Monday 7 March 2016

সাংখ্য, দস্তুরমত দর্শন করলাম

তমাল দাশগুপ্ত 


সে এক দিন গেছে বাঙালির।

আজ্ঞে না, আমি উনবিংশ শতকের নবজাগরণের কথা বলছি না।

আমি আক্ষরিক অর্থে একটা দিনের কথা বলব। পুরো দিনটা নয় অবশ্য, একটা সন্ধে। সে এক সন্ধে ছিল বটে।

গঙ্গাসাগরে বালুকাবেলায় কপিল মুনির আশ্রম। সামনে বিস্তীর্ণ জলরাশি। সন্ধে হয়ে আসছে। চারটে মোটা মোটা বাঁশের খুঁটির ওপরে গোল করে একটা খড়ের চাল, অনেকটা বাংলার চারচালা মন্দিরের মত দেখতে লাগছে, আপনারা গোয়ায় বা অন্যান্য বিখ্যাত সমুদ্রতীরে গেলে যেমন দেখতে পান, তার থেকে কিছুটা আলাদা।

সেই সন্ধেবেলায় সেখানে অনেকে জড়ো হয়েছেন।  আলো আঁধারি, যেন সন্ধ্যাভাষায় লেখা কোনও আদিম, হারিয়ে যাওয়া গানের স্বরলিপির মত অস্ফুট আলো, তাতে সবার মুখই ঝাপসা, আবার খানিক দেখাও যাচ্ছে।

ওঁরা আমাদের পূর্বপুরুষ, আবার সবাই এক যুগেরও নন। সংখ্যায় ন’জন। সবাই অর্ধবৃত্তাকারে সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসেছেন, তবে এমনভাবেই বসেছেন যে সবাই সবাইকে দেখতে পাচ্ছেন।

ওঁরা কে কে, জিগ্যেস করবেন না। আমি ওঁদের মিটিং এর মধ্যে ছিলাম না, আমি ঘুরতে ঘুরতে ওই নির্জন বালিতীরে পৌঁছে গেছিলাম, ওঁরা আমাকে দেখেছিলেন, তবে গ্রাহ্য করেননি। আমি ওঁদের থেকে কিছুটা দূরে বসে ওঁদের আলোচনা শুনেছি। ওঁরা কথা বলছিলেন পুরোনো দিনের বাংলায়, অনেকটা চর্যাপদে যেমন শোনা যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম যতটা, ততটাই আপনাদের জানাবো, আজকের বাংলাভাষায়।

ওঁরা আমার কাছে নিজেদের অবশ্যই ইনট্রোডিউস করেননি। ওঁদের কথা শুনে, আর ওঁদের ঝাপসা হওয়া সিলুয়্যেট দেখে আমি ওদের এক থেকে নয়, প্রথমজন থেকে নবমজন অবধি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করেছি।

প্রথমজন বলছিলেনঃ যদি ধরেও নিই, এই কপিলের সাংখ্য থেকে আজকের গৌড়ীয়-বঙ্গীয় জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতি সবটাই এসেছে, তান্ত্রিক বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মই হোক, বা তার থেকে আসা দুর্গা কালী উপাসনা। সহজযানী বৌদ্ধধর্ম বা তার থেকে আসা বৈষ্ণবধর্ম।  সেক্ষেত্রে তার সমস্ত দোষ গুণ সবটাই কপিলকে নিতে হবে। চোখ বুঁজে শুধু কপিলকে পুজো করতে পারব না, পূর্বপুরুষ বলে ওঁর সাতখুন মাপ হতে পারে না।

দ্বিতীয়জনঃ এ নিয়ে বঙ্কিম নামের ছোকরা কি যেন একটা লিখবেন ইংরেজ আমলে, সেটাই পড়ো না হে ত্রিকালজ্ঞ, তোমার এত দীর্ঘ ভণিতার প্রয়োজন নেই।

“বঙ্কিম নামের ছোকরা কি যেন একটা লিখবেন” এই বাক্যবন্ধ শুনে আমি বিষম খেতে যাচ্ছিলাম, তবে সেটা কায়দা করে চেপে গেলাম। আমি কি তবে টাইম ট্রাভেল করে ফেলেছি। সমুদ্রতীর বরাবরই তো ট্রাভেল করছিলাম, টাইম ট্রাভেল তো করতে যাইনি। শিবরাম একবার বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন তাঁর একটা গল্পে, বাগবাজার থেকে ভবানীপুর অবধি হেঁটে, সেরকমই কিছু একটা করেছি না কি? হাতে চিমটি কেটে বুঝলাম, মরেও যাইনি, আর ঘুমিয়েও পড়িনি।

প্রথমজন কোথাথেকে একটা ঝকঝকে নতুন বঙ্গদর্শনের কপি ফস করে বের করলেন ওঁর ঝুলি থেকে। গড় গড় করে পড়তে লাগলেন, তবে ভাষাটাকে পালটে দিয়ে। ওঁদের মত পুরোনো বাংলা ভাষায়। আমার পড়া ছিল বঙ্কিমের এই লেখাটা, আমি সেখান থেকেই কোট করলামঃ
এ দেশীয় প্রাচীন দর্শন সকলের মধ্যে বঙ্গদেশে ন্যায়ের প্রাধান্য।  দেশীয় পণ্ডিতেরা সচরাচর সাংখ্যের প্রতি তাদৃশ মনোযোগ করেন না। কিন্তু ভারতবর্ষে সাংখ্য যে কীর্ত্তি করিয়াছে, তাহা অন্য দর্শন দূরে থাকুক, অন্য কোনও শাস্ত্রের দ্বারা হইয়াছে কি না, সন্দেহ। বহুকাল হইল, এই দর্শনের প্রকাশ হয়। কিন্তু অদ্যাপি হিন্দুসমাজের হৃদয়মধ্যে ইহার নানা মূর্ত্তি বিরাজ করিতেছে।  যিনি হিন্দুদিগের পুরাবৃত্ত অধ্যয়ন করিতে চাহেন, সাংখ্যদর্শন না বুঝিলে তাঁহার সম্যক জ্ঞান জন্মিবে না; কেন না, হিন্দুসমাজের পূর্ব্বকালীয় গতি অনেকদূর সাংখ্যপ্রদর্শিত পথে হইয়াছিল। যিনি বর্ত্তমান হিন্দুসমাজের চরিত্র বুঝিতে চাহেন, তিনি সাংখ্য অধ্যয়ন করুন। সেই চরিত্রের মূল সাংখ্যে অনেক দেখিতে পাইবেন। সংসার যে দুঃখময়, দুঃখ নিবারণমাত্র আমাদের পুরুষার্থ, এ কথা যেমন হিন্দুজাতির হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে, এমন বোধ হয়, পৃথিবীর আর কোনও জাতির মধ্যে হয় নাই। তাহার বীজ সাংখ্য দর্শনে। তন্নিবন্ধন ভারতবর্ষে যে পরিমাণে বৈরাগ্য বহুকাল হইতে প্রবল, তেমন আর কোনও দেশেই নহে। সেই বৈরাগ্য প্রাবল্যের ফল বর্ত্তমান হিন্দুচরিত্র। যে কার্য্যপরতন্ত্রতার অভাব আমাদিগের প্রধান লক্ষণ বলিয়া বিদেশীয়েরা নির্দেশ করেন, তাহা সেই বৈরাগ্যের সাধারণতা মাত্র। যে অদৃষ্টবাদিত্ব আমাদিগের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষণ, তাহা সাংখ্যজাত বৈরাগ্যের ভিন্ন মূর্ত্তি মাত্র। এই বৈরাগ্যসাধারণতা এবং অদৃষ্টবাদিত্বের  কৃপাতেই ভারতবর্ষীয়দিগের অসীম বাহুবল সত্ত্বেও আর্য্যভূমি মুসলমানপদানত হইয়াছিল। সেই জন্য অদ্যাপি ভারতবর্ষ পরাধীন। সেই জন্যই বহুকাল হইতে এ দেশে সমাজোন্নতি মন্দ হইয়া শেষে অবরুদ্ধ হইয়াছিল।
আবার সাংখ্যের প্রকৃতি পুরুষ লইয়া তন্ত্রের সৃষ্টি। সেই তান্ত্রিককাণ্ডে দেশ ব্যাপ্ত হইয়াছে। সেই তন্ত্রের কৃপায় বিক্রমপুরে বসিয়া নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ঠাকুর অপরিমিত মদিরা উদরস্থ করিয়া, ধর্ম্মাচরণ করিলাম বলিয়া চরম পরিতোষ লাভ করিতেছেন। সেই তন্ত্রের প্রভাবে প্রায় শত যোজন দূরে, ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশে কাণাফোঁড়া যোগী  উলঙ্গ হইয়া কদর্য উৎসব করিতেছে। সেই তন্ত্রের প্রসাদে আমরা দুর্গোৎসব করিয়া এই বাঙ্গালা দেশের ছয় কোটি লোক জীবন সার্থক করিতেছি। যখন গ্রামে গ্রামে, নগরে মাঠে জঙ্গলে শিবালয়, কালীর মন্দির দেখি, আমাদের সাংখ্য মনে পড়ে; যখন দুর্গা কালী জগদ্ধাত্রী পূজার বাদ্য শুনি, আমাদের সাংখ্যদর্শন মনে পড়ে।

এই পর্যন্ত পড়ে প্রথমজন থামলেন। কিছুক্ষণ সবাই চুপ।

এবার তৃতীয়জন গলা খাঁকারি দিলেন। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে গেল। তিনি বললেন, আমাদের বোধহয় কোথাও একটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। এই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তরুণটি যা লিখবেন, তা তো তার সময়ের ফসল। তার সময়ে পশ্চিমি সভ্যতা এসে শিক্ষিত বাঙালিকে গ্রাস করছে, পশ্চিমি ধরনের বিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে। তিনি নিজেই তো প্রথম পশ্চিমিবিদ্যায় স্নাতক। তা সেই সময়ে শিক্ষার অবস্থা কিরকম? মেকলে নামের ম্লেচ্ছটি বলছে, একদল পশ্চিমি বাঙালি তৈরি করতে হবে এ দেশে, যারা নিজেদের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করবে, চামড়ার রঙ তাদের যদিও বদলাবে না, কিন্তু মনেপ্রাণে তারা সাহেব হবে। এই সময়ে বিদ্যাসাগর নামের শিক্ষাবিদ কি বলছেন সাহেবদের? বলছে, সংস্কৃত পঠনপাঠন থেকে সাংখ্যের মত ভ্রান্ত ভারতীয় দর্শনগুলো তুলে দিতে।  তা তুলেও দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমিদের প্লেটো আর অ্যারিস্টটলও কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভ্রান্ত, তবে তা থাকছে সগৌরবে, খাঁড়া নামছে সাংখ্যের ওপরেই। সেযুগে ভারতীয় দর্শন ও ধর্মের প্রতি একটা বিরোধিতা বিরাজমান, কাজেই পশ্চিমি ধরনের শিক্ষিত লোকেদের জন্য তৈরি পত্রিকায় বঙ্কিম কি লিখছেন, সেটা কখনই আপ্তবাক্য হতে পারে না।

দ্বিতীয়জন একটু মিটি মিটি হেসে বললেন, হ্যাঁ হে, ত্রিকালজ্ঞ, তোমার কাছে কি এই বঙ্কিমের যাবনিক ভাষায় লেখা কাব্যখানি আছে, রাজমোহন’স ওয়াইফ না কি যেন?

প্রথমজন একটু গোঁজ হয়ে বললেন, ওখানা যাবনিক ভাষায় নভেল নামে পরিচিত, ওকে তারা কাব্য বলে না।

দ্বিতীয়জন বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, যাই হোক। তার একখানা বার করো দিকি।

রাজমোহন’স ওয়াইফ বেরল। বলব কি মশায়, একদম অক্সফোর্ড বুকস্টোর থেকে কেনা পেঙ্গুইন এডিশন বলে মনে হল, পেছনে বইয়ের দোকানের স্টিকারটা পর্যন্ত যেন স্পষ্ট দেখলুম। তবে আলো আবছায়াতে ভুলও হতে পারে।

প্রথমজনের ঝুলি তো নয়, যেন সেই রুশ উপকথার সৈনিকের ভূতের বরের জোরে পাওয়া থলে, থলের ভেতর আয় বললেই বিশ্বসংসারের যাবত বস্তু অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত থেকে চলে আসে। সন্দেহ হল, এই ঝোলাটাকেই দ্বিতীয়জন ত্রিকালজ্ঞ বলছেন না তো?

দ্বিতীয়জন খাবলা মেরে কপিটা নিয়ে বললেন, শুনুন সবাই। এই লেখাতে “গ্রিম, ব্ল্যাক ফিগার অভ কালী” আর “ক্র্যাব লাইক ফর্ম অভ দুর্গা” বলা হয়েছে। সাতাত্তর পৃষ্ঠায় দেখুন। তা কালী গ্রিম, ব্ল্যাক নাহয় কষ্টেসৃষ্টে বুঝলাম, কিন্তু দশভূজা দুর্গাকে কাঁকড়ার মত দেখতে, এর মানে কি? এর থেকে কি প্রমাণ হচ্ছে? বঙ্কিম সাহেবদের, আর সাহেবি কেতায় চলা বাঙালির মন রেখে চলতে চাইছেন না কি?

একটা মৃদু কোলাহল উঠল।  এতক্ষণে চতুর্থজন বললেন, শান্তি, শান্তি। বঙ্কিম ওঁর জীবদ্দশায় এই পুস্তকের প্রচার আর করবেন না, কারন এর পশ্চিমঘেঁষা আদর্শের সঙ্গে তাঁর ঘোরতর ঠোকাঠুকি বাঁধবে। আপনারা যে বইটি দেখছেন, এটা বঙ্কিমের মৃত্যুর অনেক পরে কয়েকজন সাহেবি বাঙালি বের করবে। তবে এ কথা সত্য যে বঙ্কিমকে পশ্চিমি কেতায় অভ্যস্ত শিক্ষিত বাঙালির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হয়ত সাংখ্য দর্শনের কিছু নিন্দাবাদ করতে হয়েছিল।

পঞ্চমজন বললেন, আমি মানি না এতে কোনও অযৌক্তিক, মন যোগানো নিন্দা আছে। বঙ্গদর্শনের বঙ্কিম পশ্চিমি কেতায় অভ্যস্ত পাঠকের কিছুটা মন যুগিয়ে চলেছে, মানি। কিন্তু এতে কি ভুল আছে? সাংখ্য কি প্রবল বৈরাগ্যের জন্ম দেয় নি? আচ্ছা, বলুন তো, একবিংশ শতকের বাঙালির জীবনে সবথেকে বড় সত্য কি?

প্রথমজন বললেন, এতে আর সন্দেহের কি আছে? অবশ্যই দুর্গাপুজো।

পঞ্চমজন বললেন, আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুন। আর কেউ কিছু বলবেন?

চতুর্থজন বললেন, বাঙালির কাঠিবাজিই তার জীবনের সবথেকে বড় সত্য। অক্ষম পলিটিক্স হল তার জীবনের সবথেকে মোক্ষম সত্য।

দ্বিতীয়জন মুখ মচকে বললেন, সবথেকে বড় সত্য সম্ভবত অমর্ত্য সেন আর সৌরভ গাঙ্গুলি। দুটি বই ল্যাজ মোর নাইরে।

তৃতীয়জন বললেন, না না, সে তো দু হাজার এগারো সালের আগের কথা। তার পরের থেকে বাঙালির জীবনের সবথেকে বড় সত্য হল মা মাটি মানুষ।

প্রথমজন বললেন, সেটা আবার কি? পরক্ষণেই সম্বিত পেয়ে ঝোলার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কি যেন বার করে আনলেন, ও সেটা দেখে বললেন, এ কি, এটা তো একটা যাত্রাপালা।

তৃতীয়জন কিঞ্চিত হাস্য করে বললেন, হ্যাঁ, ওই নামে একটা যাত্রা হবে বটে, সেখান থেকেই ওই নামটা চালু হবে, তবে সেটা আর কেউ মনে রাখবে না। তবে তুমি ওটা রেখে দাও, ফেলে দিও না। শুনেছি ওই যাত্রাপালার কোনও পাণ্ডুলিপি আর ত্রিভুবনে কোথাও পাওয়া যায় না।

এরপরে ষষ্ঠজন বললেন, বাঙালির জীবনের সবথেকে বড় সত্যি বোধহয় চাকুরিবৃত্তি।

সপ্তমজন একটু ফচকে মত মুখ করে বললেন, আমার ধারনা, ফুচকা আর তেলেভাজা।

অষ্টমজন বললেন, পেটুক কোথাকার। আমার তো ধারণা একবিংশ শতকের বাঙালির জীবনের সবথেকে বড় সত্য তার অবশ্যম্ভাবী অবলুপ্তি।

নবমজন একটু বিষণ্ণ মুখ করে বললেন, আপনারা এতটাই একপেশে, যে কেউ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছেন না।

পঞ্চমজন এবার বললেন, শুনুন, আমি বলছি, একবিংশ শতকের বাঙালির জীবনের সবথেকে বড় সত্য হল তার ল্যাদ, এই ল্যাদের ফলেই যে তার অবলুপ্তি ঘটতে বসেছে, সেটা অবশ্য সে জানে না, কাজেই সে মহানন্দে আরও ল্যাদ খাচ্ছে। এই ল্যাদের উৎপত্তিও সাংখ্যে। সেরেফ ওই দুর্গা কালী শিব আর রাধা কৃষ্ণের উৎপত্তি সাংখ্যে এটা বললেই হয়ে গেল?  না। বাঙালির ল্যাদের উৎপত্তিও যে সাংখ্যে, সেটাও আপনারা সবাই দেখুন। সাংখ্য বৈরাগ্যের জন্ম দেয়, আর ল্যাদ আধুনিক বৈরাগ্য ছাড়া আর কি? সাংখ্য কর্মযোগে বিশ্বাস করেই না, গীতার মত নিষ্কাম কর্মের কথা সে বলেই নি, নিজের কর্তব্য করে যেতে হবে ফলের আশা না করে, এরকম কথা সাংখ্য শেখায়নি, সে শুধু শিখিয়েছে, সংসার দুঃখময়, আর এই দুঃখের মধ্যে শুধু বিশুদ্ধ চিন্তা করে যেতে হবে, তবেই নির্বাণ। ল্যাদ হল সেই নির্বাণ। বাঙালির মহানির্বাণ ঘটেছে তার ল্যাদে, তার সাংখ্যে। যদি এখানে আর্যাবর্ত্মের মত কর্মযোগ শুরু হত, আপনারা দেখুন বেদ কি, গীতা কি, সে তো কর্মযোগ, যাগযজ্ঞ, অনবরত কাজ করে যাওয়া, ধনবৃদ্ধি, সাম্রাজ্যবৃদ্ধি, সন্তানবৃদ্ধি ইত্যাদি, তো সেই কর্মযজ্ঞ যদি বাঙালি পারত, তাহলে সে তো ব্যবসা করত, বিশ্বজোড়া নিজের শাসন চালাত। তার বদলে সে কি করে? সে ল্যাদ খায়।

রীতিমত কোলাহল শুরু হল। চতুর্থজন আবার বললেন, শান্তি, শান্তি।

সবাই থামলেন।

সপ্তমজন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, এই আলোচনায় একটু তেলেভাজার সঙ্গত হলে কেমন হত।

সবাই “সাধু, সাধু” বলে উঠলেন। অতএব এইবার প্রথমজনের ঝোলা থেকে প্রচুর তেলেভাজা বেরোলোঃ তাতে কি নেই? বেগুনি, ফুলুরি, পকোড়া, খাস্তা কচুরি, সিঙাড়া ইত্যাদি তো রয়েইছে, কিন্তু এতরকমের চপ কাটলেট আমি এর আগে একসঙ্গে দেখিনি।

জিভে জল এসে গেল। কিন্তু ওদের মিটিং এ আনা চপ কাটলেট চাইতে যাওয়া বেজায় হ্যাংলামি হবে ভেবে চুপ করে রইলাম।
এমন সময় শুনলাম, দ্বিতীয়জন বলছেন, আহা ওই একবিংশ শতকের মানুষটিকে আমাদের কিছু ভাগ দেওয়া উচিত। ওর সময়েরই তো খাবারদাবার, ওর নিশ্চয়ই লোভ হচ্ছে।

আমার সামনে দেখি একটা শালপাতার ঠোঙা ভর্তি করে তেলেভাজা চলে এসেছে।

খাওয়া চলতে লাগল, সেই সঙ্গে আলোচনা।

দ্বিতীয়জন বললেন, ল্যাদের বিষয়ে আমি একমত। ভালো কথা, এই শব্দের উৎপত্তি কি জানা আছে? আমার কিঞ্চিত কৌতুহল হচ্ছে।

প্রথমজন আবার ঝোলার ভেতরে হাত ঢোকাতে যাবেন, এমন সময় সপ্তমজন তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, আহা যা লয় দেয়, লয় প্রদান করে, তাই ল্যাদ।  ল যুক্ত য় যুক্ত দ, ইতি ল্যাদঃ। এতে আর বই দেখার কি হল। এই বস্তুটি বাঙালির লয় বা ধ্বংসের কারন, তাই একে ল্যাদ বলে।

তৃতীয়জন মাথা নেড়ে বললেন, উহুঁ, বিংশ শতকের বাঙালির মধ্যে সংস্কৃতচর্চা উঠে যাবে, ওদের মধ্যে যবন প্রভাবিত একদল লোক, তারা নিজেদের সাম্যবাদী বলে, তারা ক্ষমতায় এসে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে সংস্কৃতচর্চা প্রথমে ঐচ্ছিক করে, এরপরে কৌশলে প্রায় তুলে দেবে। এমন সময়ে বাঙালি শব্দচয়নে এতটা বেশি সংস্কৃত অনুসারী হতেই পারে না, অসম্ভব। আমার অন্য একটা সন্দেহ হচ্ছে। শব্দটি সম্ভবত দুষ্ট, এটি অপভাষা।

ষষ্ঠজন বললেন, এরকম একটা সন্দেহ আমারও হচ্ছে, তবে আমি অপভাষা শব্দটির প্রয়োগে ব্যথিত, বরং বলুন না কেন গণভাষা? এ তো গণমানুষেরই ভাষা। সে যাই হোক, সম্ভবত সাংখ্যের এই উদাসীন পুরুষ, প্রচুর আলস্যভরে সারাদিন ধরে নিজের লিঙ্গটিকে নিয়ে ঈষৎ নাড়াচাড়া করা ব্যতীত আর কোনও কাজ না করলে সেটাকেই ল্যাদ বলে। শব্দটি যৌনগন্ধী।
নবমজন একটু অপ্রস্তুত এই কথা শুনে, বললেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে। সাংখ্য এত পুরুষকেন্দ্রিক কেন? সাংখ্যে নারীর স্থান কোথায়?

প্রথমজন এই কথার উত্তরে কোনও কথা না বলে ওঁর ঝোলায় সটান হাত ঢোকালেন, আর এক এক করে পঞ্চাশটা ভারী ভারী বই বেরোলো, সেগুলো নবমজনের সামনে ধাঁই ধমাস শব্দে ফেললেন। আমি বইগুলোর নাম পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।

দ্বিতীয়জন বললেন, না হে ত্রিকালজ্ঞ, তুমি সাংখ্য নিয়ে একটা সংক্ষেপে বক্তৃতাই দিয়ে দাও। তোমার তো সবই পড়া।

প্রথমজন বললেন, বেশ আমি বলছি, শ্রবণ করুন।  প্রাচীন সাংখ্য কালগ্রাসে পতিত হয়েছে, এ কথা ষোড়শ শতকের ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু বলছেন।

তবে আমার কাছে সেই প্রাচীন সাংখ্য আছে যা ঋগবেদের সমসাময়িক কালে এই পুণ্ড্র-সুহ্ম-বঙ্গদেশে প্রচারিত হয়। এরপরে তার সংস্কার করে, তাকে প্রথম নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার কাজটি হয় মহর্ষি কপিলের দ্বারা, গঙ্গা ও সাগরের মোহনায়, এই এখানেই তাঁর আশ্রমে এই কর্মকাণ্ড সাধিত হয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, যে আমরা নিরীশ্বর সাংখ্যের কথা বলছি। পতঞ্জলির ঈশ্বরবিশ্বাসী যোগশাস্ত্রকে অনেকে সাংখ্য বলে, তার কারনও আছে, কারন সাংখ্যের সমস্ত মূল বিষয়ই সেখানে একরকম ভাবেই পুনরাবৃত্তি হয়েছে, শুধু তার ওপরে ঈশ্বরবিশ্বাসের কথাটি যোগ হয়েছে, তবে তার কথা এখানে বলা হবে না। এখানে বলে রাখা ভাল যে সাংখ্যের মূল বিষয়গুলি আরও অনেক শাস্ত্র গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে আয়ুর্বেদও আছে।
প্রাচীন সাংখ্য প্রকৃতি নির্ভর ও বস্তুবাদী, অর্থাৎ বস্তু থেকে চৈতন্য ও জীবন এসেছে এমনটা মনে করত, প্রাচীন সাংখ্যকে প্রকৃতিবাদও বলা চলে, তাতে এমনকি পুরুষও ছিল না প্রথমে, এই দুঃখনির্ভরতাও ছিল না, পরে পুরুষ যুক্ত হয়েছে, উদাসীন একটি তত্ত্ব হিসেবে, প্রকৃতির প্রাধান্যকে ক্ষুণ্ণ না করেই। আরও পরে যুক্ত হয়েছে বেদ বা শব্দের মান্যতা।
প্রকৃতি হল আমাদের চারপাশের জগত, জৈবজগত ও জড়জগত, তার মধ্যে এই মানবদেহ, মানবমন, সবই পড়ছে। সাংখ্য দর্শনের নাম এরকম, কারন সাংখ্য কয়েকটি সংখ্যায় সমস্ত জাগতিক পদার্থকে বিভক্ত করে। পরবর্তীকালে শেষমেশ যে সাংখ্যমত পাওয়া গেল, তাতে সমস্ত জাগতিক পদার্থ পঁচিশ রকমের।
১। পুরুষ
২। প্রকৃতি, একে অব্যক্তও বলা হয়েছে, কারন একে ব্যক্ত করা যায় না, সমস্ত সৃষ্টির মূল, জীব ও জড় জগতের সমষ্টি এই প্রকৃতি ভাষার ও বক্তব্যের অতীত
৩। মহৎ
মহৎ অর্থে মন অথবা বুদ্ধি
৪। অহঙ্কার
অহঙ্কার অর্থে “আমি” জ্ঞান, আমি বা আমার, এরকম ধারনা
৫ থেকে ৯। পঞ্চ তন্মাত্র, যারা হল শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ।
১০ থেকে ২০। একাদশেন্দ্রিয়। এর মধ্যে পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় অর্থাৎ বাক্‌ পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ। পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, অর্থাৎ চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক – এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে পশ্চিমের যাবনিক বিজ্ঞান অনেক পরে এই পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কথা জেনেছে এবং মেনেছে। এবং একটি অন্তরেন্দ্রিয়, যবনেরা একে রহস্য করে অনেকসময় সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে।
২১ থেকে ২৫। স্থূল ভূত, যারা হল ক্ষিতি, জল, তেজ, মরুৎ এবং আকাশ।
স্থূল ভূত থেকে একাদশেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমাদের পঞ্চ তন্মাত্রের জ্ঞান, মানে স্থূল ভূতই ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারা অনুদিত হওয়ার মাধ্যমে পঞ্চ তন্মাত্র হয়ে ধরা দেয়।
আবার আমি শুনি, তাই শব্দ আছে। আমি জ্ঞানের উৎস তাহলে পঞ্চ তন্মাত্র, আমি জ্ঞান আসছে পঞ্চ তন্মাত্র থেকে। অর্থাৎ পঞ্চ তন্মাত্র থেকে আসছে অহঙ্কার।
এই আমি জ্ঞানের জটিল বিন্যাসে গড়ে উঠছে আমার মন, বুদ্ধি বা মহৎ।
এই সমস্ত উপাদানই (৩ থেকে ২৫) প্রকৃতির অন্তর্গত। মন, জীবের আমি জ্ঞান, এ সমস্তই কিন্তু প্রকৃতির অন্তর্গত। অর্থাৎ জড়জগত থেকে জৈবজগত এসেছে, বুদ্ধি এসেছে, এটা সাংখ্য স্বীকার করে আদিকাল থেকেই।
প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংসর্গে দুঃখের উৎপত্তি, এ হল পরবর্তী স্তরের সাংখ্য। প্রথম স্তরের সাংখ্যে শুধু প্রকৃতি ছিল, এই গাঙ্গেয় দ্বীপ অঞ্চলের প্রকৃতি উপাসকদের দর্শন ছিল সাংখ্য। এর পরে সাংখ্যে পুরুষের ধারনা এল। পুরুষ কি? চেতনা বা আত্মা, যা বুদ্ধির বাইরে, যা মনসিজ নয়, যা এই ভৌতজগত থেকে জীবজগত তৈরির প্রক্রিয়ায় অনুঘটক, অনুঘটকের মতই সেও নিজে অব্যয়, অপরিবর্তিত।
এইখান থেকে সাংখ্য ভাববাদী হয়ে উঠল বলে অনেকে মনে করেন, চেতনাকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করেই পুরুষ প্রকৃতি দ্বৈতবাদের সূচনা হয়।
পরবর্তী সাংখ্য বলছে, পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংস্পর্শে জীবের উৎপত্তি। আবার পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগই দুঃখের কারন।
সাংখ্যে বলছে, জগত দুঃখময়, জীবন দুঃখময়। দুঃখ তিনরকমের। আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক।
একজন মানুষের ভেতর থেকে যে দুঃখের উৎপত্তি তাকে আধ্যাত্মিক দুঃখ বলে। এই দুঃখ দুপ্রকার, শারীর অর্থাৎ শারীরিক ও মানস অর্থাৎ মানসিক। বাত, পিত্ত ও শ্লেষ্মার তারতম্যের ফলে শারীরিক দুঃখ জন্মায়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয় না পাওয়ার ফলে মানসিক দুঃখ জন্মে।
আধিভৌতিক দুঃখ হল অন্যান্য মানুষ, পশুপক্ষী, স্থাবর ও জঙ্গম প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন দুঃখ।
আধিদৈবিক দুঃখ হল দৈব, নিয়তি ও গ্রহঘটিত কারনে যে দুঃখ আমরা পাই।
দুঃখের নিবৃত্তি হতে পারে শুধু পুরুষ প্রকৃতির সংযোগের উচ্ছিত্তি বা উচ্ছেদ ঘটালে। একেই বলে অপবর্গ, বা মোক্ষ।
এই মোক্ষলাভ হতে পারে শুধু বিবেকের দ্বারা। সাংখ্যে বিবেক অর্থে জ্ঞান।
প্রকৃতি-পুরুষসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষ অর্জিত হয়।
জ্ঞানেই মুক্তি।
এরও পরবর্তী স্তরের সাংখ্যে আনা হয়েছে বেদের মান্যতা, এ হল শেষ স্তরের সাংখ্য, বেদকে মান্যতা দিয়েছে বলে এই স্তরের সাংখ্যের উল্লেখ মহাভারত, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, মনুসংহিতা,  অনেকেই করেছে।
তবে শেষ পর্যন্ত একটা বিষয়ে কোনও সাংখ্যকারই বেদের সামনে নতজানু হননি, আপোস করেননি। নিরীশ্বরতা। আদি সাংখ্য নিরীশ্বর ছিল, বেদবিরোধী নাস্তিক ছিল। মধ্যস্তরের সাংখ্যে পুরুষ এল, কিন্তু তখনও সে নিরীশ্বর এবং নাস্তিক থাকল, শেষ স্তরে বেদে আনুগত্য এল, তখন আর সাংখ্য দর্শন নাস্তিক থাকল না, কারন নাস্তিক অর্থে বেদে অবজ্ঞা, নিরীশ্বরবাদী নয়, কিন্তু তখনও সাংখ্য নিরীশ্বর থাকল। সাংখ্যের সবথেকে বিখ্যাত উক্তি বোধহয় এই, ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ। ঈশ্বরের অস্তিত্বই অসিদ্ধ।
আমার আপাতত থামবার সময় হয়েছে, এ পর্যন্ত যা বলেছি, তার ওপরে আপনাদের যা জিজ্ঞাস্য আছে বলুন, প্রথমজন বললেন।

প্রথম প্রশ্নটা করলেন তৃতীয়জন।
বঙ্কিম ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে যে হিন্দু পুনরুত্থান শুরু করবেন, তার কতটা ভূমিকা এই সাংখ্য প্রচারের পেছনে? হিন্দু সভ্যতার মূলে বেদ নেই, উপনিষদ নেই, একমেবাদ্বিতীয়ম পরম ব্রহ্ম নেই, আছে সাংখ্যদর্শন, আছে সাংখ্যের দ্বৈতবাদ, এই কথা বলে কি বঙ্কিম ব্রহ্মবাদী, বেদান্তবাদী ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হানছেন, সাংখ্যের অস্ত্রে বঙ্কিম কি ব্রাহ্মদের মূল ধরেই ওপড়ানোর চেষ্টা করলেন?  আমরা জানি এর পরেই শুরু হবে ব্রাহ্মধর্মের বিরুদ্ধে হিন্দু পুনরুত্থান, ব্রাহ্মদের শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটবে তাতে।

বঙ্কিম নিরীশ্বর সাংখ্য থেকে হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা এসেছে বললেন। পৌত্তলিকতা ছিল সে যুগে সবথেকে ঘৃণিত একটি শব্দবন্ধ। কালী ও দুর্গা পুজোকে সাংখ্য নিরীশ্বরতার সঙ্গে যুক্ত করে বঙ্কিম কি সে যুগের পশ্চিম শিক্ষিত নাস্তিকতায় আচ্ছন্ন বাঙালিকে ডাক দিচ্ছেন, যে সে তার হিন্দু নিরীশ্বর শেকড়কে খুঁজে বার করুক? বঙ্কিমের লেখা কিন্তু সাংখ্যের বস্তুবাদের খুব কাছাকাছি, এবং বঙ্কিম কিন্তু বারবার তার নাস্তিক-নিরীশ্বর পাঠককে সম্মান দেখিয়ে এসেছেন, তাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং তার ওপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি, বরং তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক জরুরি স্তম্ভ হিসেবেই গণ্য করেছেন।

তবে বিজ্ঞানভিক্ষু তার টীকায় বলছেন যে আদি সাংখ্য নিরীশ্বর ছিল না, ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিল, আস্তিক ছিল। পরবর্তী কালে নিরীশ্বরতা এসেছে। এ প্রসঙ্গে এটাই বলার যে ষোড়শ শতকে বিজ্ঞানভিক্ষু বৈদিক প্রভাবকেই সত্য ও অনাদি ধরে নিয়ে কাজ করেছিলেন, তাই এই ভ্রান্তি হয়েছিল। সাংখ্যের ওপরে বেদের প্রভাব পরে এসেছে, এটাই ঐতিহাসিকভাবে যথার্থ প্রতীতি।

সপ্তমজন বললেন, সাংখ্যে বলে পুরুষ হল উদাসীন, প্রকৃতিই সব কাজ করেন, তিনিই কর্ত্রী। এই উদাসীন পুরুষকে তো বাংলার প্রকৃতির বাইরে ভাবাই যায় না। মাথার ওপরে মেঘলা আকাশ, পায়ের তলায় শ্যামলিমা, বীজ ছড়ালেই ধান, গাছে গাছে ফল, পুকুর নদীতে জাল ফেললেই মাছ, পুরুষ উদাসীন অর্থাৎ কি না অলস হওয়ার পুরো সুযোগই পাচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে না তো, তাই বসে বসে বা শুয়ে শুয়ে চিন্তার প্রচুর অবসর পাওয়া যাচ্ছে। সাংখ্যের জন্য বাঙালির ল্যাদ তৈরি হয়েছে, না বাঙালির ল্যাদের জন্য সাংখ্য দর্শন তৈরি হয়েছে? রুক্ষ পাহাড়ে, গহন, হিংস্র জঙ্গলে, শুকনো মরুভূমিতে সর্বময়ী প্রকৃতি ও উদাসীন পুরুষের এই দর্শন তৈরি হত?

চতুর্থজন বললেন, আমার বক্তব্য একটু দীর্ঘ হবে, শ্রবণ করুন।
আমরা জানি সাংখ্য থেকে বৈরাগ্য এসেছে। বুদ্ধ যখন সংসারত্যাগ করছেন, তখন পুরুষ প্রকৃতির সম্পর্কের এক প্রতীকী উচ্ছিত্তি ঘটছে, তাতে দুঃখ থেকে মুক্তির সূচনা হচ্ছে।
অর্থাৎ যা উৎসে ছিল প্রকৃতিনির্ভর দর্শন, সেখানে পরে বিবর্তনের ফলে প্রকৃতিই হল ত্যাজ্য। আমরা জানি বুদ্ধ প্রথমে তাঁর সঙ্ঘে মহিলা ভিক্ষুদেরও আনতে চাননি। যখন আনা হল, তখন তিনি বলেছিলেন, উইপোকা ধরলে কাঠ যেমন বেশিদিন টেকে না, মহিলারা এলে সঙ্ঘ আগে যতদিন টিকত তার থেকে কম টিকবে।
বক্তব্য হল, এই প্রবল বৈরাগ্য, এই অপবর্গ মোক্ষ যে কোনও জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। মহাযান বৌদ্ধধর্ম এইজন্যই হীনযানের থেকে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল, পৌরাণিক হিন্দুধর্ম এজন্যই বৌদ্ধধর্মকে হারিয়ে দিয়ে স্থান দখল করেছে। শূন্যমূর্তি বুদ্ধের উপাসনা করার থেকে অনেক দেবদেবীর উপাসনা অবশ্যই আমাদের দেশজ লোকায়ত সংস্কৃতির বেশি কাছাকাছি, সেটা একটা কারন বটে, কিন্তু মুখ্য কারন হল সংসারের প্রয়োজনীয়তা। কারন হল পরিবার, ঘরসংসার একটি জাতির একদম গোড়ার কথা। সবাই ভিক্ষু হয়ে গেলে সংসারধর্ম করবে কে, সন্তানাদি না হলে, বংশ লোপ পেলে পূর্বপুরুষ-পূর্বনারীর সংস্কৃতি কে ধরে রাখবে?
হরপার্বতীর মিলনে যে সংসার কল্পনা করেছে বাঙালির পুরাণ, যে দশভূজা দেবীকে বাঙালি প্রত্যেক বছর আবাহন করে, তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে আসেন। এই সংসারকল্পনা ছাড়া যে কোনও জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। দুর্গার কোলে ছোট্ট গণেশের ছবি বাঙালি জাতির কাছে অত্যন্ত প্রিয়, এজন্যই। লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে যে দুর্গার কল্পনা, তা বাঙালির আদি পরিবার (পরি)কল্পনা।
যেখানে বেদের স্তোত্র অনবরত বলে যাচ্ছে আমাদের ধন দাও, সুন্দরী স্ত্রী দাও, পুত্র দাও, যেখানে গার্হস্থ্য আশ্রম অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ জীবন-অধ্যায়, সেখানে সাংখ্য যদি বাঙালিকে সংসারধর্ম ত্যাগ করে মোক্ষের উপদেশ দিয়ে থাকে, তা কি গ্রহণীয়? তাতে কি বাঙালি অন্য জাতির থেকে পিছিয়ে যাবে না, যাদের শাস্ত্র সংসারধর্ম পালন ও সন্তান উৎপন্ন করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়?

পঞ্চমজন বললেন, আমার আগের বক্তা অত্যন্ত চমৎকার বলেছেন, আমি সেই সূত্র ধরে কয়েকটি আলোচনার উত্থাপন করছি। ভয় হচ্ছে যে আমার বক্তব্য দীর্ঘতর হবে, শ্রবণ করুন।
মহাযানী বৌদ্ধধর্ম কেন এসেছিল, উনি তাঁর সঠিক উল্লেখ করেছেন। বাংলায় মহাযানেরও পরে এসেছে বজ্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, যা এর পরে বাংলা থেকে তিব্বতাদি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। তারও পরে এসেছে সহজযান, বা সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম। আপনারা সাংখ্যের সঙ্গে এদের সম্পর্ক বিচার করে যদি দেখেন, বেশ চমকপ্রদ একটা ঘটনার সাক্ষী হবেন।
প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগই দুঃখের কারণ, এই সাংখ্যবাক্যটিকে মেনে নিয়েও প্রকৃতির উপাসনা করেছে তন্ত্র। প্রকৃতিকে সে শক্তি নামে জানে। পঞ্চ ম-কার দিয়ে যে বামমার্গী তান্ত্রিক উপাসনা বজ্রযানে প্রচলিত হল, মৎস্য মাংস মদ্য মুদ্রা মৈথুন, সেখানে কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের নিবিড় সম্পর্ক সূচিত হল, যদিও তান্ত্রিক উপাসনায় বাহ্যত ওই উচ্ছিত্তির বিষয়টি থাকে, কিন্তু বলা হয়, একমাত্র এই নিবিড় পুরুষ প্রকৃতি সম্পর্কের ভেতরে থেকে সাধনার ফলেই উদাসীন পুরুষকে, অর্থাৎ চেতনাকে জাগানো যেতে পারে। বঙ্কিম তাঁর কৃষ্ণচরিত্রে যেখানে ইন্দ্রিয়জয়ী ও নির্লিপ্ত পুরুষের উদাহরণ হিসেবে কৃষ্ণের বহু গোপিনীসংযোগ (কথাটা গোপী, কিন্তু গোপিনী বহুপ্রচলিত) ও বহুস্ত্রীগমনের কথা বলছেন, উনি কিন্তু আসলে তান্ত্রিক যুক্তিরই অবতারণা করছেন। সেকথা সরাসরি স্বীকার না করেই বা খেয়াল না করেই অবশ্য, তবে এর ফলে আবারও প্রমাণ হচ্ছে, যে বাংলার শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্ম একে অপরের সঙ্গে কি ভীষণ সম্পৃক্ত।
এরপরে বাংলায় যে সহজযান এল, সে তো প্রকৃতি পুরুষের নিবিড়তম সম্পর্কের মধ্যেই মোক্ষকে স্থাপন করল।
দেহভাণ্ডকে ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করল। মহাযান ও বজ্রযানের সাংখ্য উচ্ছিত্তির সঙ্গে বাহ্য আপোসকে অস্বীকার করে সহজযান এক বিপ্লব সূচিত করল। এই সহজিয়ারা বাংলার বাউলধর্মের উৎস, এরা বাংলার বৈষ্ণবধর্মের উৎস। রাধার পা ধরে যে কৃষ্ণ বলছেন গীতগোবিন্দে, দেহি পদপল্লবমুদারম, তিনি এই সহজিয়া কৃষ্ণ। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, প্রকৃতি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে নয়, প্রকৃতির প্রাধান্যের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণেই মোক্ষ।
একটা যাবনিক উদাহরণ টানার লোভ সামলাতে পারলাম না। আপনারা জানেন প্লেটো ও অ্যারিস্টটল নামে দুই দার্শনিক প্রাচীন গ্রীক দেশে ছিলেন, প্রথমজন পরেরজনের গুরু। প্রথমজন কবিতা ও সাহিত্যের খুব বিরোধী ছিলেন, কারন ওঁর বক্তব্য ছিল কাব্য বস্তুজগতের অনুকরণ করে, তাই কাব্য থেকে যে বাস্তবজ্ঞান পাওয়া যায়, তা যথার্থ নয়। এই প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল কি করলেন, তিনি ওই অনুকরণ নিয়ে বিশাল বক্তব্য রেখে প্রমাণ করলেন যে অনুকরণ – ওদের যাবনিক ভাষায় মাইমেসিস – কি প্রয়োজনীয় একটা জিনিস, আর মানবজীবনে অনুকরণের কি দারুন গুরুত্ব, অনুকরণের ফলে সৃষ্ট যে সাহিত্য তা কত ব্যাপ্ত। প্রথমজন কাব্য ও কবিকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন কারন তারা অনুকরণ করে, দ্বিতীয়জন কাব্যকে সম্মানের আসনে বসালেন, কারন কাব্য অনুকরণ করে।
একইভাবে প্রকৃতি থেকে উচ্ছিত্তি যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরীরা এসে প্রকৃতির সঙ্গেই সম্পৃক্তি চাইলেন। এ হল পুরো ব্যবস্থাকে উলটে দেওয়া, একেই বিপ্লব বলে।
কালীর পায়ের তলায় যে শিব শুয়ে আছেন, তিনিও সহজিয়া শিব, তবে এই মা কালীর মূর্তির সম্পর্কে আমি বলব যে বাংলার সমস্ত ধর্ম আন্দোলনের ইতিহাস, সমস্ত ধর্ম বিবর্তনের নির্যাস এই সাহসী কালী কল্পনায় ধরা আছে। ইনি আদি সাংখ্যের পরম পূজ্য প্রকৃতি হতে পারেন, ইনি পরবর্তী সাংখ্যের ও আদি বৌদ্ধধর্মের দুঃখদায়িনী প্রকৃতি বা শ্মশানকালী হতে পারেন। এই দেবী মহাযানের বরাভয়া দেবী হতে পারেন, তখন ইনি দক্ষিণাকালী। ইনি বজ্রযানের তান্ত্রিক উপাসনার লক্ষ্যবস্তু তো বটেই, তান্ত্রিকেরাই এই দেবীর প্রকৃত সন্তান, কিন্তু এই দেবী সহজিয়া ধর্মের মূল সুরটিকেও চমৎকার ফুটিয়ে তোলেন। আমায় একবার জয় মা কালী বলার অনুমতি দিন।
তবে, শেষ পর্যন্ত সহজযানও একটা বিষয়ে সাংখ্য ও বৌদ্ধধর্মের মূলনীতি অর্থাৎ বৈরাগ্য থেকে সরল না। বিবাগী হওয়া সংসার করার থেকে শ্রেয়স্করই থেকে গেল তাঁদের কাছে। এজন্যই সহজিয়া বাউল বৈষ্ণবেরা নরনারীর অবাধ প্রেমে যতটা ভরসা রাখলেন, সংসারধর্ম পালনে সেটা রাখলেন না। বজ্রযানী ও সহজযানী বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুণীরা যে বিবাহবহির্ভূত অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত হয়েছেন, তা বর্ণাশ্রমকে টলিয়ে দিয়েছে, ব্রাহ্মণ্য জাতিভেদের মূলোৎপাটন করেছে সত্য, কিন্তু বাঙালি জাতিকেও দুর্বল করে দিয়েছে, এজন্যই সেন রাজত্বে সনাতন ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পেরেছে।
আমি তাই এই বিষয়ে আমার পূর্ববর্তী বক্তার সঙ্গে একমত। মা দুর্গার পুজো বাঙালির জীবনে এজন্য এত বেশি প্রাসঙ্গিক। পুরুষ প্রকৃতি দ্বৈতবাদ থেকে উদ্ভূত আজকের শক্তিউপাসনায় সংসারধর্ম পালনের অনিবার্যতা মা দুর্গার পুজোয় ফুটে উঠচে। সংখ্যা কমে গেলে জাতি লোপ পায়, তখন আর সাংখ্য পড়েই বা কি লাভ?

এবার দ্বিতীয়জন বললেন সংসারধর্ম পালন দরকার। এই যে একবিংশ শতকের লোকটি কিছু দূরে বসে হাঁ করে আমাদের কথা শুনছে আর তেলেভাজা জুড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়ালও করছে না, তার একটা ভালো গুণ আছে, সে বিয়ে থা করে সংসার পেতেছে। ভালো ব্যাপার। কিন্তু এর জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাবেন, যে এ হল সংসারে এক সন্ন্যাসী। কথাটা প্রশংসাসূচক নয়, মানে এ বাড়ির কোনও কাজই করে না, বাজারহাট ইত্যাদি সমস্তই এর স্ত্রী করে। এ কেবল একটি গুরুকুলে পড়ায়, এদের যাবনিক ভাষায় তাকে কলেজ বলে, আর বাড়িতে বসে বই পড়ে, আর লেখালেখি করে। আর সপ্তডিঙা নামে একটা ব্যাপার বানিয়েছে, সেটার মাধ্যমে সে দেশোদ্ধার করে থাকে। এর স্ত্রীও কিন্তু  আরেক গুরুকুলে অধ্যাপনা করে, কিন্তু তার সঙ্গে সংসারের সমস্ত কাজও সেই করে, উপরন্তু সে তার বরকে তার লেখালেখির কাজে সাধ্যমত সঙ্গত দেয়। সাংখ্যের যে উদাসীন পুরুষের কথা বলছি আমরা, সেই অ-পদার্থ (ন্যাকা)চেতন বিবাগী পুরুষের এ এক ভাল উদাহরণ, এর স্ত্রীও সর্বময়ী প্রকৃতির প্রতীক, তা বলা যায়। তা বৈরাগ্যের ফলে সংসারধর্ম লাটে ওঠে আপনারা চমৎকার বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু সবাই যদি কর্মযোগী হয়, তাহলে হয়ত যোদ্ধা পাওয়া যাবে, হয়ত ব্যবসায়ী পাওয়া যাবে, কিন্তু চিন্তাবিদ কোথা থেকে আসবে? বাঙালি চিন্তাশীল বলে খ্যাত, সে তো তার ল্যাদের জন্যই। ওহে ত্রিকালজ্ঞ, এই ঝোলার ভেতর থেকে বের করো তো, বাঙালিদের নিয়ে চর্চার জন্যএই লোকটি কি যেন একটা পত্রিকা বের করে, যদিও সেটাতেও তার স্ত্রীর প্রভূত অবদান আছে, সেই পত্রিকাকে যাবনিক ভাষায় জার্নাল বলে।

ঝোলা থেকে এবার একটা ট্যাবলেট বেরোলো, আমি হাঁ হয়ে গেলাম আরও। এ ঝোলার জবাব নেই। আহা, ওটিকে গ্যাঁড়ানো গেলে কি ভালই না হত।

যাই হোক, সেই ট্যাবলেটে আমাদের অনলাইন জার্নাল দেখতে লাগলেন ওঁরা সবাই।

দেখা শেষ হলে দ্বিতীয়জন বললেন, প্রশ্ন হল, এই লোক যদি জ্ঞানযোগ না করে কর্মযোগ করত, তাহলে কি বাঙালির বিশেষ কোনও লাভ হত? কর্মযোগ করলে সম্ভবত এ একজন কর্মপটু লোক হত, এর স্ত্রী পরিবার সানন্দে থাকত, স্বচ্ছল থাকত। কিন্তু দেশের ও জাতির আদৌ কোনও লাভ হত? কয়েকজন ঘরের খেয়ে বনের মোষ যদি না তাড়ান, তাহলেও তো জাতি লাটে উঠবে, তাই না? বাংলায় অগ্নিযুগ বলে একটা বিপ্লবী আন্দোলন হবে। সেখানে অনেকে মিলে প্রাণ দেবেন, সে তো চরম বৈরাগ্যের উদাহরণ। সেটা না হলে দেশ যাবনিক শাসন থেকে স্বাধীন হবে মনে হয়? শুধু সবাই মিলে দেঁড়েমুষে সংসারধর্ম করল, তাতেই দেশ ও জাতি বাঁচে না। কয়েকজনকে সংসারের বাইরেটাও দেখতে হয়। এই লোকটা দেখেছে, আরও কয়েকজন দেখছে, তাই হয়ত বাঙালির কিছু উপকার হচ্ছে।

ষষ্ঠজন মুখ খুললেন। ওই অগ্নিযুগের প্রসঙ্গ ধরেই কিছু বলতে চাই। সাংখ্য নিরীশ্বর। আদি সাংখ্যে পুরুষ বা চেতনা বা আত্মাও ছিল না, শুধুই প্রকৃতিবাদ ছিল। দেহাতীত, প্রকৃতির অতীত চৈতন্যের কল্পনা পরবর্তী স্তরের সাংখ্যের। বেশ।
চার্বাক দর্শনও কল্পনার ধার ধারে না, শুধুই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। বেশ।
ঈশ্বরের কল্পনা, আত্মার কল্পনা ছাড়া মানুষের অসহায়তা কতটা উন্মোচিত হয়ে পড়ে সেটা কি আপনারা ভেবেছেন?
এক যাবনিক তাত্ত্বিক, তার নাম টেরি ইগলটন, তিনি বলছেন, যাঁরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মারা গেলেন, একমাত্র বিপ্লবী কল্পনা, যাবনিক ভাষায় রেভলিউশনারি ইম্যাজিনেশন, ছাড়া তাঁদের প্রতি ন্যায় করার আর দ্বিতীয় উপায় নেই। জীবদ্দশায় তাঁদের প্রতি চূড়ান্ত অন্যায় হয়েছে। তাঁরা শুধু কল্পনাতেই আবার জীবন ফিরে পেতে পারেন, তাদের মূর্তি গঠিত হতে পারে, তাঁরা স্বর্গ থেকে উত্তরপুরুষদের আশীর্বাদ করতে পারেন।
ঈশ্বরের কল্পনায় সম্প্রদায় গঠিত হয়, দেবীমূর্তির সামনে জড়ো হয়ে উপাসনার মাধ্যমে এই বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে।
ওই অগ্নিযুগের সময় বিখ্যাত হবে একটি কাব্যপংক্তি, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ করিবে যে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।
এখন, এটা তো কল্পনা। মরে গেলে তার পরে আর কিছু নেই, যে জন্য সাংখ্যে ঈশ্বর অসিদ্ধ, একই কারণে আত্মার অমরত্বও অসিদ্ধ হওয়া উচিত।
কিন্তু এই কল্পনায় রোমাঞ্চ আছে, এতে আশ্বাস আছে, এতে কবিতা আছে, এতে এক নির্যাতিত জাতির দীর্ঘশ্বাস রহস্যময় কালরাত্রির শিস হয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু থেকে মহাজীবনে উত্তরণের মহামন্ত্র আছে এই কল্পনায়। এই কল্পনা হল রেভলিউশনারি ইম্যাজিনেশন। যাঁরা প্রাণ দিলেন অকাতরে জাতির জন্য, তাঁদের ক্ষয় নেই, তাঁরা অজর, তাঁরা অমর, এই আশ্বাস না পেলে তো সে জাতি অভিশপ্ত।
ওই ইম্যাজিনেশন শব্দটি লক্ষ্য করুন, ওর ভেতরে নেশন শব্দটিও আছে, যাবনিক ভাষায় যার অর্থ হল জাতি। কল্পনা ছাড়া জাতি গঠিত হয় না, জাতি হল কল্পিত সম্প্রদায়, সেটা অনেক যবন তত্ত্ববিদই বলছেন। কল্পনা কিছু নিম্নস্তরের বিষয় নয়, আমরা সবাই ভাষার কল্পনা করেছিলাম, তাই আমরা সবাক, মূক নই। মানুষের সঙ্গে  এখানেই অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য। কল্পনা আমাদের মানুষ করেছে। আমরা কল্পনা করি যে অতীত হারিয়ে যায় না, কোথাও থেকে যায়, তাই পূর্বপুরুষ পূর্বনারীর আত্মার কল্পনা করেছি।  সভ্যতার মূলে আছে এই ধারাবাহিকতার চিরায়ত আকাঙ্ক্ষা, তাই এই কল্পনা ছাড়া মানুষ প্রায় জন্তুস্থানীয়।
অষ্টমজন বললেন, শেষ পর্যন্ত এই দেবীকল্পনা বাঙালিকে তার অবলুপ্তি থেকে বাঁচাতে পারবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। আমরা কিন্তু কেউই চিরন্তন নই, আমরা ত্রিকাল দেখিনি, আমরা শুধু অতীতের আবছায়া, আমরা কিঞ্চিত অহঙ্কারী তাই আমাদেরও পরে যে অতীত এসেছিল, তাকে ভবিষ্যৎ বলে উল্লেখ করছি, আসলে আমরা সেই সব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মত যারা বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের সময় বলেছিল, এমনটা যে হবে তা অতীতেই ভবিষ্যৎবাণী হয়ে গেছে।
আসলে ভবিষ্যৎ কেউ দেখেনি, তা পূর্বনির্ধারিতও নয়। আমরা তবু এই প্রপঞ্চ মায়া সৃষ্টি করি, এই বিভ্রম আমাদের আশ্বস্ত করে, আমাদের এক আশ্চর্য গরিমা দেয়। কোনও এক কালে বাঙালি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের অস্ত্র হাতে বঙ্কিম আসবেন সেটা আমাদের সময়ে আমাদের তো জানা ছিল না, তবু আজ আমরা ভাবছি, যে আমরা ত্রিকাল দেখে ফেলেছি, আমরা আসলে শুধু অতীত দেখেছি।
ঐতিহাসিক উপন্যাসে যখন লেখক একটা কাহিনী বলছেন, ঘটনাপরম্পরা সাজাচ্ছেন, তখন তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান, কারন তা আগেই ঘটে গেছে। সব সময় সেটা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার নয়, ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার অর্থ ভবিষ্যতের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া। যে চরিত্র পরাজিত, যেমন সীতারাম, বঙ্কিম তাকে চাইলেও জেতাতে পারবেন না, উপন্যাসে তার পরাজয় পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে। অতীতকে আর পালটানো যায় না, নতুন করে গড়া যায় না, ভবিষ্যৎকে গড়া যায়। আমরা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখকের মত ভবিষ্যৎ দেখেছি, আমরা আসলে অতীতের দ্বারা সীমাবদ্ধ।

প্রথমজন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এবার মুখ খুললেন।

আপনারা সবাই যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমি মোটামুটি একমত। যাঁরা প্রশ্ন করেছেন তাঁরা সবাই সেসব প্রশ্নের মধ্যে হয় উত্তর দিয়ে দিয়েছেন, নয়ত বিষয়টিকে ইচ্ছে করেই মুক্ত ও অনেকান্ত রেখেছেন। আমি কয়েকটি বিষয় যোগ করব। সাংখ্যের বৈরাগ্যে যে জ্ঞানযোগ রয়েছে, তা অনেকটাই কর্মযোগ হয়ে যায়, বিবেকানন্দের জীবন একটা উদাহরণ। দেশের জন্য যে সর্বস্বত্যাগ করে, সে কর্মযোগী নয়? তাছাড়াও সাংখ্য তত্ত্ব সবসময় প্রয়োগের দিকে একটা ঝোঁক ধরে রাখে। আয়ুর্বেদ, যোগশাস্ত্র, তন্ত্র ইত্যাদি এর প্রমাণ। যে আনুষ্ঠানিক বৈদিক ধর্মের বিরোধিতা করে সাংখ্যের জ্ঞানযোগের উৎপত্তি, বজ্রযানে দেখি সেই কর্মভিত্তিক, অনুষ্ঠানভিত্তিক ধর্মকেই ছাড়পত্র দেওয়া হল। অদ্বৈতবাদ আছে বেদে, সাংখ্যে দ্বৈতবাদ, আমরা বলি। কিন্তু শরীর ও মন দুইই প্রকৃতির অন্তর্গত, জড় ও জীবজগত দুইই সেই এক প্রকৃতির অন্তর্গত এই কথা বলে  সাংখ্যও কিন্তু একটা অদ্বৈতের দিকে যাচ্ছে, এক নিরীশ্বর অদ্বৈত। যাবনিক ভাষায় যাকে কার্টেজিয়ান দ্বৈতবাদ বলে, যা দেহ থেকে মনকে আলাদা ভাবে, সাংখ্য কিন্তু তার বিরোধী।
দোষেগুণে মিলিয়েই সাংখ্য, যেমন দোষেগুণে মিলিয়েই বাঙালি। বাঙালির গুণও এতে আছে, বাঙালির দোষও। সাংখ্যের গুণ বাঙালি পেয়েছে, সাংখ্যের দোষও। বাঙালির বিদ্রোহ সাংখ্যের বিবর্তনের ইতিহাসে ধরা আছে, বাঙালির আপোসও।
যতবার বাঙালিকে বিদেশী প্রভাব এসে জেঁকে বসেছে, সে খ্রীষ্টধর্ম প্রভাবিত অথচ বেদান্ত নির্ভর ব্রাহ্ম আন্দোলনই হোক,  আর একেশ্বরবাদী ইসলামই হোক,  বাঙালি তার শেকড় খুঁজে পেয়েছে বারবার শাক্ত ধর্মে, সহজিয়া ধর্মে, সাংখ্য দর্শনে। আজ আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন বা পশ্চিমি উদারবাদের প্রভাব বাঙালির ওপরে, বাঙালিকে আবার হয়ত সাংখ্যই শেকড় চেনাবে। অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচতে সাংখ্যই বাঙালির অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
সাংখ্য নিয়ে অনেক চুলচেরা আলোচনা আমরা করলাম। আজকের মত ইতি টানা যাক। রাত হয়ে গেছে, সমুদ্রযাত্রার সময় বয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়জন বিষণ্ণভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, গৌড়ান সমুদ্রশয়ান্‌। চলো, সমুদ্রে শয়ান যার, নিশিরে কি ভয় তার।

ওরা নজনই উঠলেন, তারপরে ধীরে ধীরে বঙ্গোপোসাগরের দিকে হেঁটে চলে গেলেন। অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না।

প্রথমজন ঝোলাটা রেখে গেছিলেন। পরে ঠাওর করে দেখলাম ওটা আমারই ঝোলা, ওর ভেতরের বইগুলো আমারই বুকশেলফ থেকে এসেছিল, আর তেলেভাজাগুলোর টেস্ট আমার শ্বশুরবাড়ি শ্যামনগরের ভাইটির চপের দোকানের মত।

No comments:

Post a Comment