Monday 7 March 2016

সতীন সেন

তমাল দাশগুপ্ত


অবিভক্ত বঙ্গের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ বৈদ্যবংশে সতীন সেনের (সতীন্দ্রনাথ সেন) জন্ম। তাঁর পিতামহের নাম রামসেবক সেন, পিতার নাম নবীনচন্দ্র সেন। নবীনচন্দ্র পটুয়াখালী মহকুমা আদালতে (বরিশাল জেলার অন্তর্গত) মোক্তারি করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। রামসেবকের জ্যেষ্ঠ পুত্র (নবীনচন্দ্রের দাদা) কৈলাসচন্দ্র ছিলেন সেই অঞ্চলের বিখ্যাত মোক্তার। সতীন্দ্রনাথ সেনের জন্ম কোটালিপাড়ার অন্তর্গত বাগান উত্তরপাড়া গ্রামে, ১৮৯৪ সালে, জীবনীতে তারিখের উল্লেখ নেই (জন্মতারিখ একটি ওয়েবসাইটে জানা যাচ্ছে ১৫ই এপ্রিল <http://www.somewhereinblog.net/blog/sumonzahid/29878233>)।



মাত্র এগারো মাস বয়েসে সতীন মাতৃহীন হন।

সতীন্দ্রনাথের পিতা নবীনচন্দ্র পটুয়াখালীর একজন সমাজপতি ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল সংযত বাক্য, সহজাত গাম্ভীর্য্য এবং পরোপকারের প্রবৃত্তি।

পটুয়াখালী সম্পর্কে সতীন সেনের জীবনীকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখছেনঃ
“বঙ্গদেশের এক দুর্গমস্থান হইল পটুয়াখালী মহকুমা। সমগ্র বরিশাল জিলায় রেল সংযোগ ছিল না, ইহার উপর পটুয়াখালী মহকুমার ৭ টি থানার সহিত ছিল না যোগাযোগের কোন উপযুক্ত রাস্তা-পথ। চতুর্দ্দিকের বিশাল নদী, খাল বিল প্রভৃতির মাধ্যমে চলিত যোগাযোগ। নৌকাযোগে চলিতে হইলেও নির্ভর করিতে হইত জোয়ার-ভাঁটার উপর। জন-সংখ্যায় মুসলমান সম্প্রদায় ছিল শতকরা ৯৫ জন।” (৩৩-৩৪) (আশুতোষ অবশ্য কোন বছরের সেন্সাস অনুযায়ী ৯৫%, সেটা জানান নি।)

স্কুলজীবন

সতীন্দ্রনাথের শৈশব ও বাল্যকাল অতিবাহিত হয় পটুয়াখালীতে। তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় পটুয়াখালী জুবিলি হাই স্কুলে। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরদাকান্ত সেনগুপ্ত ছাত্র সতীন্দ্রনাথের ওপরে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিলেন। সতীন্দ্রনাথ খুব ভালো ইংরেজি জানতেন, অনায়াস ও সাবলীল উচ্চারণ ছিল তাঁর, এবং এটি বরদাকান্ত সেনগুপ্তের প্রভাবে হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বরিশাল জেলা স্বদেশী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে ওঠে। এই সময়ে বরিশাল জেলায় কালীশ পণ্ডিতের Little Brothers of the Poor , আচার্য জগদীশ মুখোপাধ্যায়ের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম এবং ব্রজমোহন বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে স্বদেশী ও বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে ওঠে। মহাত্মা অশ্বিনী দত্ত এইসময়ে ভক্তিযোগের আদর্শে জাতীয় চরিত্র বিকাশের আহ্বান জানান। বরিশালেরই চারণকবি মুকুন্দ দাসের সঙ্গীত গণ আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। এইসময়ে বরিশাল শঙ্কর মঠের তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বিপ্লবী আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে সন্ন্যাস জীবন ও বিপ্লবী জীবনের সমন্বয়ের মাধ্যমে দেশের কাজে উৎসর্গপ্রাণ একদল যুবকের নেতৃত্ব দেন।

মুকুন্দ দাসের গান শুনে সতীন বাড়ি ছাড়েন এবং সোজা মুকুন্দের কাছেই গিয়ে উপস্থিত হন এবং ভবিষ্যতে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে চান। সতীনের বয়েস তখন দশ বছর। এরপর অবশ্য অশ্বিনী দত্তের হস্তক্ষেপে সতীনকে পটুয়াখালী ফেরত পাঠানো হয়।

সতীন যখন ছাত্র, তখন বরিশালের মিউনিসিপ্যালিটির তরফ থেকে কুকুর নিধন অভিযান চালানো হচ্ছিল, সতীন এতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি পশুপ্রেমী ছিলেন, সে যুগে যা খুব একটা দেখা যেত না।

পটুয়াখালীর স্কুলজীবনে সতীনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন মেধাবী ক্লাসমেট সুধীর কুমার দাশগুপ্ত। মূলত সুধীরের উদ্যোগে এই সময়ে একটি ছাত্রচক্র স্থাপিত হয়। সেখানে এঁরা শাস্ত্রচর্চা, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনপাঠ, যোগব্যায়াম অভ্যাস, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দুঃস্থ নিঃসহায় মানুষজনের সেবা ইত্যাদি করতেন, এবং সুধীরের সঙ্গে প্রজ্ঞানানন্দের যোগাযোগ হওয়ার পর থেকে এঁরা নিয়মিত বিপ্লবী পুস্তক ও পত্রিকা পড়া শুরু করেন।

১৯০৫ সালের বঙ্গীয় কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বরিশাল শহরে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সভাপতি। নির্মম দমন পীড়ন চলে, যার ফলে গোটা বরিশাল জেলাতেই বিক্ষোভের পরিবেশ তৈরি হয়, নিঃসন্দেহে তার আঁচ লেগেছিল সতীন এবং তাঁর সহপাঠীদের গায়েও।

এরপরে ১৯০৭ সালে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সম্মেলন সরকারী আদেশে বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাজেয়াপ্ত হয় সম্মেলনের সভাস্থল নির্মাণে ব্যবহৃত যাবতীয় টিন ও কাঠ, যা দিয়ে একটি সরকারী ক্লাব বানিয়ে ফেলা হয়। সতীন এবং তাঁর বন্ধুরা সেই ক্লাবটি রাতের বেলায় আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করেন। এই সময় সতীনের বয়েস মাত্র বারো।

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ঘনিষ্ঠ ছিলেন যুগান্তর দলের সঙ্গে। বিপ্লবী নেতা যতীন মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন), যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরিকুমার চক্রবর্তী, ভূপতি মজুমদার, অমর ঘোষ -এঁদের সঙ্গে প্রজ্ঞানানন্দের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
প্রজ্ঞানানন্দের কাছে দীক্ষা নেন অনেকেই, এবং বরিশালের বাইরে থেকেও অনেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সুধীর দাশগুপ্ত ও সতীন সেন দুজনেই প্রজ্ঞানানন্দের কাছে দীক্ষিত হন। জানা যায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও দীক্ষিত হয়েছিলেন প্রজ্ঞানানন্দের দ্বারা।

কলেজজীবন

১৯১২ সালে পটুয়াখালী জুবিলি হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় সুদূর হাজারিবাগের সেইন্ট কলম্বাস কলেজে। তাঁর আত্মীয়স্বজনরা সতীনের স্বদেশী মানসিকতায় উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, এবং সঙ্গীসাথীদের থেকে, স্বদেশী ও বিপ্লবী আন্দোলনের থেকে দূরে পাঠালে সে মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে এবং সতীন পড়াশোনায় মন দেবেন এবং ‘কেরিয়ার’ গড়বেন, এই আশায় তাঁকে হাজারিবাগে পাঠানো হয়, কলকাতায় বা বঙ্গের অন্যত্র না পাঠিয়ে। কিন্তু সতীন এই মিশনারি কলেজে এসে আরও বেশি করে দেশীয় রীতিনীতিকে আঁকড়ে ধরেন, ধুতি চাদর পরিধান শুরু করেন, স্ব-পাক নিরামিষ খেতে শুরু করেন। শোনা যায় কলেজের অধ্যক্ষ টমসন এই অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে এসে সতীনের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে যান, এবং বলেন, দিস বয় ইজ আ ট্রু ক্রিশ্চিয়ান। এর তাৎপর্য সম্ভবত এইঃ সতীন যুক্তিতে তুখোড় ছিলেন, এবং কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে চাননি। তার যুক্তিজালে অধ্যক্ষ পরাস্ত হন, এবং সতীন তার প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন।

সতীন এরপরে বটানি নিয়ে পড়তে আগ্রহী হন। হাজারিবাগের কলেজে সেই ব্যবস্থা না থাকায় তিনি কলকাতায় এসে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এইসময় থেকে সতীন্দ্রনাথের সক্রিয় বিপ্লবী জীবন শুরু, যদিও প্রজ্ঞানানন্দের সংস্পর্শে আসার ফলে আগেই বিপ্লবী ভাবধারায় তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল।


বিপ্লবী জীবন

বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করার সময় সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একটি বাড়িতে থাকতেন সতীন। এটি ক্রমে যুগান্তর বিপ্লবীদের আখড়া হয়ে ওঠে। এম এন রায় (তখন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) ভারত ত্যাগের পূর্বে এই বাড়িতে এক রাত কাটান।
এই সময়ে সতীন সাইকেল-আরোহী ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে ইউরোপীয় নাবিকদের থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতেন বিপ্লবী দলের জন্য।

এই সময়ে, ১৯১৫ সালে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি স্বদেশী ডাকাতি সঙ্ঘটিত হয় হাওড়ার শিবপুরে, এই দলে সতীনও ছিলেন। পুলিস এসে যাওয়ায় বিপ্লবীরা গঙ্গাবক্ষে একটি ডিঙিতে চড়ে পলায়ন করেন। সতীন এই সময়ে এক হাতে পিস্তল চালিয়েছিলেন এবং অন্য হাতে ডিঙির হাল ধরেছিলেন।

এপ্রসঙ্গে বলা দরকার, অমলেন্দু ঘোষ মনে করেছেন যে পুলিস মিথ্যে মামলা দিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে, কিন্তু অমলেন্দুর বর্ণনা পড়লে মনে হয় যে সতীন তখনও পটুয়াখালীতেই ছিলেন, যা সত্য নয়, সতীন তখন কলকাতায় থাকেন। উপরোক্ত ডাকাতির বর্ণনা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রদত্ত, যা বেশি গ্রহণযোগ্য, কারণ আশুতোষ সতীনের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন, এবং ব্যক্তিগতভাবে সতীনের সহযোগী ছিলেন।

এই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত অভিযোগে সতীন, তাঁর পটুয়াখালীর সহপাঠী সুধীর দাশগুপ্ত সহ অনেক বিপ্লবীকেই পুলিস গ্রেপ্তার করে, তাদের মধ্যে এই স্বদেশী ডাকাতির নেতা নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীও ছিলেন। বিচার শুরু হয়।

সতীনের পিতা অকাতরে অর্থব্যয় করেন, দুঁদে ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে নিয়োগ করেন, এবং সতীন (এবং সুধীর দাশগুপ্ত) প্রমাণাভাবে খালাস পান (নরেন্দ্রনাথের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়)। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। জেল গেটের বাইরে আসামাত্রই কুখ্যাত ভারতরক্ষা আইনে সতীনকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়।

বন্দী জীবন

এইসময় সতীন প্রথমে খুলনার কালীগঞ্জে অন্তরীণ থাকেন। সেখানকার আবহাওয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে বহরমপুর জেল এবং তারপরে মালদহ জেলার বামনগোলা থানার প্রেরণ করা হয়। সেখানে অসম্মান সহ্য না করতে চাওয়ায় জেলা পুলিস সুপারের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন, এবং শাস্তিস্বরূপ এবার তাঁকে জলপাইগুড়ির আলিপুরদুয়ারের একটি দুর্গম স্থানে অন্তরীণ করা হয়, এবং তারপরে সেখান থেকে পাঠানো হয় ভূটানসীমান্তে কুমারগ্রাম নামক ততোধিক দুর্গম স্থানে। পাহাড় ঘেরা, বনজঙ্গল পরিবৃত, হিংস্র জন্তুজানোয়ার অধ্যুষিত, ম্যালেরিয়া কবলিত সেই অঞ্চলে বর্ষার সময়ে বহির্জগতের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। সতীন এই সময়ে পুলিসকে জানান, অবিলম্বে তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া না হলে তিনি নিজে পায়ে হেঁটে সেই স্থান ত্যাগ করবেন (সতীন এখানে জেলবন্দী ছিলেন না, অন্তরীণ ছিলেন, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সরকারি প্রহরায় থাকতেন)। এর ফলে তাকে আলিপুরদুয়ারের অন্যত্র অপেক্ষাকৃত সুগম অঞ্চলে রাখা হল।

এইসময়ে সতীনকে সরকারি চাকরির টোপ দেওয়া হয়, দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির ইংরেজ পুলিস সুপার লোম্যান। সতীন প্রত্যাখ্যান করেন।

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ সরকার অন্যান্য স্বদেশী বন্দীদের সঙ্গে সঙ্গে সতীন্দ্রনাথকেও মুক্তি দেয়। সালটা ১৯১৯।

গান্ধীবাদের প্রভাব এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ

এই সময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, এবং এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি দেন। সতীন এইসময়ে গান্ধীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে বলা দরকার যে এটি মূলত চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানেই ঘটেছিল, এবং যুগান্তরের আরও অনেকে এইসময়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। প্রকাশ্য গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বিপ্লবীদের জন্য এক নতুন ক্ষেত্র ছিল। বরিশালের পটুয়াখালীতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মী হিসেবে যোগ দেন সতীন। এর আগেই ১৯২০ সালে বিপিন পালের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে বরিশালে, সেখানে সতীন নিজের অনুগামীদের নিয়ে কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছিলেন।

সতীন এইসময় থেকে একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে পটুয়াখালীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত প্রান্তে সাপ্তাহিক হাটগুলোয় ঘুরে ঘুরে অসহযোগ ও খিলাফতের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

এরপরে অচিরেই কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক দলকে ইংরেজ সরকার বে-আইনি ঘোষণা করে। গ্রেপ্তার হন সতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সহকর্মীরা। ১৯২২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি সতীন সেনকে আড়াই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় (তারিখটি জানাচ্ছেন অমলেন্দু ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এর তারিখ উল্লেখ করেন নি)। সতীন অসহযোগের প্রকৃত আদর্শে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন নি, বিচারব্যবস্থাকেই অস্বীকার করেছিলেন, ফলে এই বিচার হয় একতরফা।

ফের বন্দীজীবন, ঐতিহাসিক অনশন

সতীন বরিশাল জেলে প্রেরিত হন। তদানীন্তন জেল প্রশাসন রাজবন্দীদের ন্যূনতম মর্যাদাও দিতেন না। “সরকার সেলাম” বলে একটি অত্যন্ত অপমানজনক প্রথা মানতে বাধ্য করা হত সমস্ত বন্দীদের (জেলার বা অন্য পরিদর্শক এলে বন্দীদের একসারিতে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে সেলাম জানাতে হত, একে বলা হত সরকার সেলাম)। হাড়ভাঙা খাটুনি, যাতা ঘোরানো, ছোলা পেষা, বাগানে কোদাল দেওয়া, ইত্যাদি কাজে বাধ্য করা হত অসহযোগ কর্মীদের। সেই সঙ্গে ডোরাকাটা জাঙিয়া ও ফতুয়া পরে, একহাতে থালা, অন্যহাতে একটি চর্মনির্মিত টিকিট (তাতে বন্দীর পরিচয় একটি ক্রমিক সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট করা হত), এইভাবে দণ্ডায়মান থেকে সরকার সেলাম জানানোর বিরুদ্ধে সতীন বিদ্রোহ করলেন।

একদল অসহযোগী সতীনের এই বিদ্রোহকে সমর্থন জানান নি। পিরোজপুরের অনন্ত সেন, নরেন দাশগুপ্ত প্রমুখ কট্টর গান্ধীবাদীরা বললেন, জেলখানায় রাজবন্দীরা “সিভিল ডেড”। তাদের প্রতিবাদ করা চলে না, জেলের যা নিয়ম তা পালন করা উচিত। এর প্রত্যুত্তরে সতীন বলেছিলেন,
“’সিভিল ডেড’ অর্থ যদি মানবিক মর্য্যাদা বিসর্জন দেওয়া হয় তাহলে গান্ধীজি নিজ মুখে এসে বললেও আমি তা মানব না। আমরা শান্তভাবে প্রতিকার চাইব। না শুনলে সংগ্রাম করে আদায় করব। ইংরেজ সরকার আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য আমাদের জেলে পুরেছে। আমরা আন্দোলনকে স্তব্ধ হতে দেব না। জেলের বাইরে যেমন চলছে, জেলের ভেতরে তেমন চলবে। ওদেরকে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে শাসন চালাতে দেব না” (অমলেন্দু ঘোষ ১৭৯)।

সতীন সেনের মতই অধিকাংশ রাজবন্দীর মত দেখা যায়। সরকারপক্ষ এর পরে নির্মম দমন পীড়ন চালায়। সতীনের তিন সহযোগী, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, রাজেন দাস ও মকবুল মিঞাকে হস্তপদ আবদ্ধ করে নগ্ন অবস্থায় বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয় ইংরেজের পুলিসকর্তারা।

এরপরে সতীন অনশন শুরু করেন। সেই অনশন ঐতিহাসিক, তা ৬১ দিন ধরে চলেছিল। সতীন তাঁর অনশনের পরিসমাপ্তি ঘটান যখন অত্যাচারী পুলিস সুপার মানরোর বদলির নির্দেশ আসে, এবং সরকারের তরফ থেকে রাজবন্দীদের সবকটি দাবীদাওয়া মেনে নেওয়া হয়। এই সময় তাঁর বয়েস আঠাশ বছর। জেলের ভেতরে এই আন্দোলনের সময় সতীনের উল্লেখযোগ্য নিকট সহযোগীদের মধ্যে কলসকাঠির কানাইলাল ও নলিনী দত্ত, বাউফলের ফক্কু মিঞা, কোষাবরের জিতেন দত্ত, মহেন্দ্র রায়, বিহারী বিশ্বাস প্রমুখদের নাম বিশেষভাবে নেওয়া যায়।

এরপর বিশেষ শ্রেণীর বন্দীর মর্য্যাদা দেওয়া হয় রাজবন্দী অসহযোগীদের। সতীনকে বরিশাল থেকে সরিয়ে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এবং তারপরে বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম হুগলি জেলে কারারুদ্ধ অবস্থায় অনশন শুরু করেছে খবর পেয়ে সতীন কারা-কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন তাকে যেন হুগলি জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই অনুরোধ মান্য হয়, এবং হুগলি জেলে পৌঁছে সতীন নজরুলের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন।

জেলমুক্তি এবং বরিশাল জেলা কংগ্রেসের দায়িত্ব

১৯২৩ সালের প্রথম দিকে (আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী), মতান্তরে শেষের দিকে (অমলেন্দু ঘোষের বই অনুযায়ী) ইংরেজের জেল থেকে ছাড়া পান সতীন। ইতিমধ্যে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন গান্ধী, অন্যদিকে খিলাফত আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটেছে। এইসময়ে সতীন সেন দেখতে পান তার সঙ্গে যে মুসলমান সহকর্মীরা আগে ছিলেন, তারা সবাই ইংরেজবিরোধী আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন (“তাঁহার বিশ্বস্ত মুসলমান কর্মীগণের আর কাহাকেও তিনি পাইলেন না” – আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ৪৯)।

এরপর তিনি পটুয়াখালী জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন করেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে, স্কুলের মৃত্তিকানির্মিত ভবনটি তাঁর নিজের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। নিজেই এই স্কুলে শিক্ষকের কাজ করেছেন, তার জ্যাঠতুতো দাদা হেমচন্দ্র সেনকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়েছেন, কারণ শিক্ষক নিয়োগের জন্য সেসময় তাঁর কাছে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ ছিল না।
এরপরে ১৯২৪ সালে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। পিরোজপুর মহকুমায় এই সম্মেলন ঘটে, অনন্তকুমার সেন, মৃন্ময় গুপ্ত প্রভৃতির নেতৃত্বে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে। সতীনকে বরিশাল জেলার কংগ্রেস সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইসময় থেকেই সতীন সমগ্র বরিশালের রাজনৈতিক চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠেন, প্রয়াত অশ্বিনী দত্তের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে উঠে আসেন তিনি। বরিশালে তিনি কংগ্রেস অফিসেই একটা ঘরে থাকতে শুরু করেন, সাত আটজন কর্মীকে নিয়ে। চাইলেই নিজের জন্য আরামদায়ক বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতেন, কিন্তু করেন নি।

বরিশালের ব্রজমোহন শিল্প বিদ্যালয়ের অধ্যাপক শৈলেন দাশগুপ্ত (রুনুবাবু নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন) ১৯২২ সালে তৈরি করেছিলেন তরুণ সঙ্ঘ, কিন্তু ১৯২৪-এ তিনি গ্রেপ্তার হলে সংগঠনটি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। এইসময় সতীন সেন তরুণ সঙ্ঘের হাল ধরেন। এই তরুন সঙ্ঘেই তিনি তাঁর দুই ভবিষ্যত নিকট সহকর্মী তারাপদ ঘোষ এবং শৈলেশ্বর চক্রবর্তীকে পেয়েছিলেন।
সুধীর কুমার দাশগুপ্ত এইসময়ে “বরিশাল” নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে তাঁর অবসরের পরে এই পত্রিকার দায়িত্ব নেন বিজয় ভূষণ দাশগুপ্ত (পরে যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক)। এই “বরিশাল” পত্রিকাকে অবলম্বন করেও সতীন অনুগামীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ওঠেন।

১৯২৫ সালে গান্ধীর আগমন ঘটে বরিশাল জেলায়।

এই সময়ে গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সতীন জানতে চান, ক্রমবর্ধমান মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্দু মুসলমানে ঐক্য গড়ে তোলা কিভাবে সম্ভব। গান্ধীজি বলেন, “হিন্দুরা ভীরু, এবং মুসলমানরা দুর্দান্ত। বন্ধুত্ব সম্ভব তখনই যখন উভয়েই হইবে সম-শক্তিমান” (আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ৫৯)।

সেসময়ে স্কুলে সরস্বতী পুজো পালন করতে দেওয়ায় বাধা আসছে বরিশাল জুড়ে। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে সতীনকে গান্ধী বলেন, “হিন্দুস্থান হইল হিন্দু মুসলমান উভয়ের সমবেত প্রাঙ্গন – এজন্য কি হিন্দুদের কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রতিপালিত হইবে না?” (আশুতোষ ৫৯)।

হিন্দুরা এইজাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হলে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পরামর্শ দেন গান্ধীজি। সর্বপ্রকার, অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে রুখে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

গান্ধী এসময়ে তিন দিন বরিশালে অতিবাহিত করেন। যেদিন তিনি বরিশাল ত্যাগ করেন, সেদিনই সন্ধ্যায় চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুসংবাদ টেলিগ্রাম মারফত পৌঁছয়। সতীন চিত্তরঞ্জনের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন না, কিন্তু গুণমুগ্ধ ছিলেন।

লাউকাঠিতে ট্যাক্স বিরোধী আন্দোলন

ইংরেজ সরকার এক নতুন আইনবলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপনে উদ্যত হয়, যার ফলে জনসাধারণের প্রদেয় ট্যাক্সের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। এর বিরুদ্ধে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল মেদিনীপুর অঞ্চলে কর-বন্ধ আন্দোলন পরিচালিত করেন। বরিশালের লাউকাঠিতেও এইরকম ইউনিয়ন বোর্ড স্থাপিত হয় সরকারের অনুগত একদল লোকজনকে নিয়ে, এবং বর্ধিতহারে কর ধার্য হয়। এর বিরুদ্ধে সতীনের নেতৃত্বে আন্দোলন হয়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিসের দ্বারা এই সময়ে সতীন আক্রান্ত হন, পুলিসের লাঠির বাড়িতে তাঁর মাথায় গুরুতর চোট লাগে, মাথা ফেটে যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি জনতাকে অহিংস রাখতে পেরেছিলেন, এবং জেলার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ই এন ব্ল্যান্ডী ঘটনাস্থলে এসে লাউকাঠি ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল ঘোষণা করেন। এর পরেই বরিশালের মুরাদিয়া, আউলিয়াপুর প্রভৃতি পাঁচ ছটি অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ড বাতিল করা হয়।

বরিশাল কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা

এইসময়ে বরিশাল কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধাদান করেন মুসলমানরা, পুজো করা চলবে না বলে জানান। এবং অবশেষে কলেজের মধ্যে পুজো না করে হিন্দু ছাত্ররা তাদের হোস্টেলের মধ্যে পুজো সম্পন্ন করেন। সতীন চাননি হিন্দুরা ভয়ে সরস্বতী পুজো করা বন্ধ করে দেয়। তিনি পুজো করার পক্ষে ছিলেন, এবং হিন্দু ছাত্রদের উৎসাহ ও পরামর্শ দেন, সাধ্যমত সাহায্য করেন। এদিকে শান্তিভঙ্গ হয়েছে এই অপরাধে সমস্ত হিন্দু ছাত্রদের পুলিস গ্রেপ্তার করে, ততক্ষণে অবশ্য পুজো সম্পন্ন হয়ে গেছিল (মুখোপাধ্যায় ৬৮-৭১)।

পটুয়াখালী সত্যাগ্রহঃ প্রেক্ষাপট

পটুয়াখালীর মিউনিসিপ্যাল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে একই কায়দায় সরস্বতী পুজোয় বাধা দেওয়া হয়। মুসলমানদের আপত্তির কারণে স্কুল গৃহে না করে, পুজো সম্পন্ন করা হয় স্কুল প্রাঙ্গনে। পরের দিন সরস্বতী মূর্তির সামনে একটি গরুর কাটা মাথা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
এর পরেই সরস্বতী পুজোয় বিসর্জনের শোভাযাত্রা বন্ধের দাবী করা হয়। কারণ শোভাযাত্রা যে পথ দিয়ে যাবে, সেই পথে একটি মসজিদ ছিল (ঠিক সেই রাজপথের ওপরে নয়, রাজপথ থেকে বেরোনো একটি সঙ্কীর্ণ গলিপথের শেষ প্রান্তে ছিল এই মসজিদ)। মসজিদের প্রার্থনার সময় তার সামনে দিয়ে যাওয়া কোনও শোভাযাত্রায় কোনও বাজনা বাজানো হবে না, সতীন এই আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সরস্বতীর বিসর্জনযাত্রার অনুমতি দেওয়া হল না।
এরপর ১৯২৬ সালে অগাস্ট মাসে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় একদল মুসলমান হামলা চালায়, পুলিস এসে শোভাযাত্রা আটকে দেয়, এবং শুধু হিন্দুদেরকেই শান্তিভঙ্গের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
এর প্রতিবাদেই শুরু হয়েছিল পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ। নির্যাতিত হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত সতীনের কংগ্রেসী রাজনৈতিক জীবনে এক বিরাট বড় ঝুঁকি, সম্ভবত এই কারণেই তিনি বরিশালের বাইরে কংগ্রেসের কোনও বৃহত্তর দায়িত্ব জীবনে আর পান নি।
পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ

রোজ আইন অমান্য আন্দোলন করেন সতীন সেনের অনুগামী যুবকদল। এরা নিষিদ্ধ স্থানে অর্থাৎ মসজিদের “সামনে” দিয়ে শোভাযাত্রা করে যান রোজ, এবং এভাবে প্রত্যহ গ্রেপ্তার হন। এইরকমের আন্দোলন বেশ অভিনব, ভারতে আর হয়েছে বলে জানা যায় না। এই আন্দোলনে সতীনের তরুণ সহকর্মীদের মধ্যে মনোরঞ্জন পাল, আশু মুখার্জী, হরিপদ দাস প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

১৯২৬ সালে গৌহাটিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। সেখানে গিয়ে সতীন পটুয়াখালীর ঘটনা রিপোর্ট করেন। পটুয়াখালীর মত প্রত্যন্ত স্থান যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা খুবই কম, সেখানে এরকম কর্মসূচী নেওয়া বিপজ্জনক বলে অনেকে মত দেন। প্রত্যন্ত পটুয়াখালীতে না করে, এই জাতীয় আন্দোলন কলকাতায় করার পক্ষেও কেউ কেউ বলেন। এই জাতীয় “ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ” দ্বন্দ্বকে অস্বীকার না করলে স্বাধীনতার জন্য মিলিত লড়াই করা যাবে না বলেও অনেকে জানান। সতীন প্রত্যুত্তরে বলেন, ছোট বড় প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ অগ্রসর হয়, কোনও অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলে না।

ধীরে ধীরে এই পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ বিশাল সাড়া ফেলল সারা ভারত জুড়ে। অমৃতবাজার পত্রিকার পীযূষকান্তি ঘোষ পটুয়াখালী গিয়ে এই সত্যাগ্রহের পক্ষে সমর্থন জানান, এবং বলেন, তিনি আবশ্যক হলে নিজের অস্থিগুলিও এই আন্দোলনের জন্য প্রদান করবেন। এইসময়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন সতীনকে নিয়ে অমৃতবাজারে, এবং সমস্ত শিক্ষিত বাঙালির কাছে সেই প্রথম সতীন সেন একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন।

এরপরে পাঞ্জাব থেকে ভাই পরমানন্দ, ডাঃ মুঞ্জে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পটুয়াখালীতে আসেন। মাখনলাল সেন, অমর চট্টোপাধ্যায় পটুয়াখালী পরিদর্শন করেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের জন্য সুদূর জাপান থেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন মদন মোহন মালবীয়, লালা লাজপৎ রায়, শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। বাংলার নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুভাষচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সুরেশ মজুমদার এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন।

সত্যাগ্রহ পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, তার সম্পাদক প্রথমে ছিলেন জগদীশচন্দ্র সরকার, এবং তারপরে ক্ষিতীশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ক্ষিতীশ এই আন্দোলনের শেষ পর্যন্ত সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব বহন করেছিলেন। নির্মল দাশগুপ্ত ও তারাপদ ঘোষের ওপরে ছিল বরিশাল শহরে অর্থসংগ্রহ করা, কর্মসূচী পরিকল্পনা ও আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব। পটুয়াখালীতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সতীনের অগ্রজ নগেন্দ্রবিহারী সেন বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে এই আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন স্বামী জ্ঞানানন্দ, ইন্দু গুহ, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি। অন্ধ্রের শ্রীপঞ্চাঙ্গী ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের পক্ষে প্রচার করেছিলেন। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে মদন মোহন মালবীয়র আমন্ত্রণ আসে, তখন বরিশালের তরুণ উকিল মন্মথ দে’কে সতীন দিল্লিতে পাঠান। মন্মথ লালা লাজপৎ রায় ও মদন মোহন মালবীয়র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এবং এদের সমর্থন লাভ করেন।

এদিকে এই সত্যাগ্রহের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বরিশালের বিভিন্ন পল্লী অঞ্চল থেকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নানা আগ্রাসনের খবর আসতে লাগল। সতীন দ্রুত একটি তরুণদের দল গঠন করেন যারা আক্রান্ত হিন্দুদের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হয়, এবং সবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই দলে হীরালাল দাশগুপ্ত, দেবেন দত্ত, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, রবি রায়, ফণী চ্যাটার্জি, সুধীন সেন, দিলীপ দাস, নলিনী দত্ত, নারায়ণ ঘটক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিপদসঙ্কুল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অকুতোভয়ে অগ্রসর হতেন সতীনের অনুগামী বিপুল মুখোপাধ্যায়, কিরণ দে, সুধীর আইচ, টুক্‌কা-বড়কা দুই ভাই (মুখোপাধ্যায় ৮৫)।

সংখ্যায় খুব কম হলেও সঙ্ঘবদ্ধতা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে বরিশালের হিন্দুরা এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে তাদের হৃত আত্মসম্মান ফিরে পেয়েছিল।

পোনাবালিয়া হত্যাকাণ্ড

বরিশাল জেলার পোনাবালিয়ার শিবমন্দির ছিল একটি প্রাচীন শৈব পীঠস্থান। এখানে শিবরাত্রির সময় মেলা বসত। ১৯২৭ সালের শিবরাত্রির আগে মেলার প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে, বরিশালের দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন জানা গেল যে শিবমন্দিরের ধার দিয়ে যে প্রশস্ত সরকারী রাস্তা গেছে, সেখানে অদূরেই একটি চালাঘরকে মসজিদ বলে ঘোষণা করে হয়েছে। ফলে হিন্দুরা শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে কোনওপ্রকার শোভাযাত্রা করতে পারবে না।

সতীন্দ্রনাথ যথারীতি হিন্দুদের শিবরাত্রি পালনের পক্ষেই মত দিলেন, এবং তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের পোনাবালিয়া পাঠালেন।
নোয়াখালি থেকে আগত এক মৌলবীর নেতৃত্বে একদল হিংস্র জনতা সেই তথাকথিত মসজিদে জড়ো হয়ে জিগির তুলতে থাকে। শান্তিরক্ষার জন্য একদল পুলিস সেই অঞ্চলে ছিল, এবং সেই রক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন জেলাশাসক ব্ল্যাণ্ডী।

উস্কানিপ্রদানের অভিযোগে মৌলবীকে শেষ মুহূর্তে গ্রেপ্তার করা হলেও, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। উত্তেজিত মুসলমানেরা ব্ল্যাণ্ডীকে উদ্দেশ্য করে বর্শা ছোঁড়ে, এবং এর উত্তরে পুলিস গুলিবর্ষণ করে। মোট ১৯ জন মারা যায়।

এর অব্যবহিত পরে পটুয়াখালী শহরে বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা হয়। পুলিস এই সময়ে পিটুনি কর বা পিউনিটিভ ট্যাক্স বসায় বেছে বেছে হিন্দু নাগরিকদের ওপরেই।

লাকুটিয়ায় দোলযাত্রায় বাধা

বরিশালের লাকুটিয়া গ্রামে প্রত্যেক বছর দোলযাত্রা উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা হত, এবার তার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে। গ্রামবাসীরা সতীনের সাহায্য প্রার্থনা করেন, এবং সতীন গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ান। এর ফলে সতীনকে ফৌজদারী বিধানের ১০৭ ধারা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়, এবং জামিনের পরিমাণ ধার্য করা হয় ৫০০০০ টাকা, যার ফলে সতীনের জামিন মেলা অসম্ভব হয়ে যায়। জেলা জজের এজলাসে এই জামিননামার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়, এবং এক বাঙালি বিচারক মাত্র ৫০০ টাকা জামিনে সতীনকে মুক্তি দেন। এর পরপরই এই বিচারককে নোয়াখালিতে শাস্তিমূলক বদলি করে দেওয়া হয়। সতীনের জীবনীকার এই বিচারকের নাম উল্লেখ করেন নি।

এরপরে সতীনের বিচার হয় মহকুমা হাকিম জে কে বিশ্বাসের আদালতে। সতীনের পক্ষ সমর্থন করার জন্য মাখনলাল সেন ও কিরণশঙ্কর রায়ের সুপারিশে কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার বি সি চ্যাটার্জি আসেন।

এই মামলায় আসামী সতীন সম্পর্কে জে কে বিশ্বাস শ্রদ্ধাভিভূত হয়ে মন্তব্য করেনঃ A man of great magnetic personality and sterling morality। কিন্তু বিচারে রায় হয়, সতীনকে এক বছরের জন্য মুচলেকা দিয়ে আবদ্ধ/অন্তরীণ থাকতে হবে, অন্যথায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সতীন মুচলেকা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে পাঠানো হয়।
এদিকে পিটুনি কর আগে থেকেই চলছিল পটুয়াখালীতে। এবার সতীনের সহযোগীদের বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা শুরু হল। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহকে গায়ের জোরে ভাঙতে বদ্ধপরিকর ইংরেজ সরকার এই সময়ে সতীনের সহযোগীদের মধ্যে অনেককেই ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন হীরালাল দাশগুপ্ত, দেবেন দত্ত, আশু মুখার্জী, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি, ফণী চ্যাটার্জি, শ্রীমন্ত ভট্টাচার্য, রবি রায়, বিনোদ কাঞ্জিলাল, দীনেশ সেন, সুরেন গাঙ্গুলী, রেবতী গাঙ্গুলী প্রমুখ আরও অনেকে। তারিখটা ছিল ২০শে মার্চ, ১৯২৮। পটুয়াখালী জুড়ে সত্যাগ্রহীদের অফিস ভেঙে দেওয়া হয়, প্রবল পরিমাণে দৈহিক অত্যাচার চলে সত্যাগ্রহে উদ্যত স্বেচ্ছাসেবকদের ওপরে। পটুয়াখালীর দুর্গম অবস্থানের জন্য প্রথম কয়েক মাস এইসব অত্যাচারের খবর কলকাতার সংবাদপত্রে পৌঁছয় নি।

বন্দীজীবন , প্রেসিডেন্সী জেলে অনশন, অবশেষে মুক্তি

সতীনকে সাধারণ কয়েদীর মত ঘানি টানতে বাধ্য করার প্রয়াস হয় প্রেসিডেন্সী জেলে। এর প্রতিবাদে সতীন অনশন শুরু করেন। এই অনশনের মধ্যেই বরিশাল থেকে ১১০ ধারায় বিচারের পরোয়ানা আসে এবং অনশনের ১৮তম দিনে অনশনক্লিষ্ট সতীনকে হাতে পায়ে শৃঙ্খল পরিয়ে কলকাতা থেকে পটুয়াখালী সাব জেলে নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টে ১০৭ ধারায় সতীনের শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল হয়, ও শুনানিসাপেক্ষে তার জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয়। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে ১১০ ধারাতেও বন্দী, কাজেই জেল থেকে ছাড়া তিনি পান না। এইসময় কংগ্রেস নেতা ও ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত সতীনের পক্ষ সমর্থন করছিলেন। এরপরে বিচারপতি সি সি ঘোষের এজলাসে ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার সতীনের জামিনে মুক্তির আবেদন করা হয়, এবং জাস্টিস ঘোষ মন্তব্য করেন, আদালত সতীনের ওপরে এই সরকারি “জুলুম” সহ্য করবে না। সতীন জামিনে মুক্তি পান। এইবারে তিনি মোট ৫৭ দিন অনশন করেন।
বরিশালের নতুন জেলা শাসক ডোনোভান প্রথমে গ্রেপ্তার ও দমন পীড়নের পথে হাঁটলেও ক্রমে বুঝতে পারেন, সতীনের সত্যাগ্রহীদের দাবিগুলি সঙ্গত। ১৯২৮ সালের ৭ই জুলাই জেলা বোর্ডের অফিসে হিন্দু মুসলমান উভয় পক্ষের নেতাদের উপস্থিতিতে স্থির হয় যে সমস্ত সরকারী সড়ক সর্বসময় সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সতীনের ও সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া হয়, সতীনও পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ঘোষণা করেন। পটুয়াখালী সত্যাগ্রহ এইভাবে অনেক ত্যাগ, বলিদান ও কষ্টশিকারের শেষে জয়যুক্ত হয়েছিল।

সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা

ব্রাহ্মদের পরিচালিত সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোয় বাধা আসে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সতীন এইসময়ে কলকাতায় ছিলেন, তিনি উভয়পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক সুরাহা করেন। এই সময় ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সুভাষচন্দ্র বসু দুজনেই সতীনের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রদের সবথেকে বেশি ভরসার স্থান ছিলেন সতীন, কারণ হিন্দুদের কথা সতীনের মত এমন সরাসরি আর কেউ বলতেন না।
বরিশালে সতীনের পুনরায় গ্রেপ্তারি ও মুক্তি

১৯২৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি একটি সরকারী প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের আপত্তি-বিক্ষোভ, ফলশ্রুতিতে পুলিসের নির্মম লাঠিচার্জ ঘটে। এর প্রতিবাদে বরিশালে পুনরায় আন্দোলন শুরু হয়। বরিশালের পুলিস কর্তা তখন কোলসন, ইনি পরে কলকাতার পুলিস কমিশনার হয়েছিলেন। দমননীতিতে বিশ্বাসী এই কোলসন ২৯শে জানুয়ারি তারিখে সতীন বরিশালে প্রত্যাবর্তন করার কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় ১০৭ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। কিছুদিন পরেই অবশ্য এই মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, এবং সতীন মুক্তি পান।

১০৮ দিনের ঐতিহাসিক অনশন

 ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে বরিশাল শহরে জনাকীর্ণ কালীবাড়ী রোডে দারোগা যতীশ রায় নিহত হন। সন্দেহবশত চোদ্দ বছর বয়সী রমেশ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিস রমেশকে সতীনের অনুগামী বলে দাবি করে। সতীন পুনরায় ১১০ ধারায় গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলি অভিযোগ আনা হয়। ওদিকে রমেশ চক্রবর্তীর প্রথমে ফাঁসির হুকুম হলেও পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়, এবং রমেশ আন্দামানে প্রেরিত হন। প্রশাসন সমস্ত চুক্তি ভঙ্গ করে পুনরায় হিন্দুদের ওপরে দমন পীড়ন শুরু করে, সমস্ত শোভাযাত্রার অধিকার পুনরায় কেড়ে নেওয়া হয়। সতীন এই অপমানের প্রতিবাদে বরিশাল জেলের মধ্যে অনশন শুরু করেন। তাঁর অবস্থা ক্রমে আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। এইসময়ে কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে সতীনের মুক্তিকামনায় এক বিরাট সভা হয়, সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক জে এল ব্যানার্জি। এই সভায় আরেক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, জেল ভেঙে সতীনকে ছিনিয়ে আনব। দুজন অধ্যাপকেরই এর ফলে কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু জনমত ক্রমশঃ তীব্র হয়ে ওঠে অনশনে মৃতপ্রায় সতীনের জন্য। এইসময়ে সুভাষ বসু এবং যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বরিশালে গিয়ে তাঁকে অনশন প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেন। তাঁরাই আন্দোলনের দায়িত্ব নেবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও দেন, ফলে সতীন অনশন তুলে নেন। কিন্তু তাঁরা প্রতিশ্রুতি পালন না করে, বরিশালকে অবহেলাই করছেন এমনটা দেখে সতীন পুনরায় অনশন শুরু করেন।

কথিত আছে এই সময়ে বাংলার আইনসভায় (কাউন্সিল) মুখ্যসচিব প্রেন্টিস বলেন, “Barisal is the Storm Centre and Satin Sen is the Stormy Petrel. The question of his release, even on bail, is fantastic” (মুখোপাধ্যায় ১২৫).
অনশন চলতে থাকে। পুরো বরিশাল এবং বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে, তাঁর মুক্তির দাবিতে অগণিত মানুষ বরিশাল শহরে মিছিল করে। সতীন সম্ভবত মারাই যেতেন (এই সময়েই লাহোর জেলে যতীন দাস দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশনের পরে মারা যান), কিন্তু তাঁর অগ্রজ হেমচন্দ্রের আকুল অনুরোধে তিনি ১০৮ দিন ধরে অনশনের পরে অবশেষে অনশন তুলে নেন।
এর পরেই পুলিসের পক্ষ থেকে তাঁকে মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। বিচারে সতীনের ৩০০০ টাকার জামিনদারি এবং তৎসহ তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। টাকীর জমিদার যতীন রায় চৌধুরী অযাচিতভাবেই এই ৩০০০ টাকা তৎক্ষণাৎ দিয়ে দেন। পরে সেই জামিন বাজেয়াপ্ত হলে পাবনার শীতলাইয়ের জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র নতুন জামিনদার হয়েছিলেন।

পুনরায় কলকাতা

১৯৩০ সালের জুন মাসে সতীন মেদিনীপুর জেল থেকে মুক্ত হয়ে কলকাতায় আসেন (আপিলে মুক্তি না জামিনে মুক্তি, সেটা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট করে লেখেন নি)। এই সময়ে বাংলার কংগ্রেসে দুটি ছাত্র ইউনিয়ন ছিল, নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি (ABSA) এবং প্রাদেশিক ছাত্র সমিতি (BPSA)। এরা একযোগে স্কুল কলেজ বর্জন (বয়কট) আন্দোলন শুরু করে। প্রেসিডেন্সীর ছাত্রদের ওপরে নির্মম দমন পীড়ন ঘটে। ছাত্রনেতারা সতীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। সতীন এই ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। এই সময়ে বিধান রায় সহ অনেকেই সতীনের সমালোচনা করেন। জুন মাসের শেষে পুলিস সতীনকে আবার গ্রেপ্তার করে, এবার অভিযোগ তিনি প্রেসিডেন্সীর ছাত্রদের রাজদ্রোহে উস্কানি দিয়েছেন।

পুনরায় বন্দীজীবন

সতীনের ওপরে জেলের মধ্যে ভয়ানক অত্যাচার হয়। তিনি জেলের মধ্যে আন্দোলন করবেন এবং কোর্টে যেতে অস্বীকার করবেন এরকম খবর পেয়ে পুলিসের সার্জেন্টরা তাঁর পা ধরে শায়িত অবস্থায় তাঁকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে সিঁড়ি দিয়ে টেনে নিচে নামায়, এবং সতীনের সর্বশরীর ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বন্দী ছাত্রদের ওপরেও এই সময়ে অকথ্য অত্যাচার চলে। এরপরে বিচারের প্রহসন করে সতীনের দেড় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়, এবং ১৯৩০ এর জুলাই মাসে তাঁকে দার্জিলিং জেলে পাঠানো হয়। দার্জিলিং জেলে থাকাকালীন কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা W C Bonnerjee এর এক মেয়ে, যিনি দার্জিলিং নিবাসী খ্রীষ্টান ছিলেন এবং মাঝে মাঝে জেল পরিদর্শন করতেন, সতীনকে একবার বলেছিলেন, যে সতীনের জীবনটি ক্রুশে বিদ্ধ (Your life is full of crucifixion).

মুক্তি ও কলকাতা বাস

১৯৩১ সালের মার্চ মাসে গান্ধী আরউইন চুক্তির ফলে আরও অনেকের সঙ্গে সতীনও মুক্তি পান। কিন্তু এই সময়ে তাঁর বরিশাল প্রবেশের ওপরে সরকার নিষেধাজ্ঞা চাপায়, ফলে তাঁকে কলকাতাতেই থাকতে হয়।

কলকাতায় তিনি উঠলেন তাঁর সহকর্মী ডাঃ প্রসূনচন্দ্র দাশগুপ্তের ১৯৫ মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়িতে। তাঁর শরীর এইসময় রোগাক্রান্ত ও দুর্বল, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। অনবরত কারাবাস, অনশন, অমানুষিক অত্যাচার, জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে সতীনের শরীরে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে তখন। তাঁর প্লুরিসি, মাংসপেশীর দৌর্বল্য, অবশতা ও শক্তিহীনতা, অজীর্ণতা, টিবি ইত্যাদি নানা রোগ ধরা পড়ে। চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে তাঁর চিকিৎসা চলে। কবিরাজ শ্যামাদাস বাচস্পতিও তাঁর চিকিৎসা করেন।

কর্মচাঞ্চল্য থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারতেন না সতীন। এইসময়ে তিনি বিদেশী দ্রব্য বর্জনের জন্য একটি পিকেটিং এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই পিকেটিং বোর্ডের সভা বসত অ্যালবার্ট হল (আজকের কফি হাউজ) লাগোয়া কমিটি রুমে।
১৯৩১ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের অধিবেশনে সতীন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন, এই সম্মেলনটি হয় কান্দী মহকুমা শহরে।

১৯৩১ এর হিজলী বন্দী নিবাসে পুলিসের গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে মনুমেন্টের পাদদেশে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে যে বিশাল প্রতিবাদসভা হয়, তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সতীন।

বিনা বিচারে বন্দী হলেন (১৯৩২-৩৭)

১৯৩২ সালে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। এবার সতীনকে BCLA আইনে বন্দী করা হয়, এবং দার্জিলিং জেলে পাঠানো হয়। এইসময় কলকাতা জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলনে সতীনের স্থাপিত পিকেটিং বোর্ডের নেতৃত্বেই মূল আন্দোলনটি ঘটে। প্রসূন দাশগুপ্ত, সুধীর দাশগুপ্ত, আশু মুখার্জী, নির্মল বসু, রবি রায়, মনি দত্ত, ইন্দু গুহ, মনীন্দ্র সমাদ্দার প্রমুখ এই পিকেটিং বোর্ডের নেতা ছিলেন। ১৯৩২ সালের জুন মাসে সতীনকে দার্জিলিং থেকে আনা হয় রাজস্থানের দেউলী বন্দী শিবিরে। তখন এখানে বাংলা থেকে বহু শত বিপ্লবীকে আনা হয়েছে উৎপীড়নের উদ্দেশ্যে। অসম্ভব উত্তাপ, পানীয় জলের অপ্রতুলতা, স্নানের জলের সম্পূর্ণ অভাব, খাদ্যের অনটন, চিকিৎসার অমিল -সব মিলিয়ে এখানকার পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল যে বিপ্লবী মৃণাল কান্তি ঘোষ রজ্জুবন্ধনে আত্মহত্যা করেন।

এরপর ১৯৩২ এর ডিসেম্বর মাসে সতীনকে পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর ক্যাম্বেলপুর জেল। সেখানে স্বাস্থ্যের ভয়ানক অবনতির পরে সতীন লাহোরের মেয়ো হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন, এরপরে আম্বালা জেলে প্রেরিত হন ১৯৩৫ সালের শেষের দিকে। আম্বালা জেলে জঘন্য পরিবেশে, খাদ্যাভাবে, চিকিৎসার অভাবে সতীনের স্বাস্থ্য পুনরায় খারাপ হয়ে যায়, এবং তিনি অব্যবস্থার বার বার প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও কোনও সুরাহা না হওয়ায় এক অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানাবেন স্থির করেন। তিনি লিখিতভাবে জানান যে জেলের অব্যবস্থা, জেল সুপারের কার্যাবলীর প্রতিবাদে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে জেলের ভেতরে একটি পরিত্যক্ত ক্ষুদ্র গৃহে অগ্নিপ্রদান করবেন।

তিনি সত্যিই আগুন লাগিয়ে জেলের মধ্যেকার সেই ছোট ঘরটিকে ভস্মীভূত করেন। এর ফলে সতীনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয় (উল্লেখ্য, এই সময়ে তিনি বিনাবিচারে বন্দী ছিলেন, কাজেই আদালতের মুখোমুখি হওয়ার এই ছিল তাঁর সুযোগ)।
এই মামলা ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে প্রত্যাহার করা হয়, এবং অগাস্ট মাসে তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে এনে প্রেসিডেন্সী জেলে আটক করা হয়। অনতিবিলম্বে তাঁকে অন্তরীণ করা হয় বীরভূমের মৌরেশ্বর থানায়। এরপর ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তি পান।

কর্মযজ্ঞে পুনরায়

সুভাষের অনুরোধে এই সময় সতীন মুক্তিপ্রাপ্ত রাজবন্দীদের সাহায্যপ্রদানের জন্য তৈরি কমিটির দায়িত্ব নেন।
এরপরে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধী বনাম সুভাষ তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা গেলে সতীন এবং আরও কয়েকজন রবীন্দ্রনাথের কাছে মধ্যস্থতা করার আর্জি নিয়ে উপস্থিত হন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কেও এই মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানান সতীন। অবশ্য এই মধ্যস্থতায় লাভ হয়নি। সুভাষ কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক স্থাপন করেন।
সতীন্দ্রনাথ এই সময়ে হরিদাস মজুমদার কর্তৃক বাংলা দৈনিক “কেশরী” পরিচালনার দায়িত্ব পান। তবে সেটি বেশিদিন চলেনি। এইসময়ে সতীন ও তাঁর সহকর্মীদের থাকার জন্য ১০৪ কলিন স্ট্রিটের একটি ফ্ল্যাটবাড়ি বিনা ভাড়ায় ছেড়ে দেন হরিদাস। এই পত্রিকা পরিচালনের কাজে সতীন তাঁর এই সহকর্মীদের সাহায্য পান- বিনয় সেন, আশু মুখার্জী, নৃপেন্দ্র সেন, প্রসূন দাশগুপ্ত, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি, দীনেশ সেন।

কিছুটা একাকী

দীর্ঘদিন কারাভ্যন্তরে থাকার ফলে সতীনের কোনও কোনও সহকর্মী তাঁর থেকে কিছুটা দূরে চলে যান। হীরালাল দাশগুপ্ত, নৃপেন সেন, সুকুমার সেন প্রমুখ কমিউনিস্ট হয়ে যান, আবার নির্মল ঘোষ, কেদার সমাদ্দার, দেবেন দত্ত, কিরণ রায় চৌধুরী হয়ে যান সতীন বিচ্ছিন্ন গান্ধীবাদী (জীবনীকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছেন না, সম্ভবত এরা কংগ্রেসের ভেতরে অন্য কোনও গোষ্ঠীতে যোগদান করেছিলেন)।

ভোলায় বন্যা

১৯৩৯ সালে বরিশালের মূলত মুসলমান অধ্যুষিত ভোলা মহকুমায় ব্যাপক বন্যা হয়। সতীন এইসময় সর্বশক্তি নিয়োগ করে ত্রাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৪০-৪২: আবার বন্দী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধপ্রয়াসে সহযোগিতা করার নামে ইংরেজ সরকার বরিশাল জেলায় অর্থবান নাগরিকদের কাছ থেকে জোরজুলুম করে চাঁদা তুলছিল, সতীন এর প্রতিবাদ করেন। সরকার এর ফলে আদায়ীকৃত চাঁদার কিছুটা অংশ অনিচ্ছুক দাতাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু সতীনকে ভারতরক্ষা আইনে তিন মাসের জন্য জেলে পুরে দেয়।
আবার বন্দী হলেন

১৯৪২ সালের ১৩ই অগাস্ট কলকাতাস্থ কলিন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে সতীন গ্রেপ্তার হন ভারতরক্ষা আইনে। শ্যামাপ্রসাদ তখন বাংলার মন্ত্রী, শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার শাসন চলছে। এইসময়ে সতীনের সঙ্গে যাঁরা প্রেসিডেন্সী জেলে ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রফুল্লচন্দ্র সেন পরবর্তীকালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। এইসময়ে সতীনের উদ্যোগে জেলের ভেতরে রাজবন্দীরা ন্যূনতম খাদ্য গ্রহণ করা শুরু করেন, এবং উদবৃত্ত খাদ্য অসহায় অনাহারগ্রস্ত মানুষের জন্য বাইরে প্রেরিত হয়, এই ব্যবস্থার ফলে প্রেসিডেন্সী জেলের ভেতরে তাঁদের পাকশালার নাম হয়েছিল রিলিফ কিচেন।

১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
দেশভাগের আগে ও পরেঃ ১৯৪৫-১৯৫০

জেল থেকে বেরোনোর পরে সতীন বরিশালের কলসকাঠি গ্রামে একটি গান্ধী আশ্রম স্থাপন করেন, এবং এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁর অনুগামী নির্মল ঘোষ, কেদার সমাদ্দার, কিরণ রায় চৌধুরী, বিনোদ কাঞ্জিলাল।

১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সতীন বরিশালের হিন্দু তপশীল যুক্ত নির্বাচন কেন্দ্রে ৪৮০০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন, ওই একই কেন্দ্র থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ২৮০০০ ভোট পেয়ে তপশীলী হিসেবে নির্বাচিত হন।
সতীন ছিলেন পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধী। কিন্তু বরিশাল কংগ্রেসে দেশভাগের প্রস্তাব পালিত হয়, সতীনের জীবনীকার জানাচ্ছেন যে সতীনের অনুপস্থিতিতেই নাকি এই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল (মুখোপাধ্যায় ১৭১)। যাই হোক, সতীন দেশভাগ মেনে নেন, প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন নি, কিন্তু তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। তিনি বলেছিলেন, যতক্ষণ পূর্ব পাকিস্তানে এক জনও হিন্দু আছে, তিনি ভারতে যাবেন না (মুখোপাধ্যায় ১৭১)।

পূর্ব পাকিস্তানের জেলায় জেলায় হিন্দু নেতাদের দেশত্যাগের ফলে সেখানকার হিন্দু জনসাধারণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এই সময়ে সতীনের কাজ ছিল হিন্দুদের ওপরে অত্যাচারের খবর পেলেই তার প্রতিবিধানের জন্য সরকারী কর্তাদের দ্বারস্থ হওয়া। সতীনের জীবনীকার অনেক চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের সেই নায়কের আজ এই অসহায় দশাকে ঢাকতে পারেন নি।

“১৯৫০ সনের মধ্যভাগে বরিশাল জিলার পল্লী অঞ্চলে সুপরিকল্পিতভাবে এক ব্যাপক লুণ্ঠন, গৃহদাহ নারীহরণ ও হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান শুরু হইল! সে বীভৎসতার চিত্র অঙ্কিত না করাই শ্রেয়” (মুখোপাধ্যায় ১৭৬)।

এইসময় স্থানীয় জেলাশাসক সতীনকে ডেকে তাঁকে এই মর্মে একটা লিখিত বিবৃতিতে সই করতে বলেন যে বরিশালে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করছে, কেউ যেন গুজবে কান না দেন। সতীন সরাসরি অস্বীকার করেন, ফলে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হয়। জীবনীকার তারিখ দেন নি, তবে মনে হয় এই গণহত্যা শুরুর পরপরই ঘটনাটি ঘটে।

১৯৫০ সালের গণহত্যা সম্পর্কে কিছু কথা

এই ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ আজও করা হয় নি। জানা যায় যে আগে ঢাকায় এই হত্যালীলা শুরু হয়, তারিখটি ছিল ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫০। এবং তারপরে বরিশালে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে। পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ও বরিশালের নেতা যোগেন মণ্ডল পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসে যে পদত্যাগপত্র পাঠান, তাতে তিনি মৃতের সংখ্যা ১০০০০ বলে উল্লেখ করেন, আহত ও ধর্ষিতার পরিসংখ্যান না থাকলেও তা যে আরও বেশি ছিল ধরে নিতে অসুবিধে নেই।
দীনেশ সিংহের এ বিষয়ে প্রামাণ্য বইটি বলছে যে বরিশাল টাউন হলে সভা করে মুসলমান নেতৃবৃন্দ সতীন সেনের ওপরে চাপ দেন, তিনি যেন পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান নির্যাতন নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে কিছু বলেন (৩৮)। বোঝা যাচ্ছে এই কল্পিত ‘নির্যাতন’ নিয়ে সতীনের কিছু না বলতে চাওয়াটাও পূর্ব পাকিস্তানের শাসকপক্ষকে ক্রুদ্ধ করেছিল।

পাকিস্তানে বন্দীজীবন

সতীন সেন প্রথমবারের জন্য “স্বাধীনতা”র পরে জেলে বন্দী হলেন, ইংরেজের কারাগারে বহুবছর কাটানোর অভিজ্ঞতার থেকে অবশ্য এই অভিজ্ঞতা বেশ খানিকটা আলাদা। তিনি এই সময় পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, “কিন্তু তাঁহাকে রাখা হইল জেলের নিকৃষ্টতম ক্ষুদ্র কুটুরীর মধ্যে – না ছিল আলো-বাতাস বা অন্যবিধ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা। ছিল অখাদ্য আহার, কঠিন শয্যা, দারুণ গ্রীষ্ম ও মশার উৎপাতে নিদ্রাহীন রজনীযাপন। ইহারই মধ্যে তিনি ৮ মাসকাল অতিবাহিত করেন” (মুখোপাধ্যায় ১৭৭)।

ছাড়া পেলেন

সতীনকে মুক্তি দেওয়ার পরে ১৯৫১ সালে তাঁরই নেতৃত্বে একটি পিস মিশন কলকাতায় পাঠানো হয়, “বিভিন্ন কলোনীতে ভ্রমণ করিয়া দেশে পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তনের জন্য প্রত্যেক বাস্তুত্যাগীর নিকট তাঁহারা আন্তরিক আবেদন জানাইলেন” (১৭৮)। এই বিবরণটি কৌতুহলোদ্দীপক। এ থেকে ভাবা যেতে পারে যে সতীনের মধ্যে একটা আদর্শবাদ কাজ করছিল। এছাড়া, সতীন নেহরু নিয়াকত চুক্তির সাফল্যের সম্ভাবনায় সম্ভবত বিশ্বাসী ছিলেন (শ্যামাপ্রসাদ যাতে আস্থাহীন ছিলেন, এবং পাঞ্জাবের মডেলে পপুলেশন ট্রান্সফার বা জনবিনিময় চেয়েছিলেন), নয়ত উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে বলতেন না। অথবা, তিনি ভেবেছিলেন হিন্দুরা আবার ফিরে গেলে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হবে, ফলে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে।

আবার বন্দীজীবন

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সতীনের কোনও যোগ ছিল না, কিন্তু তাও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং প্রথমে বরিশাল জেল, তারপরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল ও সবশেষে বগুড়া জেলে রাখা হয়েছিল। এক বছর কারাবাসের পর তিনি যখন মুক্তি পান, তখন বগুড়া জেলের গেটে তাঁকে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সম্বর্ধনা জানানো হয়।

শেষ কারাবাস ও মৃত্যু

সতীনকে ১৯৫৪ সালের ১লা জুন পটুয়াখালীর স্বগৃহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, পাঠানো হয় রংপুর জেলে। এই কারাবাসকে সতীন একটা সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন, কারণ তরুণ বাঙালি মুসলমান নেতাদের অনেকে জেলে তখন। তিনি ডায়রিতে লেখেনঃ “প্রধান কর্ম্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশ্রিত হইবার সুযোগ হইল। ইহার ফল কর্মক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী হইতে পারে। Suffering এর পথে এদের দীক্ষা হইল মাত্র সুরু (sic)” (মুখোপাধ্যায় ১৯২)। সতীনের মত এমন আদর্শবাদ ও আশাবাদ অবশ্য সবার ছিল না। “একদিন কথাপ্রসঙ্গে একজন বন্দী তঁহাকে বলিয়াছিলেন – ‘মুসলমানদের দেশে Civil Liberty সম্ভব নয়, Democracy অসম্ভব, democratically minded লোক টিঁকিতে পারে না’” (মুখোপাধ্যায় ১৯৩)।

সতীন ২২শে নভেম্বর ১৯৫৪ তারিখে একটি চিঠি লেখেন ঢাকার স্বরাষ্টর দপ্তরে। তিনি জানান, তাকে বিপজ্জনকভাবে টিবি রোগীদের ওয়ার্ডের ঠিক তলায় রাখা হয়েছে, এবং ছাদ ফুটো হয়ে ওপরের নোংরা জল অনবরত তার ঘরে পড়ছে, লাগোয়া রান্নাঘরটির অবস্থাও তথৈবচ (মুখোপাধ্যায় ১৯৮-১৯৯)। এইসময় তাঁকে ঠিকমত খেতে দেওয়া হত না। তাঁর শরীর এইসময় একেবারেই ভেঙে পরে, এবং তিনি আর সুস্থ হতে পারেন নি। ২৩শে ডিসেম্বর তাঁকে পাবনা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে গিয়ে তিনি ডায়রিতে লেখেনঃ
“রংপুর জেলে শেষের দিক দিয়া এই যে ঝাঁকানি – বেশই লাগিল। এই বয়সে – এই স্বাস্থ্যে, একেবারে একাকী এই সব issue লইয়া যে struggle টা করিলাম, তাহাতে এই বয়সে আমার অতিরিক্ত মানসিক স্বাস্থ্য, শক্তি, technique ইত্যাদির পরিচয় পাইতেও বেশ সাহায্য করিয়াছে, আমার সবলতা দুর্বলতা, আদর্শ ইত্যাদির পরিচয় আমি অনেকটা পাইয়াছি।”
“আমার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য যে মনোবল, সংকল্প, অধ্যবসায়, সাহস প্রভৃতির প্রয়োজন (সত্য ও অহিংসার দরকার) organisation আয়োজনের যে প্রস্তুতির প্রয়োজন তাহার capacity আছে কি? Moslem majority সেখানে পাকিস্থানে তাহাদের চেনা, বোঝা, তাহাদের ধর্ম্ম, কৃষ্টি, ইতিহাস প্রভৃতি – সবলতা, দুর্ব্বলতা খুব ভাল করিয়া হৃদয় দিয়া, বুদ্ধি দিয়া, বুঝিয়া তাহাদের ভালবাসিতে হইবে।”

“এদের কল্যাণ চাই – এরা আমার অকল্যাণ চায় ভুলে, এতে এদেরই লোকসান। গান্ধীজীকে Jesus Christ কে তাহাদের স্বদেশবাদী হত্যা করিল। এই tragedy তো জীবনে আছে – একে boldly face করিতে হইবে। সুতরাং মানুষের এই পথ – এতেই দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণ” (মুখোপাধ্যায় ২০০-২০১)।

সতীনের অবস্থা যখন চূড়ান্ত রকমের আশঙ্কাজনক, তখন তাকে ঢাকা জেলে বদলির অর্ডার এল, ১৯৫৫ সালের ৫ই মার্চ। ১১ই মার্চ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে আনা হয়, এবং ১৩ই মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তাঁকে ভর্তি করা হয়।

“গুরুতর অসুস্থতার কারণে ১৯৫৫ সালের ১৩ই মার্চ তাঁকে ঢাকা জেল থেকে এনে ঢাকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হল এবং সেখানেই ২৫শে মার্চ রাত্রি দেড় ঘটিকায় একান্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গেল। সে সময় যদি নিজেদের লোক কেউ সেখানে উপস্থিত থাকতেন, তাহলে তিনি দেখতে পেতেন যে তাঁর নিষ্প্রান দেহের উপর পড়ে আছে একটি ‘রিলিজ অর্ডার’। তবে সেই অর্ডারটি back dated। তাঁর মৃত্যুর ২/১ দিন আগের date ছিল তাতে। এর অর্থ – তাঁর মৃত্যু বন্দী অবস্থায় ঘটে নি! মৃত্যুর সময় তিনি স্বাধীন-ই ছিলেন!

বুড়ি গঙ্গার তীরে ঢাকার শ্যামপুর শ্মশানে মোট ৬৯ জন শ্মশান বন্ধুর উপস্থিতিতে অকৃতদার সতীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি সেদিন কে করেছিলেন আজ আর তা ঠিক মনে পড়ছে না।” (ঘোষ ১৮১)।

“১১ই মার্চ ঢাকা জেল হইতে লিখিত তাঁহার শেষ পত্র শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার দাস মহাশয় ১৮ই মার্চ পান। তাহাতে লিখিত ছিল সতীন্দ্রনাথের সহিত অবিলম্বে সাক্ষাৎ করিবার কথা। অবশ্য তিনি সতীন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান ২৫শে মার্চ রাত্রি এগারোটার সময় – যখন সতীন্দ্রনাথ ছিলেন মরণের প্রতীক্ষায় অচৈতন্য। একজন আই বির লোক তাঁহাকে সংবাদ দিল যে সতীন্দ্রনাথকে মুক্ত করা হইয়াছে, এখন হাসপাতালে দেখিতে যাইতে পারেন। অচৈতন্য সতীন্দ্রনাথকে তখন oxygen দেওয়া হইতেছিল। তাঁহার বুকের উপর সাদা কাগজে হস্তলিখিত একটুকরা কাগজে তাঁহার মুক্তির সংবাদ লিখা ছিল, যখন এই তথাকথিত মুক্তি দেওয়া হয় তখন তিনি ছিলেন জ্ঞানহীন – শেষ নিশ্বাসের প্রতীক্ষায়। রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকার সময় তাঁহার শেষ নিশ্বাস মহা অনন্তে মিলাইয়া গেল। শেষ মুহূর্ত্তে শয্যাপার্শ্বে কেহ ছিল না, কেহ দেখিলনা, কেহ চোখের দুই ফোঁটা অশ্রু পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন করিতে পারিলনা।” (মুখোপাধ্যায় ২০৬)।

শোনা যায়, সতীনকে তাঁর শেষ সময়ে দেখে কৌতূহলী ডাক্তারির ছাত্র ও সেবিকারা প্রশ্ন করেছিল, আপনার কি কেউ নেই? (মুখোপাধ্যায় ২১০)। সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানে অবশিষ্ট হিন্দুরা সাহস করে সতীনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারত না, পাছে তারাও গ্রেপ্তার হয়ে যায়। তবে ঘোষ বা মুখোপাধ্যায় কেউ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেননি যে এতবড় নেতার শেষ দিনগুলিতে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মত কাউকে পাওয়া গেল না কেন।

শেষ প্রহসন অবশ্য বাকি ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ২৬শে মার্চের একটি প্রেসনোটে বলেনঃ “অসুস্থতার জন্য শ্রী সতীন্দ্রনাথ সেনকে গতকল্য (২৫শে মার্চ) মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির অব্যবহিত পরেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া শ্রীযুত সেনের মৃত্যু হয় – ইহা খুবই দুঃখের সংবাদ এবং গভর্ণমেন্ট এজন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন।”

কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে মৃত্যু শংসাপত্র দেন, তাতে লেখা ছিল, Satindra Nath Sen, Security Prisoner, C/o Supdt, Dacca Central Jail অর্থাৎ, এই মুক্তির ব্যাপারটা এমনকি নেহাত কাগুজে ব্যাপারও নয়। এটা সম্ভবত কাগজে কলমেও হয়নি, নয়ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সেই মুক্তির নির্দেশিকা থাকা উচিত ছিল, এবং ডেথ সার্টিফিকেটে তাকে বন্দী হিসেবে উল্লেখ করা প্রমাণ করছে যে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার স্রেফ মিথ্যাচার করেছিলেন ওই প্রেসনোটে।

পর্যালোচনা

সতীনের মৃত্যু অবশ্যই কাস্টোডিয়াল ডেথ পর্যায়ে পড়ে। তাঁকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, এ প্রসঙ্গে ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীরের জেলে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। তাঁর জীবন থেকে যেমন, তাঁর মৃত্যু থেকেও শেখার আছে। যে আদর্শবাদ ও আশাবাদের বশবর্তী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জেলে সতীনের এই মৃত্যুবরণ, তাঁর ওপরেই অনেক প্রশ্ন তুলে দেয় তাঁর শেষ দিনগুলির করুণ ইতিবৃত্ত।

সতীন সেন সংসারে ছিলেন সন্ন্যাসী, বললে অত্যুক্তি হবে না। সে সময়ে অনেক স্বদেশী কর্মীই কিন্তু সত্যি সত্যি সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলেন, এমন অনেক উদাহরণ আছে। অনেকে অবশ্য সন্ন্যাসী হওয়ার পরে স্বদেশী কাজকর্মকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর বড় উদাহরণ। কিন্তু বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে এরকম আরও বেশ কিছু উদাহরণ স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেখা যায়। শরৎচন্দ্র সেন ছিলেন ভোলা অঞ্চলের বিখ্যাত আইনজীবী, তিনি প্রথমে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপরে সন্ন্যাস গ্রহণ করে হিমালয়ে চলে যান, নাম হয়েছিল স্বামী পূর্ণানন্দ গিরি (মুখোপাধ্যায় ১৭)।

বরিশাল কংগ্রেসের সম্পাদকের দায়িত্বে সতীনের ঠিক আগেই যিনি ছিলেন, সেই সর্বজনশ্রদ্ধেয় শরৎচন্দ্র ঘোষও ঠিক এভাবেই হঠাৎ করে বরিশাল ত্যাগ করে চলে গেছিলেন বৃন্দাবনে, নাম নিয়েছিলেন স্বামী পুরুষোত্তমানন্দ (মুখোপাধ্যায় ১৩০-১)।
সতীন যদিও সংসার করেন নি (কারণ বিয়ে করেন নি), কিন্তু সংসারকে ত্যাগও করেন নি, আমৃত্যু মানুষের পাশে থেকেছেন, বরিশালের মানুষের পাশে, বাংলার মানুষের পাশে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থেকেছেন। তিনি সংসারের মধ্যে থেকেও সন্ন্যাসী ছিলেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, প্রত্যহ সকালে গীতা পাঠ করতেন সতীন (মুখোপাধ্যায় ১৮১)। কিন্তু সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি, রাজনীতির বেড়াজাল ছেড়ে বেরিয়ে যান নি, কারণ তিনি কর্মযোগী ছিলেন। এই কর্মনিষ্ঠার আদর্শের প্রয়োজন আজ আরও বেশি।

সতীন সম্পর্কে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলছেন যে উনি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে বিশেষ সম্মানিত ছিলেন। লিয়াকত আলি, পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আসেন এবং এক ঘণ্টা ধরে সতীনের সঙ্গে বার্তালাপ করেন, এবং লিয়াকত নাকি সতীনের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে পড়েন, এবং পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ হিসেবে বলেন, এখানে সতীন সেনের মত নেতাও থাকতে পারছেন (১৭৫-৭৬), বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় সতীনকে যখন গ্রেপ্তার করে পুলিস, জেলের মধ্যে নাকি মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিব ইত্যাদি সবাই সতীনের গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন (১৮০)। এগুলো আশুতোষের বইয়ের শেষের দিকটাকে ভারাক্রান্ত করেছে। এগুলো সম্ভবত সতীনের পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়াকে ভ্যালিডেট ও জাস্টিফাই করার প্রয়াস।
কিন্তু সতীন যদি সত্যিই মুসলমান রাজনীতিবিদদের মুগ্ধ করে থাকেন, সেটা খুব একটা অবিশ্বাস্য মনে করার কারণ নেই। সতীন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি সমস্ত আলাদা আলাদা শিবিরের সম্মানভাজন হয়েছেন, এমন দুর্লভ সার্বজনীন স্বীকৃতি সম্ভবত আর কোনও বাঙালি রাজনীতিবিদের জোটে নি।

সতীন সেন বামপন্থী ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন।
“বরিশাল জেলায় কংগ্রেসি দেশপ্রেমিকদের মুকুটহীন রাজা ছিলেন সতীন্দ্রনাথ সেন, সার্বজনীন সতীনদা । বলা বাহুল্য সে মুকুট কণ্টকনির্মিত ।বয়ঃপ্রাপ্তির পর তাঁর পরিণত জীবনের অর্ধেকেরও বেশী কাটে জেলখানায় । শেষ দশ বছর কাটে পাকিস্তানি জেলে । সেখানেই যক্ষ্মারোগে বিনা চিকিৎসায় ওঁর মৃত্যু হয় । স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ভারতবাসী তাঁকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের পরিষদ ভবনে এবং লোকসভার দেওয়ালে ওঁর ছবি ঝুলছে । কলকাতায় এক চৌমাথার মোড়ে ওঁর আবক্ষ প্রস্তরমূর্তিও স্থাপিত হয়েছে । কিন্তু ওঁর এবং ওঁর সহকর্মীদের আড়ম্বরহীন আত্মত্যাগ, আজীবন দুঃখবরণ আমরা মনে রাখিনি । আমাদের সাম্প্রতিককালের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যে অনেকাংশে সেই ত্যাগের মূল্যে কেনা, এ চেতনা ক্ষীণ হতে হতে প্রায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে । (বাঙালনামা)

চিত্তাকর্ষকভাবে, অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা সতীন্দ্রনাথকে তাঁদের নিজেদেরই একজন বলে মনে করতেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় অমলেন্দু ঘোষের “শতবর্ষের আলোকে বিপ্লবী সতীন্দ্রনাথ সেন” প্রবন্ধে (বিপ্লবীদের স্মরণে ও সান্নিধ্যে পুস্তকে সঙ্কলিত) ।
সতীন আজীবন যুগান্তর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সতীন ছিলেন যুগান্তরের নেতা অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিপিন গাঙ্গুলী, কিরণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিকুমার চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ ঘোষ চৌধুরীর আশীর্বাদ ধন্য। কংগ্রেসের নেতা হওয়ার পরেও তাঁর সঙ্গে যুগান্তর নেতা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ ও পূর্ণচন্দ্র দাসের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল। এমনকি বরিশালের অনুশীলন সমিতির নেতা যতীন রায়, গোপাল মুখোপাধ্যায়, দেবেন ঘোষ প্রমুখের সঙ্গেও সতীনের পারস্পরিক বিশ্বাসের সাবলীল সম্পর্ক ছিল, এবং একসঙ্গে বহুবার কাজ করেছেন (মুখোপাধ্যায় ১৮৫-৬)।

এদিকে সতীনের সহযোগী আশুতোষ মুখার্জি যে জীবনীগ্রন্থটি রচনা করেন, তার মুখবন্ধ লিখেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়।

একইসঙ্গে বিপ্লবী, কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের কাছ থেকে সাধুবাদ পেয়েছেন সতীন সেন। হিন্দুদের জন্য তাঁর অক্লান্ত আত্মত্যাগ মদন মোহন মালবীয়ের ন্যায় হিন্দু মহাসভার নেতাকেও মুগ্ধ করেছিলঃ তাঁদের সাক্ষাতের সময় তিনি নিজের আসন পরিত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে সতীনের উদ্দেশ্যে বলেনঃ Let us all honour the hero of Bengal (মুখোপাধ্যায় ১৩৬)। মনে করাই যায় যে নিপীড়িত হিন্দুদের হয়ে কথা বলার জন্য কংগ্রেসের ভেতরে সতীনের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হয়েছিল (অথচ সতীনের মত অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু মুসলমানে প্রকৃত সমদর্শী নেতা বিরল)। আশুতোষের মতে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পেছনে সময় না দেওয়াই এর কারণ – এবং বাস্তবিকপক্ষে এর সবগুলিই কারণ হতে পারে। সতীনের জীবনচর্যা ছিল সোজাসাপটা, হিপোক্রিট ছিলেন না তিনি, এজন্য রাজনীতিতে হয়ত বেমানান ছিলেন। শোনা যায় তিনি কলকাতার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগও রাখতেন না, তাঁর অন্তরঙ্গ নির্মলরঞ্জন দাশগুপ্তই সেই কাজটি করতেন (মুখোপাধ্যায় ১৩৩)। কংগ্রেসী রাজনীতিতে উঁচু পদ না পেলেও নিঃসন্দেহে সতীন সারা বাংলায় আপামর বাঙালির আশা ভরসার স্থল হয়ে উঠেছিলেন। দেশের জন্য এভাবে আত্মনিবেদন করতে সবাই পারেন না। সতীন পেরেছিলেন।

সতীন এজন্য এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি আজ আমাদের আদর্শ হতে পারেন।

সতীনের সমসাময়িক দুই রাজনীতিবিদ, বরিশাল থেকে উঠে আসা ফজলুল হক ও যোগেন মণ্ডলকে নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, সে তুলনায় সতীন উপেক্ষিতই থেকে গেছেন। অথচ এই দুজনের সঙ্গে সতীনের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই, দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ সতীন করেছেন, তার কণামাত্রও এরা করেন নি। সতীন স্বার্থান্বেষণ করেননি কোনওদিন, যে কথা এই দুজনের সম্পর্কে বলা যাবে না।

দুর্ভাগ্য যে তাঁর নিজের লেখা কিছু পাওয়া যায় না, তবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলছেন, তিনি ডায়রি লিখতেন। তাঁর লেখা শেষজীবনের ডায়রি থেকে উদ্ধৃতিও রয়েছে আশুতোষের জীবনীগ্রন্থে। তাঁর নিজের লেখালেখি, সাক্ষাৎকার, তাঁর সম্পর্কে আলোচনা সহ একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশ করলে আমাদের অকৃতজ্ঞতার ভার কিছুটা লাঘব হবে।

তথ্যসূত্র

তপন রায়চৌধুরী। বাঙালনামা
অমলেন্দু ঘোষ। বিপ্লবীদের স্মরণে ও সান্নিধ্যে
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুঞ্জয়ী সতীন সেন
দীনেশচন্দ্র সিংহ। ১৯৫০: রক্তরঞ্জিত ঢাকা বরিশাল এবং
সতীনের শুরুর জীবনের দীক্ষাগুরু স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ বিষয়ে জানতে
বরিশালের শঙ্কর মঠঃ অতীত ঐতিহ্যের সমুজ্জ্বল সাক্ষর<http://bdn24x7.com/?p=6277>
বরিশালের শঙ্কর মঠ <http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2011-07-17/news/170905>

No comments:

Post a Comment