Thursday 10 November 2016

'রাষ্ট্রপিতা' সুরেন্দ্রনাথ

- তমাল দাশগুপ্ত

এই দেশে রাষ্ট্রপিতা বা ফাদার অভ দ্য নেশন আখ্যা প্রথম কাকে দেওয়া হয়েছিল, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, আজ আর কেউ জানে না। না, গান্ধী সেই ব্যক্তি নন। 

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তাকেই প্রথম রাষ্ট্রপিতার আখ্যা দেওয়া হয়, গৌরকিশোর ঘোষের একটা লেখায় জানতে পাচ্ছি। যদ্দুর আমি বুঝলাম, এরপরে, মরণোত্তর কালে ওটাকে রাষ্ট্রগুরুতে চেঞ্জ করা হয়েছিল, কারণ ততদিনে ওই রাষ্ট্রপিতা খেতাবের অন্য একটা পাকাপাকি জবরদখল হয়ে গেছে। 



আমি বাঙালি স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস যতই পড়ছি, ততই একটা প্রতীতি জন্মাচ্ছে। 

আমাদের মধ্যে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছিল বললে অল্প বলা হয়। আসলে ইংরেজ ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী এলিট বাঙালির সঙ্গে স্বদেশী বিপ্লবঘেঁষা বাঙালির কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছিল। আমাদের মডারেট অংশটির সঙ্গে আমাদের চরমপন্থীদের সাপে নেউলে সম্পর্ক হয়ে গেছিল। সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শেষ বাঙালি নিয়ন্ত্রক। সি আর দাশ (ততদিনে বাংলার অবিসংবাদী নেতা) সুরেন্দ্রনাথকে কোনঠাসা করে দিলেন, ব্যারাকপুর কেন্দ্রে জনৈক ডাক্তারকে দাঁড় করিয়ে দিলেন সুরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এবং সুরেন্দ্রনাথকে হারিয়ে সেই ডাক্তার, তার নাম বিধান রায়, জায়ান্ট কিলার বলে প্রখ্যাত হলেন। কিন্তু নেপোয় দই মেরে দিল, কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল গান্ধীর হাতে।

১৯২৩ সাল। এর পর সুরেন্দ্রনাথ আর মাত্র দুবছর বেঁচেছিলেন।

আজ সুরেন্দ্রনাথের জন্য মন খারাপ হচ্ছে। শেষজীবনে অপমানিত হয়েছেন, বাঙালি দুয়ো দিয়েছে। আবার বাঙালির রক্তে তখন সর্বনাশের নেশা, এই জাতি রুষ্ট হয়েছে, সেই মহাক্রোধ রুদ্ররূপী মহাকাল হয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ছারখার করে দিতে উদ্যত। কাকে দোষ দেব? 

সুরেন্দ্রনাথকে জানলে বাঙালির এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের অস্তরাগ জানা যায়। বাঙালি তখন ইংরেজ রাজত্বের সেকন্ড ইন কম্যান্ড। এই দেশ বাঙালিকেই দিয়ে যেতে হত, কলকাতা আবার হত এই দেশের রাজধানী, যদি বাঙালি রাজনীতির কূটনীতি ঠিক ভাবে করত সেসময়।

আমরা কি ঠিক করেছিলাম? সুরেন্দ্রনাথ আর চিত্তরঞ্জনের মধ্যে আমরা দ্বিতীয়জনকে বেছেছি, আমরা কি ঠিক করেছিলাম? ইতিহাস বলছে, এই জাতির তখন এক দুরন্ত যৌবন এসেছে। বঙ্কিম বিবেকানন্দ অরবিন্দ আমাদের বিপ্লবে দীক্ষা দিয়ে গেছেন। সেই রোমাঞ্চ এই জাতির জীবনে খুব দরকার, অনেকটা যৌবনে যৌনতা যেমন দরকার।

বাঙালি যেন একটা উড়নচণ্ডী প্রেম করেছে তখন। বাঙালি শান্ত ধীর স্থির থেকে বাবা মায়ের বাধ্য ছেলে-মেয়ে হয়ে সাজানো গোছানো বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই পারত। কিন্তু বাঙালি ঘর ছেড়েছে, অবাধ্য সন্তানের মত। বিপ্লবের সঙ্গে তার সপ্তপদী। তার ফলে যে ভোগান্তি, যে নির্যাতন, যে কষ্ট, যে অবর্ণনীয় যন্ত্রনা, যে শাস্তি সে পেয়েছে, বাংলাকে টুকরো করে, বাঙালিকেই উচ্ছেদের যে বিশ্বমানবিক বন্দোবস্ত ইংরেজ করে গেছে, সে বর্ণনা করতে গেলে শরতবাবুকে আবার কলম ধরতে হয়। সে চিরন্তন দুঃখী রূপকথা পাষাণেরও চক্ষু সজল করে দেবে।

বাঙালি কি ভুল করেছে? জাগতিক হিসেবে ভুল তো বটেই। তবে আহা, এমন ভুল কি যে সে করতে পারে গো? এর জন্য কলজের জোর লাগে, হৃদয়ের অনুরাগ লাগে, মস্তিষ্কের অকুতোভয়তা লাগে। পৃথিবীতে আর কটা জাতের আছে?

তবে ওই আর কি। রাজার দুলালী আজ ভুঁয়েতে গড়ায়। হায় বিধি নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।

(সপ্তডিঙা ২০১৬ মার্চ সংখ্যায় অণুপ্রবন্ধ সংকলনে প্রকাশিত, ১০ মার্চ ফেসবুকের পোস্ট) 

No comments:

Post a Comment