারপরে ক্ষিতীশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ক্ষিতীশ এই আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব বহন করেছিলেন। নির্মল দাশগুপ্ত ও তারাপদ ঘোষের ওপরে ছিল বরিশাল শহরে অর্থসংগ্রহ করা, কর্মসূচী পরিকল্পনা ও আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব। পটুয়াখালীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সতীনের অগ্রজ নগেন্দ্রবিহারী সেন বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন স্বামী জ্ঞানানন্দ, ইন্দু গুহ, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি। অন্ধ্রের শ্রীপঞ্চাঙ্গী ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের পক্ষে প্রচার করেছিলেন। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে মদন মোহন মালবীয়র আমন্ত্রণ আসে, তখন বরিশালের তরুণ উকিল মন্মথ দে’কে সতীন দিল্লিতে পাঠান। মন্মথ লালা লাজপৎ রায় ও মদন মোহন মালবীয়র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এবং এদের সমর্থন লাভ করেন।

এদিকে এই সত্যাগ্রহের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বরিশালের বিভিন্ন পল্লী অঞ্চল থেকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নানা আগ্রাসনের খবর আসতে লাগল। সতীন দ্রুত একটি তরুণদের দল গঠন করেন যারা আক্রান্ত হিন্দুদের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হয়, এবং সবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই দলে হীরালাল দাশগুপ্ত, দেবেন দত্ত, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, রবি রায়, ফণী চ্যাটার্জি, সুধীন সেন, দিলীপ দাস, নলিনী দত্ত, নারায়ণ ঘটক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিপদসঙ্কুল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অকুতোভয়ে অগ্রসর হতেন সতীনের অনুগামী বিপুল মুখোপাধ্যায়, কিরণ দে, সুধীর আইচ, টুক্‌কা-বড়কা দুই ভাই (মুখোপাধ্যায় ৮৫)।

সংখ্যায় খুব কম হলেও সঙ্ঘবদ্ধতা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে বরিশালের হিন্দুরা এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে তাদের হৃত আত্মসম্মান ফিরে পেয়েছিল।

পোনাবালিয়া হত্যাকাণ্ড

বরিশাল জেলার পোনাবালিয়ার শিবমন্দির ছিল একটি প্রাচীন শৈব পীঠস্থান। এখানে শিবরাত্রির সময় মেলা বসত। ১৯২৭ সালের শিবরাত্রির আগে মেলার প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, বরিশালের দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন জানা গেল যে শিবমন্দিরের ধার দিয়ে যে প্রশস্ত সরকারী রাস্তা গেছে, সেখানে অদূরেই একটি চালাঘরকে মসজিদ বলে ঘোষণা করে হয়েছে। ফলে হিন্দুরা শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে কোনওপ্রকার শোভাযাত্রা করতে পারবে না।

সতীন্দ্রনাথ যথারীতি হিন্দুদের শিবরাত্রি পালনের পক্ষেই মত দিলেন, এবং তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের পোনাবালিয়া পাঠালেন।
নোয়াখালি থেকে আগত এক মৌলবীর নেতৃত্বে একদল হিংস্র জনতা সেই তথাকথিত মসজিদে জড়ো হয়ে জিগির তুলতে থাকে। শান্তিরক্ষার জন্য একদল পুলিস সেই অঞ্চলে ছিল, এবং সেই রক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন জেলাশাসক ব্ল্যাণ্ডী।

উস্কানিপ্রদানের অভিযোগে মৌলবীকে শেষ মুহূর্তে গ্রেপ্তার করা হলেও, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। উত্তেজিত মুসলমানেরা ব্ল্যাণ্ডীকে উদ্দেশ্য করে বর্শা ছোঁড়ে, এবং এর উত্তরে পুলিস গুলিবর্ষণ করে। মোট ১৯ জন মারা যায়।

এর অব্যবহিত পরে পটুয়াখালী শহরে বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা হয়। পুলিস এই সময়ে পিটুনি কর বা পিউনিটিভ ট্যাক্স বসায় বেছে বেছে হিন্দু নাগরিকদের ওপরেই।

লাকুটিয়ায় দোলযাত্রায় বাধা

বরিশালের লাকুটিয়া গ্রামে প্রত্যেক বছর দোলযাত্রা উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা হত, এবার তার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। গ্রামবাসীরা সতীনের সাহায্য প্রার্থনা করেন, এবং সতীন গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ান। এর ফলে সতীনকে ফৌজদারী বিধানের ১০৭ ধারা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়, এবং জামিনের পরিমাণ ধার্য করা হয় ৫০০০০ টাকা, যার ফলে সতীনের জামিন মেলা অসম্ভব হয়ে যায়। জেলা জজের এজলাসে এই জামিননামার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়, এবং এক বাঙালি বিচারক মাত্র ৫০০ টাকা জামিনে সতীনকে মুক্তি দেন। এর পরপরই এই বিচারককে নোয়াখালিতে শাস্তিমূলক বদলি করে দেওয়া হয়। সতীনের জীবনীকার এই বিচারকের নাম উল্লেখ করেন নি।

এরপরে সতীনের বিচার হয় মহকুমা হাকিম জে কে বিশ্বাসের আদালতে। সতীনের পক্ষ সমর্থন করার জন্য মাখনলাল সেন ও কিরণশঙ্কর রায়ের সুপারিশে কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার বি সি চ্যাটার্জি আসেন।

এই মামলায় আসামী সতীন সম্পর্কে জে কে বিশ্বাস শ্রদ্ধাভিভূত হয়ে মন্তব্য করেনঃ A man of great magnetic personality and sterling morality। কিন্তু বিচারে রায় হয়, সতীনকে এক বছরের জন্য মুচলেকা দিয়ে আবদ্ধ/অন্তরীণ থাকতে হবে, অন্যথায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সতীন মুচলেকা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়।
এদিকে পিটুনি কর আগে থেকেই চলছিল পটুয়াখালীতে। এবার সতীনের সহযোগীদের বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা শুরু হল। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহকে গায়ের জোরে ভাঙতে বদ্ধপরিকর ইংরেজ সরকার এই সময়ে সতীনের সহযোগীদের মধ্যে অনেককেই ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন হীরালাল দাশগুপ্ত, দেবেন দত্ত, আশু মুখার্জী, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি, ফণী চ্যাটার্জি, শ্রীমন্ত ভট্টাচার্য, রবি রায়, বিনোদ কাঞ্জিলাল, দীনেশ সেন, সুরেন গাঙ্গুলী, রেবতী গাঙ্গুলী প্রমুখ আরও অনেকে। তারিখটা ছিল ২০শে মার্চ, ১৯২৮। পটুয়াখালী জুড়ে সত্যাগ্রহীদের অফিস ভেঙে দেওয়া হয়, প্রবল পরিমাণে দৈহিক অত্যাচার চলে সত্যাগ্রহে উদ্যত স্বেচ্ছাসেবকদের ওপরে। পটুয়াখালীর দুর্গম অবস্থানের জন্য প্রথম কয়েক মাস এইসব অত্যাচারের খবর কলকাতার সংবাদপত্রে পৌঁছয় নি।

বন্দীজীবন , প্রেসিডেন্সী জেলে অনশন, অবশেষে মুক্তি

সতীনকে সাধারণ কয়েদীর মত ঘানি টানতে বাধ্য করার প্রয়াস হয় প্রেসিডেন্সী জেলে। এর প্রতিবাদে সতীন অনশন শুরু করেন। এই অনশনের মধ্যেই বরিশাল থেকে ১১০ ধারায় বিচারের পরোয়ানা আসে এবং অনশনের ১৮তম দিনে অনশনক্লিষ্ট সতীনকে হাতে পায়ে শৃঙ্খল পরিয়ে কলকাতা থেকে পটুয়াখালী সাব জেলে নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টে ১০৭ ধারায় সতীনের শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল হয়, ও শুনানিসাপেক্ষে তার জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয়। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে ১১০ ধারাতেও বন্দী, কাজেই জেল থেকে ছাড়া তিনি পান না। এইসময় কংগ্রেস নেতা ও ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত সতীনের পক্ষ সমর্থন করছিলেন। এরপরে বিচারপতি সি সি ঘোষের এজলাসে ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার সতীনের জামিনে মুক্তির আবেদন করা হয়, এবং জাস্টিস ঘোষ মন্তব্য করেন, আদালত সতীনের ওপরে এই সরকারি “জুলুম” সহ্য করবে না। সতীন জামিনে মুক্তি পান। এইবারে তিনি মোট ৫৭ দিন অনশন করেন।
বরিশালের নতুন জেলা শাসক ডোনোভান প্রথমে গ্রেপ্তার ও দমন পীড়নের পথে হাঁটলেও ক্রমে বুঝতে পারেন, সতীনের সত্যাগ্রহীদের দাবিগুলি সঙ্গত। ১৯২৮ সালের ৭ই জুলাই জেলা বোর্ডের অফিসে হিন্দু মুসলমান উভয় পক্ষের নেতাদের উপস্থিতিতে স্থির হয় যে সমস্ত সরকারী সড়ক সর্বসময় সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সতীনের ও সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া হয়, সতীনও পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ঘোষণা করেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ এইভাবে অনেক ত্যাগ, বলিদান ও কষ্টশিকারের শেষে জয়যুক্ত হয়েছিল।

সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা

ব্রাহ্মদের পরিচালিত সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা আসে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সতীন এইসময়ে কলকাতায় ছিলেন, তিনি উভয়পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক সুরাহা করেন। এই সময় ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সুভাষচন্দ্র বসু দুজনেই সতীনের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রদের সবথেকে বেশি ভরসার স্থান ছিলেন সতীন, কারণ হিন্দুদের কথা সতীনের মত এমন সরাসরি আর কেউ বলতেন না।
বরিশালে সতীনের পুনরায় গ্রেপ্তারি ও মুক্তি

১৯২৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি একটি সরকারী প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের আপত্তি-বিক্ষোভ, ফলশ্রুতিতে পুলিসের নির্মম লাঠিচার্জ ঘটে। এর প্রতিবাদে বরিশালে পুনরায় আন্দোলন শুরু হয়। বরিশালের পুলিস কর্তা তখন কোলসন, ইনি পরে কলকাতার পুলিস কমিশনার হয়েছিলেন। দমননীতিতে বিশ্বাসী এই কোলসন ২৯শে জানুয়ারি তারিখে সতীন বরিশালে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় ১০৭ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। কিছুদিন পরেই অবশ্য এই মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, এবং সতীন মুক্তি পান।

১০৮ দিনের ঐতিহাসিক অনশন

 ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে বরিশাল শহরে জনাকীর্ণ কালীবাড়ী রোডে দারোগা যতীশ রায় নিহত হন। সন্দেহবশত চোদ্দ বছর বয়সী রমেশ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিস রমেশকে সতীনের অনুগামী বলে দাবি করে। সতীন পুনরায় ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলি অভিযোগ আনা হয়। ওদিকে রমেশ চক্রবর্তীর প্রথমে ফাঁসির হুকুম হলেও পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়, এবং রমেশ আন্দামানে প্রেরিত হন। প্রশাসন সমস্ত চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় হিন্দুদের ওপরে দমন পীড়ন শুরু করে, সমস্ত শোভাযাত্রার অধিকার পুনরায় কেড়ে নেওয়া হয়। সতীন এই অপমানের প্রতিবাদে বরিশাল জেলের মধ্যে অনশন শুরু করেন। তাঁর অবস্থা ক্রমে আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। এইসময়ে কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে সতীনের মুক্তিকামনায় এক বিরাট সভা হয়, সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি। এই সভায় আরেক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জেল ভেঙে সতীনকে ছিনিয়ে আনব। দুজন অধ্যাপকেরই এর ফলে কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু জনমত ক্রমশঃ তীব্র হয়ে ওঠে অনশনে মৃতপ্রায় সতীনের জন্য। এইসময়ে সুভাষ বসু এবং যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বরিশালে গিয়ে তাঁকে অনশন প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেন। তাঁরাই আন্দোলনের দায়িত্ব নেবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও দেন, ফলে সতীন অনশন তুলে নেন। কিন্তু তাঁরা প্রতিশ্রুতি পালন না করে, বরিশালকে অবহেলাই করছেন এমনটা দেখে সতীন পুনরায় অনশন শুরু করেন।

কথিত আছে এই সময়ে বাংলার আইনসভায় (কাউন্সিল) মুখ্যসচিব প্রেন্টিস বলেন, “Barisal is the Storm Centre and Satin Sen is the Stormy Petrel. The question of his release, even on bail, is fantastic” (মুখোপাধ্যায় ১২৫).
অনশন চলতে থাকে। পুরো বরিশাল এবং বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে, তাঁর মুক্তির দাবিতে অগণিত মানুষ বরিশাল শহরে মিছিল করে। সতীন সম্ভবত মারাই যেতেন (এই সময়েই লাহোর জেলে যতীন দাস দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশনের পরে মারা যান), কিন্তু তাঁর অগ্রজ হেমচন্দ্রের আকুল অনুরোধে তিনি ১০৮ দিন ধরে অনশনের পরে অবশেষে অনশন তুলে নেন।
এর পরেই পুলিসের পক্ষ থেকে তাঁকে মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। বিচারে সতীনের ৩০০০ টাকার জামিনদারি এবং তৎসহ তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। টাকীর জমিদার যতীন রায় চৌধুরী অযাচিতভাবেই এই ৩০০০ টাকা তৎক্ষণাৎ দিয়ে দেন। পরে সেই জামিন বাজেয়াপ্ত হলে পাবনার শীতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র নতুন জামিনদার হয়েছিলেন।

পুনরায় কলকাতা

১৯৩০ সালের জুন মাসে সতীন মেদিনীপুর জেল থেকে মুক্ত হয়ে কলকাতায় আসেন (আপিলে মুক্তি না জামিনে মুক্তি, সেটা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করে লেখেন নি)। এই সময়ে বাংলার কংগ্রেসে দুটি ছাত্র ইউনিয়ন ছিল, নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি (ABSA) এবং প্রাদেশিক ছাত্র সমিতি (BPSA)। এরা একযোগে স্কুল কলেজ বর্জন (বয়কট) আন্দোলন শুরু করে। প্রেসিডেন্সীর ছাত্রদের ওপরে নির্মম দমন পীড়ন ঘটে। ছাত্রনেতারা সতীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। সতীন এই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। এই সময়ে বিধান রায় সহ অনেকেই সতীনের সমালোচনা করেন। জুন মাসের শেষে পুলিস সতীনকে আবার গ্রেপ্তার করে, এবার অভিযোগ তিনি প্রেসিডেন্সীর ছাত্রদের রাজদ্রোহে উস্কানি দিয়েছেন।

পুনরায় বন্দীজীবন

সতীনের ওপরে জেলের মধ্যে ভয়ানক অত্যাচার হয়। তিনি জেলের মধ্যে আন্দোলন করবেন এবং কোর্টে যেতে অস্বীকার করবেন এরকম খবর পেয়ে পুলিসের সার্জেন্টরা তাঁর পা ধরে শায়িত অবস্থায় তাঁকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে সিঁড়ি দিয়ে টেনে নিচে নামায়, এবং সতীনের সর্বশরীর ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বন্দী ছাত্রদের ওপরেও এই সময়ে অকথ্য অত্যাচার চলে। এরপরে বিচারের প্রহসন করে সতীনের দেড় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়, এবং ১৯৩০ এর জুলাই মাসে তাঁকে দার্জিলিং জেলে পাঠানো হয়। দার্জিলিং জেলে থাকাকালীন কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা W C Bonnerjee এর এক মেয়ে, যিনি দার্জিলিং নিবাসী খ্রীষ্টান ছিলেন এবং মাঝে মাঝে জেল পরিদর্শন করতেন, সতীনকে একবার বলেছিলেন, যে সতীনের জীবনটি ক্রুশে বিদ্ধ (Your life is full of crucifixion).

মুক্তি ও কলকাতা বাস

১৯৩১ সালের মার্চ মাসে গান্ধী আরউইন চুক্তির ফলে আরও অনেকের সঙ্গে সতীনও মুক্তি পান। কিন্তু এই সময়ে তাঁর বরিশাল প্রবেশের ওপরে সরকার নিষেধাজ্ঞা চাপায়, ফলে তাঁকে কলকাতাতেই থাকতে হয়।

কলকাতায় তিনি উঠলেন তাঁর সহকর্মী ডাঃ প্রসূনচন্দ্র দাশগুপ্তের ১৯৫ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়িতে। তাঁর শরীর এইসময় রোগাক্রান্ত ও দুর্বল, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। অনবরত কারাবাস, অনশন, অমানুষিক অত্যাচার, জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে সতীনের শরীরে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে তখন। তাঁর প্লুরিসি, মাংসপেশীর দৌর্বল্য, অবশতা ও শক্তিহীনতা, অজীর্ণতা, টিবি ইত্যাদি নানা রোগ ধরা পড়ে। চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে তাঁর চিকিৎসা চলে। কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতিও তাঁর চিকিৎসা করেন।

কর্মচাঞ্চল্য থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারতেন না সতীন। এইসময়ে তিনি বিদেশী দ্রব্য বর্জনের জন্য একটি পিকেটিং এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই পিকেটিং বোর্ডের সভা বসত অ্যালবার্ট হল (আজকের কফি হাউজ) লাগোয়া কমিটি রুমে।
১৯৩১ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনে সতীন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন, এই সম্মেলনটি হয় কান্দী মহকুমা শহরে।

১৯৩১ এর হিজলী বন্দী নিবাসে পুলিসের গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে মনুমেন্টের পাদদেশে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে যে বিশাল প্রতিবাদসভা হয়, তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সতীন।

বিনা বিচারে বন্দী হলেন (১৯৩২-৩৭)

১৯৩২ সালে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। এবার সতীনকে BCLA আইনে বন্দী করা হয়, এবং দার্জিলিং জেলে পাঠানো হয়। এইসময় কলকাতা জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলনে সতীনের স্থাপিত পিকেটিং বোর্ডের নেতৃত্বেই মূল আন্দোলনটি ঘটে। প্রসূন দাশগুপ্ত, সুধীর দাশগুপ্ত, আশু মুখার্জী, নির্মল বসু, রবি রায়, মনি দত্ত, ইন্দু গুহ, মনীন্দ্র সমাদ্দার প্রমুখ এই পিকেটিং বোর্ডের নেতা ছিলেন। ১৯৩২ সালের জুন মাসে সতীনকে দার্জিলিং থেকে আনা হয় রাজস্থানের দেউলী বন্দী শিবিরে। তখন এখানে বাংলা থেকে বহু শত বিপ্লবীকে আনা হয়েছে উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে। অসম্ভব উত্তাপ, পানীয় জলের অপ্রতুলতা, স্নানের জলের সম্পূর্ণ অভাব, খাদ্যের অনটন, চিকিৎসার অমিল -সব মিলিয়ে এখানকার পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল যে বিপ্লবী মৃণাল কান্তি ঘোষ রজ্জুবন্ধনে আত্মহত্যা করেন।

এরপর ১৯৩২ এর ডিসেম্বর মাসে সতীনকে পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর ক্যাম্বেলপুর জেল। সেখানে স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতির পরে সতীন লাহোরের মেয়ো হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন, এরপরে আম্বালা জেলে প্রেরিত হন ১৯৩৫ সালের শেষের দিকে। আম্বালা জেলে জঘন্য পরিবেশে, খাদ্যাভাবে, চিকিৎসার অভাবে সতীনের স্বাস্থ্য পুনরায় খারাপ হয়ে যায়, এবং তিনি অব্যবস্থার বার বার প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও কোনও সুরাহা না হওয়ায় এক অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানাবেন স্থির করেন। তিনি লিখিতভাবে জানান যে জেলের অব্যবস্থা, জেল সুপারের কার্যাবলীর প্রতিবাদে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে জেলের ভেতরে একটি পরিত্যক্ত ক্ষুদ্র গৃহে অগ্নিপ্রদান করবেন।

তিনি সত্যিই আগুন লাগিয়ে জেলের মধ্যেকার সেই ছোট ঘরটিকে ভস্মীভূত করেন। এর ফলে সতীনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয় (উল্লেখ্য, এই সময়ে তিনি বিনাবিচারে বন্দী ছিলেন, কাজেই আদালতের মুখোমুখি হওয়ার এই ছিল তাঁর সুযোগ)।
এই মামলা ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে প্রত্যাহার করা হয়, এবং অগাস্ট মাসে তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে এনে প্রেসিডেন্সী জেলে আটক করা হয়। অনতিবিলম্বে তাঁকে অন্তরীণ করা হয় বীরভূমের মৌরেশ্বর থানায়। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তি পান।

কর্মযজ্ঞে পুনরায়

সুভাষের অনুরোধে এই সময় সতীন মুক্তিপ্রাপ্ত রাজবন্দীদের সাহায্যপ্রদানের জন্য তৈরি কমিটির দায়িত্ব নেন।
এরপরে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধী বনাম সুভাষ তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা গেলে সতীন এবং আরও কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের কাছে মধ্যস্থতা করার আর্জি নিয়ে উপস্থিত হন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কেও এই মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানান সতীন। অবশ্য এই মধ্যস্থতায় লাভ হয়নি। সুভাষ কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক স্থাপন করেন।
সতীন্দ্রনাথ এই সময়ে হরিদাস মজুমদার কর্তৃক বাংলা দৈনিক “কেশরী” পরিচালনার দায়িত্ব পান। তবে সেটি বেশিদিন চলেনি। এইসময়ে সতীন ও তাঁর সহকর্মীদের থাকার জন্য ১০৪ কলিন স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটবাড়ি বিনা ভাড়ায় ছেড়ে দেন হরিদাস। এই পত্রিকা পরিচালনের কাজে সতীন তাঁর এই সহকর্মীদের সাহায্য পান- বিনয় সেন, আশু মুখার্জী, নৃপেন্দ্র সেন, প্রসূন দাশগুপ্ত, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি, দীনেশ সেন।

কিছুটা একাকী

দীর্ঘদিন কারাভ্যন্তরে থাকার ফলে সতীনের কোনও কোনও সহকর্মী তাঁর থেকে কিছুটা দূরে চলে যান। হীরালাল দাশগুপ্ত, নৃপেন সেন, সুকুমার সেন প্রমুখ কমিউনিস্ট হয়ে যান, আবার নির্মল ঘোষ, কেদার সমাদ্দার, দেবেন দত্ত, কিরণ রায় চৌধুরী হয়ে যান সতীন বিচ্ছিন্ন গান্ধীবাদী (জীবনীকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছেন না, সম্ভবত এরা কংগ্রেসের ভেতরে অন্য কোনও গোষ্ঠীতে যোগদান করেছিলেন)।

ভোলায় বন্যা

১৯৩৯ সালে বরিশালের মূলত মুসলমান অধ্যুষিত ভোলা মহকুমায় ব্যাপক বন্যা হয়। সতীন এইসময় সর্বশক্তি নিয়োগ করে ত্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৪০-৪২: আবার বন্দী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধপ্রয়াসে সহযোগিতা করার নামে ইংরেজ সরকার বরিশাল জেলায় অর্থবান নাগরিকদের কাছ থেকে জোরজুলুম করে চাঁদা তুলছিল, সতীন এর প্রতিবাদ করেন। সরকার এর ফলে আদায়ীকৃত চাঁদার কিছুটা অংশ অনিচ্ছুক দাতাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু সতীনকে ভারতরক্ষা আইনে তিন মাসের জন্য জেলে পুরে দেয়।
আবার বন্দী হলেন

১৯৪২ সালের ১৩ই অগাস্ট কলকাতাস্থ কলিন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে সতীন গ্রেপ্তার হন ভারতরক্ষা আইনে। শ্যামাপ্রসাদ তখন বাংলার মন্ত্রী, শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার শাসন চলছে। এইসময়ে সতীনের সঙ্গে যাঁরা প্রেসিডেন্সী জেলে ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রফুল্লচন্দ্র সেন পরবর্তীকালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। এইসময়ে সতীনের উদ্যোগে জেলের ভেতরে রাজবন্দীরা ন্যূনতম খাদ্য গ্রহণ করা শুরু করেন, এবং উদবৃত্ত খাদ্য অসহায় অনাহারগ্রস্ত মানুষের জন্য বাইরে প্রেরিত হয়, এই ব্যবস্থার ফলে প্রেসিডেন্সী জেলের ভেতরে তাঁদের পাকশালার নাম হয়েছিল রিলিফ কিচেন।

১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
দেশভাগের আগে ও পরেঃ ১৯৪৫-১৯৫০

জেল থেকে বেরোনোর পরে সতীন বরিশালের কলসকাঠি গ্রামে একটি গান্ধী আশ্রম স্থাপন করেন, এবং এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁর অনুগামী নির্মল ঘোষ, কেদার সমাদ্দার, কিরণ রায় চৌধুরী, বিনোদ কাঞ্জিলাল।

১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সতীন বরিশালের হিন্দু তপশীল যুক্ত নির্বাচন কেন্দ্রে ৪৮০০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন, ওই একই কেন্দ্র থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ২৮০০০ ভোট পেয়ে তপশীলী হিসেবে নির্বাচিত হন।
সতীন ছিলেন পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধী। কিন্তু বরিশাল কংগ্রেসে দেশভাগের প্রস্তাব পালিত হয়, সতীনের জীবনীকার জানাচ্ছেন যে সতীনের অনুপস্থিতিতেই নাকি এই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল (মুখোপাধ্যায় ১৭১)। যাই হোক, সতীন দেশভাগ মেনে নেন, প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন নি, কিন্তু তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। তিনি বলেছিলেন, যতক্ষণ পূর্ব পাকিস্তানে এক জনও হিন্দু আছে, তিনি ভারতে যাবেন না (মুখোপাধ্যায় ১৭১)।

পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় হিন্দু নেতাদের দেশত্যাগের ফলে সেখানকার হিন্দু জনসাধারণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এই সময়ে সতীনের কাজ ছিল হিন্দুদের ওপরে অত্যাচারের খবর পেলেই তার প্রতিবিধানের জন্য সরকারী কর্তাদের দ্বারস্থ হওয়া। সতীনের জীবনীকার অনেক চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের সেই নায়কের আজ এই অসহায় দশাকে ঢাকতে পারেন নি।

“১৯৫০ সনের মধ্যভাগে বরিশাল জিলার পল্লী অঞ্চলে সুপরিকল্পিতভাবে এক ব্যাপক লুণ্ঠন, গৃহদাহ নারীহরণ ও হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান শুরু হইল! সে বীভৎসতার চিত্র অঙ্কিত না করাই শ্রেয়” (মুখোপাধ্যায় ১৭৬)।

এইসময় স্থানীয় জেলাশাসক সতীনকে ডেকে তাঁকে এই মর্মে একটা লিখিত বিবৃতিতে সই করতে বলেন যে বরিশালে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে, কেউ যেন গুজবে কান না দেন। সতীন সরাসরি অস্বীকার করেন, ফলে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হয়। জীবনীকার তারিখ দেন নি, তবে মনে হয় এই গণহত্যা শুরুর পরপরই ঘটনাটি ঘটে।

১৯৫০ সালের গণহত্যা সম্পর্কে কিছু কথা

এই ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ আজও করা হয় নি। জানা যায় যে আগে ঢাকায় এই হত্যালীলা শুরু হয়, তারিখটি ছিল ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫০। এবং তারপরে বরিশালে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে। পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ও বরিশালের নেতা যোগেন মণ্ডল পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসে যে পদত্যাগপত্র পাঠান, তাতে তিনি মৃতের সংখ্যা ১০০০০ বলে উল্লেখ করেন, আহত ও ধর্ষিতার পরিসংখ্যান না থাকলেও তা যে আরও বেশি ছিল ধরে নিতে অসুবিধে নেই।
দীনেশ সিংহের এ বিষয়ে প্রামাণ্য বইটি বলছে যে বরিশাল টাউন হলে সভা করে মুসলমান নেতৃবৃন্দ সতীন সেনের ওপরে চাপ দেন, তিনি যেন পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান নির্যাতন নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে কিছু বলেন (৩৮)। বোঝা যাচ্ছে এই কল্পিত ‘নির্যাতন’ নিয়ে সতীনের কিছু না বলতে চাওয়াটাও পূর্ব পাকিস্তানের শাসকপক্ষকে ক্রুদ্ধ করেছিল।

পাকিস্তানে বন্দীজীবন

সতীন সেন প্রথমবারের জন্য “স্বাধীনতা”র পরে জেলে বন্দী হলেন, ইংরেজের কারাগারে বহুবছর কাটানোর অভিজ্ঞতার থেকে অবশ্য এই অভিজ্ঞতা বেশ খানিকটা আলাদা। তিনি এই সময় পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, “কিন্তু তাঁহাকে রাখা হইল জেলের নিকৃষ্টতম ক্ষুদ্র কুটুরীর মধ্যে – না ছিল আলো-বাতাস বা অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা। ছিল অখাদ্য আহার, কঠিন শয্যা, দারুণ গ্রীষ্ম ও মশার উৎপাতে নিদ্রাহীন রজনীযাপন। ইহারই মধ্যে তিনি ৮ মাসকাল অতিবাহিত করেন” (মুখোপাধ্যায় ১৭৭)।

ছাড়া পেলেন

সতীনকে মুক্তি দেওয়ার পরে ১৯৫১ সালে তাঁরই নেতৃত্বে একটি পিস মিশন কলকাতায় পাঠানো হয়, “বিভিন্ন কলোনীতে ভ্রমণ করিয়া দেশে পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তনের জন্য প্রত্যেক বাস্তুত্যাগীর নিকট তাঁহারা আন্তরিক আবেদন জানাইলেন” (১৭৮)। এই বিবরণটি কৌতুহলোদ্দীপক। এ থেকে ভাবা যেতে পারে যে সতীনের মধ্যে একটা আদর্শবাদ কাজ করছিল। এছাড়া, সতীন নেহরু নিয়াকত চুক্তির সাফল্যের সম্ভাবনায় সম্ভবত বিশ্বাসী ছিলেন (শ্যামাপ্রসাদ যাতে আস্থাহীন ছিলেন, এবং পাঞ্জাবের মডেলে পপুলেশন ট্রান্সফার বা জনবিনিময় চেয়েছিলেন), নয়ত উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলতেন না। অথবা, তিনি ভেবেছিলেন হিন্দুরা আবার ফিরে গেলে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হবে, ফলে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে।

আবার বন্দীজীবন

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সতীনের কোনও যোগ ছিল না, কিন্তু তাও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং প্রথমে বরিশাল জেল, তারপরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল ও সবশেষে বগুড়া জেলে রাখা হয়েছিল। এক বছর কারাবাসের পর তিনি যখন মুক্তি পান, তখন বগুড়া জেলের গেটে তাঁকে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সম্বর্ধনা জানানো হয়।

শেষ কারাবাস ও মৃত্যু

সতীনকে ১৯৫৪ সালের ১লা জুন পটুয়াখালীর স্বগৃহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, পাঠানো হয় রংপুর জেলে। এই কারাবাসকে সতীন একটা সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন, কারণ তরুণ বাঙালি মুসলমান নেতাদের অনেকে জেলে তখন। তিনি ডায়রিতে লেখেনঃ “প্রধান কর্ম্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশ্রিত হইবার সুযোগ হইল। ইহার ফল কর্মক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হইতে পারে। Suffering এর পথে এদের দীক্ষা হইল মাত্র সুরু (sic)” (মুখোপাধ্যায় ১৯২)। সতীনের মত এমন আদর্শবাদ ও আশাবাদ অবশ্য সবার ছিল না। “একদিন কথাপ্রসঙ্গে একজন বন্দী তঁহাকে বলিয়াছিলেন – ‘মুসলমানদের দেশে Civil Liberty সম্ভব নয়, Democracy অসম্ভব, democratically minded লোক টিঁকিতে পারে না’” (মুখোপাধ্যায় ১৯৩)।

সতীন ২২শে নভেম্বর ১৯৫৪ তারিখে একটি চিঠি লেখেন ঢাকার স্বরাষ্টর দপ্তরে। তিনি জানান, তাকে বিপজ্জনকভাবে টিবি রোগীদের ওয়ার্ডের ঠিক তলায় রাখা হয়েছে, এবং ছাদ ফুটো হয়ে ওপরের নোংরা জল অনবরত তার ঘরে পড়ছে, লাগোয়া রান্নাঘরটির অবস্থাও তথৈবচ (মুখোপাধ্যায় ১৯৮-১৯৯)। এইসময় তাঁকে ঠিকমত খেতে দেওয়া হত না। তাঁর শরীর এইসময় একেবারেই ভেঙে পরে, এবং তিনি আর সুস্থ হতে পারেন নি। ২৩শে ডিসেম্বর তাঁকে পাবনা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে গিয়ে তিনি ডায়রিতে লেখেনঃ
“রংপুর জেলে শেষের দিক দিয়া এই যে ঝাঁকানি – বেশই লাগিল। এই বয়সে – এই স্বাস্থ্যে, একেবারে একাকী এই সব issue লইয়া যে struggle টা করিলাম, তাহাতে এই বয়সে আমার অতিরিক্ত মানসিক স্বাস্থ্য, শক্তি, technique ইত্যাদির পরিচয় পাইতেও বেশ সাহায্য করিয়াছে, আমার সবলতা দুর্বলতা, আদর্শ ইত্যাদির পরিচয় আমি অনেকটা পাইয়াছি।”
“আমার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য যে মনোবল, সংকল্প, অধ্যবসায়, সাহস প্রভৃতির প্রয়োজন (সত্য ও অহিংসার দরকার) organisation আয়োজনের যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তাহার capacity আছে কি? Moslem majority সেখানে পাকিস্থানে তাহাদের চেনা, বোঝা, তাহাদের ধর্ম্ম, কৃষ্টি, ইতিহাস প্রভৃতি – সবলতা, দুর্ব্বলতা খুব ভাল করিয়া হৃদয় দিয়া, বুদ্ধি দিয়া, বুঝিয়া তাহাদের ভালবাসিতে হইবে।”

“এদের কল্যাণ চাই – এরা আমার অকল্যাণ চায় ভুলে, এতে এদেরই লোকসান। গান্ধীজীকে Jesus Christ কে তাহাদের স্বদেশবাদী হত্যা করিল। এই tragedy তো জীবনে আছে – একে boldly face করিতে হইবে। সুতরাং মানুষের এই পথ – এতেই দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণ” (মুখোপাধ্যায় ২০০-২০১)।

সতীনের অবস্থা যখন চূড়ান্ত রকমের আশঙ্কাজনক, তখন তাকে ঢাকা জেলে বদলির অর্ডার এল, ১৯৫৫ সালের ৫ই মার্চ। ১১ই মার্চ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে আনা হয়, এবং ১৩ই মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তাঁকে ভর্তি করা হয়।

“গুরুতর অসুস্থতার কারণে ১৯৫৫ সালের ১৩ই মার্চ তাঁকে ঢাকা জেল থেকে এনে ঢাকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হল এবং সেখানেই ২৫শে মার্চ রাত্রি দেড় ঘটিকায় একান্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গেল। সে সময় যদি নিজেদের লোক কেউ সেখানে উপস্থিত থাকতেন, তাহলে তিনি দেখতে পেতেন যে তাঁর নিষ্প্রান দেহের উপর পড়ে আছে একটি ‘রিলিজ অর্ডার’। তবে সেই অর্ডারটি back dated। তাঁর মৃত্যুর ২/১ দিন আগের date ছিল তাতে। এর অর্থ – তাঁর মৃত্যু বন্দী অবস্থায় ঘটে নি! মৃত্যুর সময় তিনি স্বাধীন-ই ছিলেন!

বুড়ি গঙ্গার তীরে ঢাকার শ্যামপুর শ্মশানে মোট ৬৯ জন শ্মশান বন্ধুর উপস্থিতিতে অকৃতদার সতীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি সেদিন কে করেছিলেন আজ আর তা ঠিক মনে পড়ছে না।” (ঘোষ ১৮১)।

“১১ই মার্চ ঢাকা জেল হইতে লিখিত তাঁহার শেষ পত্র শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার দাস মহাশয় ১৮ই মার্চ পান। তাহাতে লিখিত ছিল সতীন্দ্রনাথের সহিত অবিলম্বে সাক্ষাৎ করিবার কথা। অবশ্য তিনি সতীন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান ২৫শে মার্চ রাত্রি এগারোটার সময় – যখন সতীন্দ্রনাথ ছিলেন মরণের প্রতীক্ষায় অচৈতন্য। একজন আই বির লোক তাঁহাকে সংবাদ দিল যে সতীন্দ্রনাথকে মুক্ত করা হইয়াছে, এখন হাসপাতালে দেখিতে যাইতে পারেন। অচৈতন্য সতীন্দ্রনাথকে তখন oxygen দেওয়া হইতেছিল। তাঁহার বুকের উপর সাদা কাগজে হস্তলিখিত একটুকরা কাগজে তাঁহার মুক্তির সংবাদ লিখা ছিল, যখন এই তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় তখন তিনি ছিলেন জ্ঞানহীন – শেষ নিশ্বাসের প্রতীক্ষায়। রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকার সময় তাঁহার শেষ নিশ্বাস মহা অনন্তে মিলাইয়া গেল। শেষ মুহূর্ত্তে শয্যাপার্শ্বে কেহ ছিল না, কেহ দেখিলনা, কেহ চোখের দুই ফোঁটা অশ্রু পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন করিতে পারিলনা।” (মুখোপাধ্যায় ২০৬)।

শোনা যায়, সতীনকে তাঁর শেষ সময়ে দেখে কৌতূহলী ডাক্তারির ছাত্র ও সেবিকারা প্রশ্ন করেছিল, আপনার কি কেউ নেই? (মুখোপাধ্যায় ২১০)। সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানে অবশিষ্ট হিন্দুরা সাহস করে সতীনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারত না, পাছে তারাও গ্রেপ্তার হয়ে যায়। তবে ঘোষ বা মুখোপাধ্যায় কেউ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেননি যে এতবড় নেতার শেষ দিনগুলিতে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মত কাউকে পাওয়া গেল না কেন।

শেষ প্রহসন অবশ্য বাকি ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ২৬শে মার্চের একটি প্রেসনোটে বলেনঃ “অসুস্থতার জন্য শ্রী সতীন্দ্রনাথ সেনকে গতকল্য (২৫শে মার্চ) মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির অব্যবহিত পরেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া শ্রীযুত সেনের মৃত্যু হয় – ইহা খুবই দুঃখের সংবাদ এবং গভর্ণমেন্ট এজন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন।”

কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে মৃত্যু শংসাপত্র দেন, তাতে লেখা ছিল, Satindra Nath Sen, Security Prisoner, C/o Supdt, Dacca Central Jail অর্থাৎ, এই মুক্তির ব্যাপারটা এমনকি নেহাত কাগুজে ব্যাপারও নয়। এটা সম্ভবত কাগজে কলমেও হয়নি, নয়ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সেই মুক্তির নির্দেশিকা থাকা উচিত ছিল, এবং ডেথ সার্টিফিকেটে তাকে বন্দী হিসেবে উল্লেখ করা প্রমাণ করছে যে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার স্রেফ মিথ্যাচার করেছিলেন ওই প্রেসনোটে।

পর্যালোচনা

সতীনের মৃত্যু অবশ্যই কাস্টোডিয়াল ডেথ পর্যায়ে পড়ে। তাঁকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, এ প্রসঙ্গে ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীরের জেলে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। তাঁর জীবন থেকে যেমন, তাঁর মৃত্যু থেকেও শেখার আছে। যে আদর্শবাদ ও আশাবাদের বশবর্তী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জেলে সতীনের এই মৃত্যুবরণ, তাঁর ওপরেই অনেক প্রশ্ন তুলে দেয় তাঁর শেষ দিনগুলির করুণ ইতিবৃত্ত।

সতীন সেন সংসারে ছিলেন সন্ন্যাসী, বললে অত্যুক্তি হবে না। সে সময়ে অনেক স্বদেশী কর্মীই কিন্তু সত্যি সত্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলেন, এমন অনেক উদাহরণ আছে। অনেকে অবশ্য সন্ন্যাসী হওয়ার পরে স্বদেশী কাজকর্মকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর বড় উদাহরণ। কিন্তু বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে এরকম আরও বেশ কিছু উদাহরণ স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেখা যায়। শরৎচন্দ্র সেন ছিলেন ভোলা অঞ্চলের বিখ্যাত আইনজীবী, তিনি প্রথমে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপরে সন্ন্যাস গ্রহণ করে হিমালয়ে চলে যান, নাম হয়েছিল স্বামী পূর্ণানন্দ গিরি (মুখোপাধ্যায় ১৭)।

বরিশাল কংগ্রেসের সম্পাদকের দায়িত্বে সতীনের ঠিক আগেই যিনি ছিলেন, সেই সর্বজনশ্রদ্ধেয় শরৎচন্দ্র ঘোষও ঠিক এভাবেই হঠাৎ করে বরিশাল ত্যাগ করে চলে গেছিলেন বৃন্দাবনে, নাম নিয়েছিলেন স্বামী পুরুষোত্তমানন্দ (মুখোপাধ্যায় ১৩০-১)।
সতীন যদিও সংসার করেন নি (কারণ বিয়ে করেন নি), কিন্তু সংসারকে ত্যাগও করেন নি, আমৃত্যু মানুষের পাশে থেকেছেন, বরিশালের মানুষের পাশে, বাংলার মানুষের পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থেকেছেন। তিনি সংসারের মধ্যে থেকেও সন্ন্যাসী ছিলেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, প্রত্যহ সকালে গীতা পাঠ করতেন সতীন (মুখোপাধ্যায় ১৮১)। কিন্তু সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি, রাজনীতির বেড়াজাল ছেড়ে বেরিয়ে যান নি, কারণ তিনি কর্মযোগী ছিলেন। এই কর্মনিষ্ঠার আদর্শের প্রয়োজন আজ আরও বেশি।

সতীন সম্পর্কে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলছেন যে উনি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। লিয়াকত আলি, পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আসেন এবং এক ঘণ্টা ধরে সতীনের সঙ্গে বার্তালাপ করেন, এবং লিয়াকত নাকি সতীনের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে পড়েন, এবং পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ হিসেবে বলেন, এখানে সতীন সেনের মত নেতাও থাকতে পারছেন (১৭৫-৭৬), বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় সতীনকে যখন গ্রেপ্তার করে পুলিস, জেলের মধ্যে নাকি মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিব ইত্যাদি সবাই সতীনের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন (১৮০)। এগুলো আশুতোষের বইয়ের শেষের দিকটাকে ভারাক্রান্ত করেছে। এগুলো সম্ভবত সতীনের পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়াকে ভ্যালিডেট ও জাস্টিফাই করার প্রয়াস।
কিন্তু সতীন যদি সত্যিই মুসলমান রাজনীতিবিদদের মুগ্ধ করে থাকেন, সেটা খুব একটা অবিশ্বাস্য মনে করার কারণ নেই। সতীন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি সমস্ত আলাদা আলাদা শিবিরের সম্মানভাজন হয়েছেন, এমন দুর্লভ সার্বজনীন স্বীকৃতি সম্ভবত আর কোনও বাঙালি রাজনীতিবিদের জোটে নি।

সতীন সেন বামপন্থী ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন।
“বরিশাল জেলায় কংগ্রেসি দেশপ্রেমিকদের মুকুটহীন রাজা ছিলেন সতীন্দ্রনাথ সেন, সার্বজনীন সতীনদা । বলা বাহুল্য সে মুকুট কণ্টকনির্মিত ।বয়ঃপ্রাপ্তির পর তাঁর পরিণত জীবনের অর্ধেকেরও বেশী কাটে জেলখানায় । শেষ দশ বছর কাটে পাকিস্তানি জেলে । সেখানেই যক্ষ্মারোগে বিনা চিকিৎসায় ওঁর মৃত্যু হয় । স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ভারতবাসী তাঁকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের পরিষদ ভবনে এবং লোকসভার দেওয়ালে ওঁর ছবি ঝুলছে । কলকাতায় এক চৌমাথার মোড়ে ওঁর আবক্ষ প্রস্তরমূর্তিও স্থাপিত হয়েছে । কিন্তু ওঁর এবং ওঁর সহকর্মীদের আড়ম্বরহীন আত্মত্যাগ, আজীবন দুঃখবরণ আমরা মনে রাখিনি । আমাদের সাম্প্রতিককালের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যে অনেকাংশে সেই ত্যাগের মূল্যে কেনা, এ চেতনা ক্ষীণ হতে হতে প্রায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে । (বাঙালনামা)

চিত্তাকর্ষকভাবে, অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সতীন্দ্রনাথকে তাঁদের নিজেদেরই একজন বলে মনে করতেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় অমলেন্দু ঘোষের “শতবর্ষের আলোকে বিপ্লবী সতীন্দ্রনাথ সেন” প্রবন্ধে (বিপ্লবীদের স্মরণে ও সান্নিধ্যে পুস্তকে সঙ্কলিত) ।
সতীন আজীবন যুগান্তর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সতীন ছিলেন যুগান্তরের নেতা অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী, কিরণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিকুমার চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীর আশীর্বাদ ধন্য। কংগ্রেসের নেতা হওয়ার পরেও তাঁর সঙ্গে যুগান্তর নেতা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ ও পূর্ণচন্দ্র দাসের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি বরিশালের অনুশীলন সমিতির নেতা যতীন রায়, গোপাল মুখোপাধ্যায়, দেবেন ঘোষ প্রমুখের সঙ্গেও সতীনের পারস্পরিক বিশ্বাসের সাবলীল সম্পর্ক ছিল, এবং একসঙ্গে বহুবার কাজ করেছেন (মুখোপাধ্যায় ১৮৫-৬)।

এদিকে সতীনের সহযোগী আশুতোষ মুখার্জি যে জীবনীগ্রন্থটি রচনা করেন, তার মুখবন্ধ লিখেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়।

একইসঙ্গে বিপ্লবী, কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের কাছ থেকে সাধুবাদ পেয়েছেন সতীন সেন। হিন্দুদের জন্য তাঁর অক্লান্ত আত্মত্যাগ মদন মোহন মালবীয়ের ন্যায় হিন্দু মহাসভার নেতাকেও মুগ্ধ করেছিলঃ তাঁদের সাক্ষাতের সময় তিনি নিজের আসন পরিত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে সতীনের উদ্দেশ্যে বলেনঃ Let us all honour the hero of Bengal (মুখোপাধ্যায় ১৩৬)। মনে করাই যায় যে নিপীড়িত হিন্দুদের হয়ে কথা বলার জন্য কংগ্রেসের ভেতরে সতীনের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়েছিল (অথচ সতীনের মত অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু মুসলমানে প্রকৃত সমদর্শী নেতা বিরল)। আশুতোষের মতে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পেছনে সময় না দেওয়াই এর কারণ – এবং বাস্তবিকপক্ষে এর সবগুলিই কারণ হতে পারে। সতীনের জীবনচর্যা ছিল সোজাসাপটা, হিপোক্রিট ছিলেন না তিনি, এজন্য রাজনীতিতে হয়ত বেমানান ছিলেন। শোনা যায় তিনি কলকাতার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগও রাখতেন না, তাঁর অন্তরঙ্গ নির্মলরঞ্জন দাশগুপ্তই সেই কাজটি করতেন (মুখোপাধ্যায় ১৩৩)। কংগ্রেসী রাজনীতিতে উঁচু পদ না পেলেও নিঃসন্দেহে সতীন সারা বাংলায় আপামর বাঙালির আশা ভরসার স্থল হয়ে উঠেছিলেন। দেশের জন্য এভাবে আত্মনিবেদন করতে সবাই পারেন না। সতীন পেরেছিলেন।

সতীন এজন্য এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি আজ আমাদের আদর্শ হতে পারেন।

সতীনের সমসাময়িক দুই রাজনীতিবিদ, বরিশাল থেকে উঠে আসা ফজলুল হক ও যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, সে তুলনায় সতীন উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। অথচ এই দুজনের সঙ্গে সতীনের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই, দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ সতীন করেছেন, তার কণামাত্রও এরা করেন নি। সতীন স্বার্থান্বেষণ করেননি কোনওদিন, যে কথা এই দুজনের সম্পর্কে বলা যাবে না।

দুর্ভাগ্য যে তাঁর নিজের লেখা কিছু পাওয়া যায় না, তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলছেন, তিনি ডায়রি লিখতেন। তাঁর লেখা শেষজীবনের ডায়রি থেকে উদ্ধৃতিও রয়েছে আশুতোষের জীবনীগ্রন্থে। তাঁর নিজের লেখালেখি, সাক্ষাৎকার, তাঁর সম্পর্কে আলোচনা সহ একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশ করলে আমাদের অকৃতজ্ঞতার ভার কিছুটা লাঘব হবে।

তথ্যসূত্র

তপন রায়চৌধুরী। বাঙালনামা
অমলেন্দু ঘোষ। বিপ্লবীদের স্মরণে ও সান্নিধ্যে
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুঞ্জয়ী সতীন সেন
দীনেশচন্দ্র সিংহ। ১৯৫০: রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং
সতীনের শুরুর জীবনের দীক্ষাগুরু স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বিষয়ে জানতে
বরিশালের শঙ্কর মঠঃ অতীত ঐতিহ্যের সমুজ্জ্বল সাক্ষর<http://bdn24x7.com/?p=6277>
বরিশালের শঙ্কর মঠ <http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2011-07-17/news/170905>