Thursday 22 September 2016

শেকড়, আত্মপরিচয়, যুদ্ধপ্রস্তুতিঃ বঙ্কিম ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পথ দেখিয়ে গেছেন আমাদের - ডঃ তমাল দাশগুপ্ত



(“ধ্রুপদী মানো বাংলাভাষাকেঃ চর্যা প্রকাশের একশো বছরশীর্ষক কর্মশালায় ডঃ তমাল দাশগুপ্ত প্রদত্ত কিনোট অ্যাড্রেস, মহাবোধি সোসাইটি, কলকাতা, ২৭শে আগস্ট ২০১৬)


                                                             (১)


এই দগ্ধ সময়ে, এই বিপন্ন স্বপ্নের দিনদুপুরে, আমাদের গভীরতম ক্ষতর লাল ছুঁয়ে যখন যাত্রা শুরু হবে, তখন মা কালী আমাদের আশীর্বাদ করবেন। তখন শ্রীরাধা আমাদের আশীর্বাদ করবেন, তখন মা দুর্গা আমাদের আশীর্বাদ করবেন, তখন আকাশ থেকে আমাদের পূর্বসূরীরা শঙ্খধ্বনি করবেন, তখন গঙ্গা আর সাগরের সঙ্গমে নিগু ডাকিনীর খোলা চুল মেঘলা বাতাসে উড়বে, তখন নাড়োপা মন্ত্র উচ্চারণ করবেন, তখন বিক্রমশীলা আর নালন্দা নতুন করে জেগে উঠবে সমস্ত ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ...
 
বাঙালির শেকড়, বাঙালির আত্মপরিচয়। তার সন্ধানে আগামী এক ঘণ্টা সময় কাটাতে চলেছি আমরা। যুদ্ধপ্রস্তুতির কথাও বলব, কারণ একটা যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
 
প্রথমেই একটু টাইম ট্র্যাভেল করতে হবে, কারণ বাঙালির স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। একটা ছবি হয়েছিল হলিউডে ২০১২ সালে, দ্য ভাও মানে ওই প্রেম প্রতিজ্ঞা বলতে পারেন। তাতে অ্যাকসিডেন্টের ফলে হিরোইন, রেচেল ম্যাকঅ্যাডামসের স্মৃতি চলে যায়। এখন স্মৃতি চলে যাওয়ার ফলে কি হল, তার কিছু আত্মীয় সেটার সুযোগ নিয়ে তাকে তাঁর বরের থেকে আলাদা করার চেষ্টা শুরু করল। ছবিটাতে স্মৃতি ফিরে আসার কোনও মির‍্যাকল দেখানো হয়নি। মেয়েটির বরকে ধৈর্য ধরে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল।
 
যোদ্ধারা, আশা করবেন না যে হারানো সুর ছবির মত আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে বাঙালির মনে পড়ে যাবে, সে কে। তার মনে পড়ে যাবে শেকড়ের কথা, মনে পড়ে যাবে তার আত্মপরিচয় কি। উঁহু। ওরকম এখন সিনেমাতেও হয় না, বাস্তব তো দূরস্থান। তাহলে রাস্তাটা কি? ধৈর্য ধরে কাজ করতে হবে। ধৈর্য ধরে বাঙালির পাশে থাকুন, তার সঙ্গে থাকুন, তার হাত ধরুন, তাকে স্টাডি করুন। আরও অনেকে বাঙালিকে ভোলাতে চাইছে, এবং আত্মবিস্মৃত জাত তো, কাজেই তাদের প্রয়াস অনেক সময়েই সফল হচ্ছে। এদের ওপরে সতর্ক নজর রাখুন, সুযোগমত এদের মুখোশ খুলে দিন।
যা বলছিলাম, একটা টাইম ট্র্যাভেল করতে হবে। টেক অফ করার আগে, ফাস্‌এন ইয়োর সিটবেল্টস। মানে রাইটিং প্যাড আর পেন রেডি রাখুন হাতে।

প্রথমত, শেকড় কেন জরুরি? গাছের জন্য শেকড় জরুরি হতে পারে, মানুষের জন্য কেন? থেমে থাকার সময় জাহাজের জন্য নোঙর জরুরি, চলার সময় পাল আর মাস্তুল। কুঁড়েঘরের একটা শক্ত খুঁটি দরকার, প্রাসাদের দরকার ভিত্তি আর স্তম্ভ। মানুষের কি প্রয়োজন?

অবলম্বন।

অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ হল জুন পলিটিকোন, রাজনৈতিক প্রাণী, তবে এখানে পলিটি অর্থ যা, তাতে সামাজিক প্রাণী বললেও ভুল হয় না। মানুষের একটা কমিউনিটি প্রয়োজন। টেরি ইগলটন মিনিং অভ লাইফ, জীবনের মানে খুঁজতে বসেছিলেন তার এপনিমাস বইটিতে, মানে সে বইয়ের নামই মিনিং অভ লাইফ। তাতে শেষপর্যন্ত বলছেন, জীবনের অর্থ ভালোবাসা, মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা।
 
মানুষের বায়োলজি এমন যে সে সঙ্ঘবদ্ধ হতে বাধ্য। মানুষের বাচ্চা একটা পরিবারের সাহায্য ছাড়া বড় হতে পারে না। এই কারণেই মানুষের সম্প্রদায় গঠনের অভ্যেসকে মানুষের জৈবিক স্ট্রাকচারের সঙ্গে এক করে দেখার একটা প্রয়াস করেছেন অনেক সমাজতাত্ত্বিক (স্টিভেন গ্রসবি যেমন)। এদিকে মানুষের এই যে জাতি গঠনের প্রক্রিয়া, সেই ইম্যাজিনড কমিউনিটি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা করা হয়েছে।
 
আমার গতবছরের একটা ফেসবুক স্টেটাস থেকে পড়ছি।
ইজরায়েলের সমাজবিজ্ঞানী ইউভাল হারারি একটা চমৎকার বই লিখেছেন। স্যাপিয়েন্সঃ আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ হিউম্যানকাইণ্ড। তাতে বলছেন, কাল্পনিক সম্প্রদায় (ঠিক এই শব্দটা ব্যবহার করছেন না অবশ্য, তবে এটাই বোঝাচ্ছেন) গঠন করতে পারাই মানুষের সবথেকে বড় শক্তি, যার ফলে সে বাকি প্রতিযোগীদের হটিয়ে দিয়ে পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করতে পেরেছে।
 
জাতি একটা কাল্পনিক সম্প্রদায়, বলেছেন বেনেডিক্ট অ্যাণ্ডারসন। সরাসরি, তাৎক্ষণিক ও সংশ্লিষ্ট (ইমিডিয়েট) নয়, এমন সব সম্প্রদায়ই কাল্পনিক। আমি যাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তারাই শুধু আমার সঙ্গে তাৎক্ষণিক সম্প্রদায় গঠন করতে পারে, বাকি সবই কাল্পনিক সম্প্রদায়। এর ফলে জাতি ও জাতীয়তাবাদকে যারা ভুয়ো, মনগড়া ইত্যাদি ভেবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বেড়ান, তারা জানলে রোমাঞ্চিত হবেন যে কমিউনিস্ট পার্টিও এই কাল্পনিক সম্প্রদায়ের তালিকায় আসবে। ইসলাম সহ সমস্ত গ্লোবাল ধর্ম আসবে এই তালিকায়। এমনকি, ফেসবুকও একটা কাল্পনিক সম্প্রদায়।
 
আরেকটা ব্যাপার আছে। এই কাল্পনিক সম্প্রদায় থেকে অতিদ্রুত সংশ্লিষ্ট, ইমিডিয়েট সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। বাঙালি ইম্যাজিনড কমিউনিটি, ঠিক, কিন্তু সপ্তডিঙা Shoptodina সেই ইম্যাজিনড কমিউনিটির ওপরে ভিত্তি করে একটা ইমিডিয়েট কমিউনিটি গড়ে তুলেছে্‌ যেখানে আমরা সবাই সবাইকে চিনি, জানি, এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করছি বাঙালির জন্য, এবং এর মাধ্যমে একটা ইম্যাজিনড সম্প্রদায় থেকে জন্ম নিচ্ছে ইমিডিয়েট সম্প্রদায়।"

বস্তুত জাতি বলে কিছু হয় না, পুরোটাই কাল্পনিক, বানানো গল্পগাছা, ইনভেন্টেড ট্র্যাডিশন, এই বক্তব্য যে বহুলাংশেই অসার সেটা আমাদের তুলে ধরতে হবে শিক্ষিত বাঙালির সামনে। এবং এই শিক্ষা বঙ্কিমের। পশ্চিমের সমকালীন তাত্ত্বিকদের গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন বঙ্কিম। ট্যালবয়েস হুইলার আর লাসেন, এই দুজন ইন্ডোলজিস্টের উল্লেখ আছে বঙ্কিমে, বঙ্কিম এদের ছিন্নভিন্ন করেছিলেন। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, এই হুইলার আর লাসেন আজও পশ্চিমী তাত্ত্বিকদের কাছে ভীষণভাবে মান্য, যেমন আস্কো পারপোলা তার সাম্প্রতিক বই দ্য রুটস অভ হিন্দুইজমে বেশ কয়েকবার এদের উল্লেখ করছেন খুব সম্মানের সঙ্গে। কিন্তু একজন শিক্ষিত বাঙালির কথা ভাবুন তো, যিনি বঙ্কিমের সেই সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা সেই সূচীমুখ ব্যঙ্গ ভুলে এই দুই পণ্ডিত যা বলেছেন সেগুলো অ্যাকসেপ্ট করবেন?

বঙ্কিম ভিন্ন আদর্শ নেই, এ কথাটা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে শরদিন্দু বলেছিলেন। উনি নবীন বাঙালি গদ্যলেখকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, কিন্তু আমি বলি কথাটা সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতির জন্য সত্য। বঙ্কিম ছাড়া আর কোনও আদর্শ নেই।

বঙ্কিম যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেনাপতির কাজে অগ্রসর হলেন, বাঙালির তখন এক দিশেহারা অবস্থা, ছত্রভঙ্গ অবস্থা। ইংরেজের শিক্ষায় শিক্ষিত, ইংরেজের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম। তিনি যখন বাঙালির ইতিহাস অনুসন্ধানের কর্তব্যে ব্রতী, অভিমন্যুর মত তাঁর সামনে শুধু পিতৃতুল্য ঈশ্বর গুপ্তর শিক্ষা, যে বাঙালিকে তার শেকড় চিনতে হবে, নিজের স্বদেশকে ভালোবাসতে হবে। ঈশ্বর গুপ্তের সেই অসামান্য, অমোঘ উচ্চারণ, ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে, প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া, কতরূপে স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।

এখন এই যে কথাটা, যে বাঙালি হয়ে জন্মে, বাঙালি জাতিকে ভালোবাসতে হবে, এই যে জাতীয়তাবোধ, সেটা তো তার আগে ছিল না, এবং বলা হয়, এই শিক্ষা প্রথম ঈশ্বর গুপ্তের, স্বদেশপ্রেমের চিন্তা তিনিই প্রথম বাঙালিকে করতে শেখান। তার আগে লোকে নিজের জাত, নিজের সম্প্রদায়, নিজের গ্রাম, নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডীর বাইরে চিন্তা করতেই ভুলে গিয়েছিল।



কথা হচ্ছে, এইবার বঙ্কিম যখন এই কাজের একটা মেথডনির্মাণে পায়োনিয়ার হয়ে অগ্রসর হলেন, তখন তাঁর অবস্থা এরকম, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর কিন্তু তাকে করতে হবে তরবারিযুদ্ধ। পদে পদে বিপদের আশঙ্কা ছিল, ভুল হতে পারত, তিনি অ্যান্টিকোয়ারিয়ান বা পুরাতত্ত্ববিদ ছিলেন না বাই ট্রেইনিং, অথচ বাঙালিকে শেকড়ে ফেরার এমন উদাত্ত ডাক আর কেউ দিতে পারেন নি আজ পর্যন্ত। পণ্ডিতেরা নিজের গণ্ডির বাইরে বেরোন না একরাটত্ব হারানোর ভয়ে, আর বঙ্কিম সেখানে বাঙালির স্বার্থে অচেনা দেশে (কারণ অতীত তো অচেনা দেশই) গিয়ে সমস্ত ঝুঁকি, পরাজয়, নিন্দার ভয় অগ্রাহ্য করে বাঙালি আত্মপরিচয়ের কথা বলার ডাক দিচ্ছেন। এ থেকে শিখতে হবে। বাঙালির জন্য ভালো যোদ্ধা, উৎসর্গপ্রাণ যোদ্ধা সে-ই, যে প্রয়োজনে নিশ্চিন্ত চেনাপরিচিত ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে কাজ করবে। রিসার্চ ফেলো ওয়ার্কশপে আসবে, তাতে আশ্চর্য কি? বাঙালির জন্য যোদ্ধা তখন হবেন যখন উৎকল ভবন লেনিন সরণীর সামনে জয়দেবকে চুরি করার চর্যাপদকে হাতিয়ে নেওয়ার, ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন করবেন।

আমি বাংলা নিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা করিনি, ইতিহাস নিয়ে প্রথাগত ডিগ্রি আমার নেই। আমি পশ্চিমী সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু কাজ করছি, কারণ কাজটা কাউকে এগিয়ে এসে করতে হবে, কাউকে হাল ধরতে হবে। ধরুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সেখানে কর্ণের মুখোমুখি হতে হবে পাণ্ডবপক্ষের এমন এক যোদ্ধাকে যিনি ভল্ল চালাতে দক্ষ, কিন্তু চালাতে হবে তীরধনুক। প্রাণসংশয় হতে পারে, কিন্তু তাও সে যুদ্ধ করতেই হবে, এই বঙ্কিমের শিক্ষা, এই শিক্ষা যেন বিস্মৃত না হই।

                                                           (২)

বাংলার ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, কত পুরোনো? এই প্রশ্নটা করার আগে আমি আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই। আর্য আক্রমণ তত্ত্ব সম্পর্কে আপনারা অনেকেই শুনেছেন (এ আই টি, এরিয়ান ইনভেশন থিওরি)। অথবা এরিয়ান মাইগ্রেশন থিওরি (এ এম টি)। বঙ্কিমের সময় এ তত্ত্বটি সর্বগ্রাসী, এবং শিক্ষিত বাঙালির এতে না বিশ্বাস করে কোনও উপায় ছিল না। আজ অবস্থাটা কিরকম

আমি এ এম টির পক্ষে এবং বিপক্ষে দুজন তাত্ত্বিককে নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা করব। প্রথমে এমন একজন তাত্ত্বিককে নেওয়া যাক, যিনি বিশ্বাস করেন এ এম টি তে। আস্কো পারপোলা। হেলসিঙ্কিতে পড়ান, জাতিতে ফিনিশ, বিখ্যাত ইন্ডোলজিস্ট। দ্য রুটস অভ হিন্দুইজমঃ দি আর্লি এরিয়ান্স অ্যান্ড দি ইন্ডাস সিভিলাইজেশন। দুহাজার পনেরো সালে প্রকাশিত, ভারতে বইটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করে।

পারপোলার সবথেকে বিখ্যাত কাজ অবশ্য ডিসাইফারিং দ্য ইন্ডাস স্ক্রিপ্ট, সেটা ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। উনি দ্রাবিড় হাইপোথিসিসে বিশ্বাসী, অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতা (উনি সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতা বলেন না) ছিল দ্রাবিড়ভাষী, ওর মতে। উনি ক্ল্যাসিকাল তামিল কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করেছিলেন ২০১০ সালে, দেখবেন উইকি আর্টিকলে ওর সেসময়ের ছবি দেওয়া আছে। আচ্ছা, ধরুন যেদিন আমাদের বাংলা ভাষা ধ্রুপদীর মর্যাদা পাবে, কথার কথা, কারণ আমরা জানি বাংলার হয়ে বলার কেউ নেই, বাংলার হয়ে বাঙালিই বলে না, কিন্তু ধরুন যদি পায়, এবং তারপরে কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা ক্ল্যাসিক্যাল বেঙ্গলি কনফারেন্স আয়োজন করে, সেদিন কি আমাদের ডাকবে? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।
 
আস্কো পারপোলা মূলত ভাষাবিদ। মনে রাখতে হবে, আর্যজাতির তত্বটা ভাষাবিদ উইলিয়াম জোন্সই প্রথম আবিষ্কার করেন। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অস্তিত্ব, ভারত থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু এর ওপরে নির্ভর করে এই যে আর্য মাইগ্রেশনের একটা তারিখ দিচ্ছেন সেই আদ্যিকাল থেকে আজকের পারপোলা পর্যন্ত সমস্ত পশ্চিমী তাত্ত্বিক, সেটা মোটামুটি দুহাজার বিসি, সেটা চূড়ান্ত অ্যারবিট্রারি। যদি স্টাডি করতে শুরু করেন, প্রথমেই হোঁচট খেয়ে দেখবেন তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। ঋগ্বেদ থেকে কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, যে এরা বহিরাগত। কোনো পুরোনো হোমল্যান্ডের কথা বলা নেই। সরস্বতী নদীর কথা অবশ্য বারবার বলা আছে। এই সরস্বতী নদীটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এখুনি সঞ্জীব সান্যালের দুটো বইয়ের কথায় আসব।

পারপোলার বিস্তারিত সমালোচনা করা আমাদের কাজ নয়। কিন্তু বারবার দেখবেন, অত্যন্ত অ্যারবিট্রারি, র‍্যান্ডম ভাবে উনি ইতিহাসের টাইমলাইনগুলো সাজাচ্ছেন। পারপোলার মত পাণ্ডবরা এসেছিল ইরান থেকে (হিমালয়ের পার্বত্যপ্রদেশ থেকে এসেছিল, সেটাই কিন্তু অধিকতর যুক্তিযুক্ত), এবং সেই আসার সময় বলছেন ৮০০ থেকে ৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। আবার ধরুন পারপোলা যখন বলছেন যে সংস্কৃত পাণ্ডু কথাটা প্রোটো দ্রাভিডিয়ান পাল, পান্ড থেকে এসেছে, এই পাল থেকে সংস্কৃত ফলও এসেছে (১৪৯)। কেন? না ফল পাকলে ইয়েলোইশ রঙ হয়। এখন যেটা পারপোলা ভেবে দেখছেন না, তা হল এই যে ইংরেজি পেল কথাটা এল ল্যাটিন পালিডাস থেকে, এই ল্যাটিন শব্দটিও যদি প্রোটো দ্রাভিডিয়ান পাল, পান্ড থেকে আসে, তাহলে এ এম টি একেবারেই বাতিল হয়ে যায়। ভেবে দেখুন। যারা এ এম টি/ এ আই টির বিরুদ্ধে, তারা ভাষাগত প্রমাণগুলো নিয়ে একেবারেই কাজ করেন না। কিন্তু হিস্টোরিক্যাল লিঙ্গুস্টিক্স দিয়ে প্রমাণ করা যায়, যদি আদিকালে সংস্কৃতে প্রবিষ্ট দ্রাবিড় লোনওয়ার্ড থেকে থাকে ইউরোপের ভাষাগুলোতে, সেটা কোনদিকে ইঙ্গিত করে আপনারা বুঝতেই পারছেন।

বেলুচিস্তানে ব্রাহুই ভাষার উপস্থিতি প্রমাণ করে যে দ্রাবিড়ভাষী ছিল সিন্ধু সভ্যতা। এখানে একটা ডি আই টি বা ডি এম টি চলে আসে। দ্রাবিড়ভাষীরাও নাকি বহিরাগত, এবং এইখান দিয়ে তারা ভারতে প্রবেশ করেছিল। সময়টা তিন হাজার বিসি। এগুলোর কিন্তু কোনও আর্কিওলজিক্যাল প্রমাণ নেই। তাও বেশ, কিন্তু হিসেবে মিলছে না। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে যদি ব্রাহুইরা এখানে থাকত তাহলে ইরানের লাগোয়া এই অঞ্চলে বসবাসের কারণে আভেস্তান ভাষা (প্রাচীন পারসীক ভাষা)র কিছু লোনওয়ার্ড থাকত, সেটা কিন্তু নেই। এইজন্য ব্রাহুইরা এখানে খুব বেশিদিন হল আসেনি, এরকম একটা তত্ত্বই বেশি প্রামাণ্য।
 
পারপোলা হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একবারও রাখালদাসের নাম করেন নি, এ এক আশ্চর্য দক্ষতা বলতে হবে। মানে কাজটা সোজা নয়। মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে আলোচনা করলাম একবারও নিউটনের নাম না করে, সেটা যেরকম কৃতিত্ব আর কি। অতুল সুর নিজেও সিন্ধু সভ্যতার ফিল্ড স্টাডি করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে আসব এক্ষুনি। অতুল শূরের প্রাণসংশয় দেখা দিয়েছিল, অতুল বলছেন ননীগোপাল মজুমদার, যিনি ঐ অঞ্চলেই কর্মরত পুরাতাত্ত্বিক ছিলেন, তাঁকে সতর্ক করেন যে অতুলকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে একটা বাঙালিবিদ্বেষী গোষ্ঠী। সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা বইতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন অতুল। কিন্তু যা বলছিলাম, রাখালদাসই যদি উল্লেখের যোগ্য না হন, তাহলে আর অতুল সুর তো ধর্তব্যই নন। এদিকে মজার ব্যাপার হচ্ছে অতুল সেযুগেই কিন্তু আস্কো পারপোলার নাম উল্লেখ করছেন, পারপোলা তখন নেহাতই ছোকরা হবেন, সেটা থেকে বোঝা যায় অতুল কিভাবে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে হওয়া সিন্ধু সভ্যতা গবেষণার সাম্প্রতিকতম বিষয়েরও খবর রাখতেন। যাই হোক, পারপোলার এই রাখালদাসকে অগ্রাহ্য করাটা হল পশ্চিমের অ্যাকাডেমিক সাম্রাজ্যবাদ। বাঙালির অ্যাকাডেমিয়ায় সর্বত্র বিশ্বমানবদের দাপট না হলে এ জিনিস এত সহজে চলতে পারত না।
 
প্রসঙ্গে ফিরি।

অতুল সুর সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বাঙালির কিছু কানেকশন দেখিয়েছেন, আমরা জানি। সবথেকে বড় মিল নিঃসন্দেহে শিব শক্তির উপাসনা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় পোড়ামাটির ইঁটের ব্যবহার ছিল ব্যাপক এবং সীলগুলোতে বারবার মাছের ছবি দেখতে পাবেন। আমি পারপোলার বইতে সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত সঙ্কেতের একটা তালিকা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে সমস্ত চিহ্নের মধ্যে সবথেকে বেশি দেখছি মাছ। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার লিপি ছিল ক্রিপ্টিক বা গোপন-সাঙ্কেতিক, এই সভ্যতা গুহ্য জ্ঞানকে গোপনে সংরক্ষণ করায় বিশ্বাসী ছিল, ঐ চিহ্নগুলি স্টাডি করে পারপোলা সহ আরও অনেকে বলছেন। তন্ত্রের উৎস সেক্ষেত্রে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায় ছিল, এই মতও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অতুল সুর জানাচ্ছেন যে তন্ত্রের চিহ্নসমূহের সঙ্গে সিন্ধুলিপির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন স্বামী শঙ্করানন্দ, তবে তাঁর নামটুকু ছাড়া আর কিছু জানান নি অতুল, আমিও খুঁজে পাচ্ছি না এই কাজটা কোথাও।


 
এদিকে পারপোলা অবশ্য এমন সবার ওপরেই খড়্গহস্ত যারা সিন্ধু সভ্যতায় আর্য উপাদান দেখছেন। যেমন এস আর রাও, তার ১৯৮২ সালের ডিসাইফারমেন্ট অভ ইন্ডাস স্ক্রিপ্টে বলেছেন, ভাষাটা কোনও একটা আর্যভাষা, বৈদিক সংস্কৃতের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। একজন পশ্চিমী গবেষক, ব্রায়ান্ট, তিনি সমস্ত এভিডেন্সের তুল্যমূল্য বিচার করে আর্যরা বহিরাগত সেকথা বলতে রাজি হন নি (দুহাজার চার সালে প্রকাশিত তাঁর বই কোয়েস্ট ফর দি অরিজিনস অভ ভেদিক কালচারঃ দি ইন্দো-ইউরোপিয়ান মাইগ্রেশন ডিবেট) বলে পারপোলা যারপরনাই উদ্বিগ্ন।

পন্টিক স্টেপ্স নর্থ অভ ব্ল্যাক সি, হল আর্যদের আদি বাসভূমি, এইখানে পি আই ই (প্রোটো ইন্দো ইউরোপিয়ান) ভাষীরা থাকতেন (পেজ ৩৫)। এই তত্ত্বে কিভাবে পৌঁছলেন পারপোলা? দেখুন, এখানে সেযুগের ইউরোপের সবথেকে বেশি ঘোড়া ছিল। এইটা একমাত্র যুক্তি দেখলাম উনি দিয়েছেন। তার মানেই এখান থেকে বাকি সব জায়গায় আর্যরা গেছিল।
এত সহজে সব প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, যে দেখে আশ্চর্য লাগে, এই পারপোলা ওয়েন্ডি ডনিগারকে উদ্ধৃত করে বলছেন, যে সিন্ধু সভ্যতায় শিবের উপাসনা ছিল এরকম বলার আগে একশো এক রকমের সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে, কারণ মিলটা নাকি নিতান্তই সুপারফিশিয়াল। ওয়েন্ডির অনুসারী পারপোলা এমন সতর্ক শিবের উপাসনা নিয়ে, কিন্তু দেখুন, যেই আর্যজাতির বাসভূমির কথা এলো, সব সতর্কতা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে কিরকম স্রেফ ওখানে ঘোড়া আছে বলেই...
আরও মজার ব্যাপার হল, ওখানে একটা গ্রেভ পাওয়া গেছে, সেখানে মানুষের ঘাড়ে ঘোড়ার মাথা, এইভাবে শায়িত দেহ, সেটার সঙ্গে বৈদিক প্যারালাল স্থাপন করে ফেলেছেন (দধীচির ঘাড়ে ঘোড়ার মাথা স্থাপন করেছিলেন অশ্বিনীকুমাররা)। তখন কিন্তু সুপারফিশিয়াল মিল, সতর্কতা, এগুলো দেখছি না।
 
সবথেকে বড় কথা হল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ভারত থেকে ইরান হয়ে সমগ্র ইউরোপের ভাষা (ফিনো-ইউগ্রিক বাদ দিলে, যেমন হাঙ্গারির ভাষা, এগুলো আলাদা, এরা ইন্দো ইউরোপিয়ান নয়) যদি এক পরিবারের অন্তর্গত হয়, তবে নিশ্চয়ই কিছু প্রাগৈতিহাসিক চলাচল হয়েছে। কিন্তু সেটার প্যাটার্ন কি? ইরান থেকে ভারতে এসেছে, এমনটাই পারপোলার বক্তব্যের ঝোঁক। অথচ উল্টোটারই প্রমাণ। ঋকবেদে কোনও অরিজিনাল হোমল্যান্ডের কথা নেই, কিন্তু আভেস্তায় আছে। ওরা অসুর উপাসক ছিলেন আমরা জানি। নিজেদের আরিয়ান বলতেন, সেই থেকে ইরান। এরা ভারত থেকে গেছিলেন, এই মত ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে।

এবার সঞ্জীব সান্যাল, ইনি এ এম টি/ এ আই টির সমর্থক নন। ল্যান্ড অভ সেভেন রিভারস ওর বিখ্যাত বই, কয়েকদিন আগে দি ওশেন অভ চার্ন বলে আরেকটি বই এসেছে। সঞ্জীব বলেন যে ভারতে ঘোড়া ছিল, বাইরে থেকে আসেনি, তার স্বপক্ষে প্রমাণও দিচ্ছেন। এছাড়া কতগুলো জেনেটিক স্টাডির কথা বলেছেন। সেগুলো চমকে দেওয়ার মত।
১।ভারতে গত দশ হাজার বছরে কোনও নতুন জেনেটিক স্টক আসেনি। দ্রষ্টব্য ল্যান্ড অভ সেভেন রিভার্সের প্রথম চ্যাপ্টার, অভ জেনেটিকস অ্যান্ড টেকটনিকস।

২। এছাড়া ল্যান্ড অভ সেভেন রিভার্স বইতে বলছেন যে R1a1 (আর ওয়ান এ ওয়ান) নামক একটি জেনেটিক হ্যাপলয়েড গ্রুপ, সেটার উৎস ছিল সম্ভবত আজকের গুজরাটে সেদিনের সরস্বতীর মোহনা অঞ্চল। এদিকে অতুল সুর বলছেন যে লোথাল অঞ্চলে ছিল সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার বন্দর নগরী, সেখানে সবথেকে বেশি মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে। বস্তুত, সঞ্জীব সান্যাল আর অতুল সুর পাশাপাশি পড়তে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হল একটা জিগস পাজলের মিলে যাওয়াটা স্বচক্ষে দেখার।
 
ওই R1a1 জিন বাঙালি আর কোঙ্কনি ব্রাহ্মণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সেটা পূর্ব ইউরোপের স্লাভদের মধ্যেও দেখা যায়। কোঙ্কন উপকূলের সারস্বত ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালির রক্তের সম্পর্কের কথা বলছেন সঞ্জীব।

৩। ঋগবেদের সভ্যতা আর সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা, দুটো একই সময়ে ফ্লারিশ করেছিল, এবং দুটো দুরকমের সভ্যতা, এবং দুটোই সম্ভবত আর্যভাষী ছিল। সরস্বতী, আজকের ঘাগ্‌গর নদী, শুকিয়ে গেছিল বলে এ দুটো সভ্যতাই সঙ্কটে পড়ে।

৪। ভারতে দুটো ডমিন্যান্ট জিন ককটেল আছে। এ এন আই, এ এস আই। এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান এবং এনসেস্ট্রাল সাউথ ইন্ডিয়ান। এ এন আই ভারতের বাইরেও পাওয়া যায়, ইউরোপে এবং এশিয়ায়, কিন্তু এ এস আই ভারতের বাইরে কোথাও মেলে না। যদি সিন্ধু সভ্যতা দ্রাবিড়ভাষী হত, যদি দ্রাবিড়রা আদিতে বহিরাগত হতেন, যদি এরা ওই অঞ্চলের বাসিন্দা হতেন যাদের সঙ্গে নিয়মিত মেসোপটেমিয়ার যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণিত (মেলুহা বলা হত), সেক্ষেত্রে এ এস আই ভারতের বাইরে অবশ্যই পাওয়া যেত। সঞ্জীব সান্যালের অনুমান, এ এস আই জিন ককটেল প্রথম থেকেই দক্ষিণ ভারতেই আছে।

এখানে আর ওয়ান বলে একটা জিনের কথা বলছেন, যেটা ভারত থেকে ইরান, এই অংশটার মধ্যে বসবাসকারী পপুলেশনের তৈরি হয়েছিল। শেষ আইস এজের আগে। মোটামুটি পঁচিশ হাজার বছর আগে এটা দুটো অংশে ভেঙে যাচ্ছে, আর ওয়ান এ, এবং আর ওয়ান বি। এই বি অংশটি পশ্চিম ইউরোপের দিকে চলে যায়, আর আজকে এ এন আই তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ R1a জিন।
 
২০০৩ সালের একটি স্টাডিতে বলা হয়েছে যে ভারত ছিল আফ্রিকা থেকে নির্গত আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সের আদি জেনেটিক ডিফারেন্সিয়েশনের ধাত্রীভূমি (ইনকিউবেটর অভ আর্লি জেনেটিক ডিফারেন্সিয়েশন অভ মডার্ন হিউম্যানস মুভিং আউট অভ অ্যাফ্রিকা”)। প্রবন্ধটি এই লিঙ্কে পড়া যাবে।http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC379225/

জেনেটিক স্টাডির কথা যখন হচ্ছে, তখন শ্রীলঙ্কার লোকেদের সঙ্গে বাঙালির জেনেটিক সাদৃশ্য নিয়ে যে স্টাডি হয়েছে, আমরা অনেকেই জানি, বাঙালির প্রাচীন সমুদ্রযাত্রার উদাহরণ সেগুলো। সেখানে সঞ্জীব বিজয়সিংহকে আধা উড়িয়া বানিয়ে ছেড়েছেন। বাঙালি হিসেব আমাদের অবশ্য অনেকগুলো অভিযোগ করার আছে। মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তকে নিয়ে এক লাইনও নেই, অথচ রক্তমৃত্তিকার বাসিন্দা এই বুদ্ধগুপ্ত বাংলার সমুদ্রযাত্রার ইতিহাসে, ভারত মহাসাগরের ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চম শতকের লোক ছিলেন। উড়িষ্যার প্রচারে সঞ্জীব অত্যন্ত প্রভাবিত, তাই বাঙালির সমুদ্রযাত্রার উল্লেখ এলেও সেটা সর্বদাই উড়িষ্যার সঙ্গে হাইফেনেটেড। শেষে সেই হাইফেনও উঠে গেছে, শুধুই কলিঙ্গ। কলিঙ্গর সমুদ্রযাত্রা মোটামুটি সপ্তম শতক থেকেই বন্ধ, এই বলে উনি কলিঙ্গের পাট বন্ধ করেছেন ওশেন অভ চার্ন বইতে। কেন বলুন তো? এই সময়েই তাম্রলিপ্ত বন্দরটি উঠে যায়। যেমন রামাকান্ত দই খেলে গোবর্ধনের বিকার হয়, যেমন লঙ্কায় রাবণ মো'লে বেউলা কেঁদে বেধবা হন, তেমন বাঙালি সমুদ্রযাত্রা বন্ধ করে দিলে কলিঙ্গেরও সমুদ্রযাত্রা লাটে ওঠে দেখা যাচ্ছে। ভানু ব্যানার্জি অভিনীত সেই পার্সনাল অ্যাসিস্টেন্ট ছবির পিয়ানোবাদনের দৃশ্য মনে পড়ে যাচ্ছে।


 
আজকের যুগে একজন এইভাবে লিখতে পারেন, সো অবলিভিয়াস অভ গ্রাউন্ড রিয়েলিটি অভ উড়ে থেফট অফ বেঙ্গলি লেগেসিস, সেটা আশ্চর্য লাগে, কিন্তু বাঙালি আফটার অল বিশ্বমানব, কাজেই সে অস্বস্তিকর প্রসঙ্গসমূহ সবসময় ভুলে থাকতে চায়। তবে এক জায়গায় চন্দ্রকেতুগড়ের উল্লেখ করছেন, তাম্রলিপ্তের উল্লেখ করছেন, তাতে কলকাতা ও দক্ষিণবঙ্গের যে প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, সেটা ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালি মনে করবে, সেজন্য, সেটুকু সাহায্যের জন্য সঞ্জীবকে ধন্যবাদ।

আপনারা জানেন, তিন চার দিন আগে একটা রিপোর্ট এসেছে টাইমস অভ ইন্ডিয়ায়, সেখানে একদল আর্কিওলজিস্টের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকায় উল্লিখিত সান্ড্রোকট্টাস আসলে চন্দ্রকেতু, আমাদের চন্দ্রকেতুগড়ের চন্দ্রকেতু। আমি বিষয়টা কতটা সত্যি জানি না, কিন্তু যারা দাবি করেছেন, তারা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে এবং আই আই টির লোক।
 
এবার সরাসরি বাঙালির শেকড়ের প্রসঙ্গে আসব।
 
তাম্রযুগের সভ্যতা মিলেছে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে, এছাড়াও বীরভূমের মহিষদলে। ক্রীট দ্বীপের সঙ্গে পাণ্ডু রাজার ঢিবি অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা বাণিজ্য চালু ছিল, ক্রীটের সীলমোহর পাওয়া গেছে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে। এই পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা কোনও অংশে হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োর থেকে পিছিয়ে ছিল না। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, রাজপথ সবই ছিল।
 
১৯৭৮ সালে মেদিনীপুরের রামগড়ের অদূরে কংসাবতীর বামতটে সিজুয়া মামক স্থানে মানবকঙ্কালের অংশবিশেষের ফসিল পাওয়া গেছে, যা এশিয়ায় তখনও পর্যন্ত (সত্তরের দশকের শেষদিক) প্রাপ্ত হোমো স্যাপিয়েন্স মানবফসিলের মধ্যে প্রাচীনতম, অতুল সুর বলছেন তাঁর বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন বইতে। এছাড়াও জানাচ্ছেন যে বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্লাইস্টোসিন যুগের মানববসতির প্রমাণ (এই প্লাইস্টোসিন যুগেই প্রথম মানুষ আসে পৃথিবীতে) এবং পুরাতন প্রস্তরযুগের আয়ুধ পাওয়া গেছে।

২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পূর্ব ভারত থেকে, আরও স্পষ্ট করে বললে বাংলা থেকে, বাংলার বন্দর থেকে অস্ট্রেলিয়াতে ডিঙায় চেপে (এই শব্দ ডিঙা, এটি অস্ট্রিক) গেছিল একদল মানুষ, জেনেটিক স্টাডি উল্লেখ করে জানাচ্ছেন সঞ্জীব সান্যাল (যদিও অস্ট্র্বেলিয়ায় প্রথম হোমো স্যাপিয়েন্স পৌঁছেছিল বহুযুগ আগে, ৪৫০০০ বছর আগে, কিন্তু দুহাজার বছর আগে একটা সাইজেবল জিন পুল সেখানে পৌঁছয়, সেটা আমাদের এখান থেকেই গেছিল বলে প্রমাণ করা যায়)। এবং ডিঙ্গো নামে যে কুকুর ওখানে পাওয়া যায়, সেটা আমাদের বাঙালিদের নেড়ি কুত্তা বা প্যারিয়া ডগের বংশধর, সে সম্বন্ধে জীববিজ্ঞানীরা একমত। কুকুরকে যে আজও বাঙালি চু-চু বলে ডাকে, সেটা আসলে অস্ট্রিক ভাষায় কুকুরের প্রতিশব্দ, নীহাররঞ্জন জানিয়েছিলেন বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে। আজ পর্যন্ত আমরা একটু চেষ্টা করেছি, সেযুগের যে বাঙালিরা চলে গেছিলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের জেনেটিক সাদৃশ্য নিয়ে কোনও স্টাডি করার? বাঙালির শরীরে সবথেকে প্রবল অস্ট্রিক রক্ত, এবং অ্যালপাইন রক্ত। এ দুটিকে খুঁজে যেতে হবে বারবার আমাদের, বাঙালির জেনেটিক স্টাডি, এবং বাঙালির সঙ্গে অন্যান্যদের সম্ভাব্য যোগাযোগগুলো খুঁজতে হবে। তাতে আমাদের শেকড় কিভাবে ছড়িয়েছে, কোথায় আমাদের কে আত্মীয় রয়েছেন, জানা যাবে। কে বলতে পারে, এই আমারই কোনও কৃষ্ণবর্ণ পূর্বপুরুষই সেই ডিঙার মাস্তুল সামলেছেন কি না, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময়, দুহাজার বছর আগে? এ বড় কম গর্বের কথা নয়।

                                                          (৩)

এবার একটা অন্য কথা বলব। তাঁদের অনুসরণের ডাক বারবার দিচ্ছি বটে, কিন্তু বঙ্কিম ও হরপ্রসাদের ভিক্টোরিয়ান সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধেও সচেতন থাকতে হবে।
 
যেমন হরপ্রসাদের মত চিন্তাবিদ একজায়গায় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে এরকম নঞর্থক কথা বলছেনঃ এক একবার মনে হয় তিন চারি শত বৎসর ধরিয়া বৌদ্ধেরা ইন্দ্রিয়াসক্ত, কুকর্মান্বিত ও ভূতপ্রেতের উপাসক হইয়া যে নিজেও অধঃপাতে গিয়াছিল এবং দেশটাকে সুদ্ধ অধঃপাতে দিয়াছিল, মুসলমানদের আক্রমণ তাহারই প্রায়শ্চিত্ত। তাহাদের সেই ঘৃণিত উপাসনা, বিষ্ঠামূত্র ভক্ষণ করে সিদ্ধিলাভের চেষ্টা, ভূতপ্রেত পূজা করিয়া বুজরুক হইবার চেষ্টা এবং উৎকট ইন্দ্রিয়াসক্তিকেই ধর্ম মনে করা ও তাহাই শিখানো - এই সকলের পরিণামে তাহাদিগকে বঙ্গ দেশ চিরকালের জন্য ছাড়িতে হইল।” (হরপ্রসাদ রচনাসংগ্রহ তৃতীয় খণ্ডঃ পৃষ্ঠা ৩৮১-২)।

তাও কিন্তু নিরন্তর স্টাডি করতে হবে সেই অতীতকে, সে বিষয়ে বঙ্কিম বা হরপ্রসাদের কোনও সন্দেহ ছিল না। বঙ্কিম বলছেন তন্ত্র সম্পর্কে ওর একটা ইংরেজি প্রবন্ধে, যেটা ক্যালকাটা রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছিল, লেট ইট পেরিশ বাট লেট ইট নট পেরিশ আনস্টাডিড।

বাঙালিচর্চায় ছুঁতমার্গ চলবে না, সেটা বঙ্কিম আর হরপ্রসাদ দুজনেরই বলিষ্ঠ উচ্চারণ। হরপ্রসাদ আরেক স্থানে বলছেনঃ
"বাঙালিয়ানা, বাঙালিত্ব, আমি বাঙালি এই বোধ। আমার বাঙালি বলিয়া যে একটা সত্তা আছে, এই জ্ঞান। ...
বাঙালিয়ানার অর্থ এই যে, বাংলার যা ভালো তাহা ভালো বলিয়া জানা, আর যাহা মন্দ তাহা মন্দ বলিয়া জানা। ভালো লওয়া ও মন্দ না লওয়া তোমার নিজের কাজ। কিন্তু জানাটা প্রত্যেক বাঙালির দরকারি কাজ। জানিতে হইলে বুদ্ধিপূর্বক বাংলা দেশটা কী দেখিতে হইবে, বাংলায় কে থাকে দেখিতে হইবে, বাংলার আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি, সমাজ-সংসার, উৎসব-আনন্দ, দুঃখ-শোক, কুস্তি লাঠিখেলা টোল পাঠশালা দেখিতে হইবে। ইহার গান গীতি পয়ার পাঁচালী, নাচ খেমটা, কীর্তন ঢপ যাত্রা কবি সব দেখিতে হইবে। মন প্রাণ দিয়া দেখিতে হইবে। আবার এখনকার কালে যাহা যাহা বদলাইতেছে, তাহাও দেখিতে হইবে। খবরের কাগজ, মাসিক পত্র, কনসার্ট, থিয়েটার, ইস্কুল, কলেজ, আপিস, আদালত সবই দেখিতে হইবে। বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা ভালো করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই তুমি বাঙালি হইবে।" (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, ২য় খণ্ড)

কিন্তু ১৩০৯ বঙ্গাব্দে হরপ্রসাদের মেঘদূত ব্যাখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরে এমন অশ্লীলতার অভিযোগ উঠল (তখন হরপ্রসাদ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ), যে উনি সাহিত্য পরিষৎ ছেড়ে দেন, বাংলায় লেখালেখি বন্ধ করেন। এর অনেক পরে চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে নারায়ণ পত্রিকায় ১৩২১ থেকে ১৩২৪ বঙ্গাব্দের মধ্যে একটা সিরিজ লেখেন বৌদ্ধধর্মের ওপরে। মোট ষোলোটা প্রবন্ধ। চিত্তরঞ্জনের প্রতি এজন্য বাঙালি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। আরেকবার চিত্তরঞ্জন বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন যখন রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম প্রবন্ধের কড়া সমালোচনা করেন তিনি নারায়ণ পত্রিকায়, কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

নীহাররঞ্জন রায় একবার বলেন, “তথ্যের ভুল পাবে শাস্ত্রীমশাইয়ের লেখায় কিন্তু দৃষ্টিতে কোনও ভুল ছিল না। বাঙালি জাতির পরিচয় ওঁর মত আর কেউ ঠিকভাবে ধরতে পারেনি।” (হরপ্রসাদ রচনাসংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫)। এখন, হরপ্রসাদে তথ্যের ভুল ছিল, কথাটা রচনাসংগ্রহেও এদিক ওদিক পাওয়া যাচ্ছে। হরপ্রসাদ একবার এর উত্তরও দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যখন তার লেখায় দেখতে পাচ্ছি কিছু অত্যুৎসাহী যুব গবেষকের অভিযোগের উত্তর। অভিযোগ, হরপ্রসাদের তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ হরপ্রসাদ বিবলিওগ্রাফি দেন না। হরপ্রসাদ বলছেন, আমি কি বাপু তোমার মত পঁচিশটা মাত্র ছাপা বই পড়ে গবেষণায় নেমেছি? আমার পড়া সহস্র সহস্র পুঁথি, তার বেশিরভাগই এখনও মুদ্রিত হয়নি। এত বই পড়েছি, সবগুলোর নাম-ধাম-লেখক মনে করে রাখা কি সম্ভব?

সত্যি বলতে গেলে কি, হরপ্রসাদের সমালোচনা করার অধিকার কার আছে? হরপ্রসাদের সমান পরিশ্রম করে বাঙালির শেকড় পুনরুদ্ধারের কাজ আর কে করেছেন

এখানে বৌদ্ধতন্ত্রযানের দুজন মহাগুরু নাড়োপা এবং নিগু (হরপ্রসাদ এদের নাড়া ও নাড়ী বলে উল্লেখ করেছেন, এদের শিষ্যদেরই নেড়ানেড়ী বলা হত, এরকম মত পোষণ করেছেন) সম্পর্কে হরপ্রসাদ যে লিখে গেছেন যে এরা স্বামী স্ত্রী ছিলেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ তুলেছেন হরপ্রসাদের রচনাসংগ্রহের টীকাকার। কারণ ওই, বিবলিওগ্রাফি নেই। নিজে সেই খুঁজে দেখলে অবশ্য হত, কিন্তু সেটা টীকা-টিপ্পনী আঁটার থেকে তুলনায় বেশি পরিশ্রমসাধ্য। মজার ব্যাপার হল, আজ এই গুগলের যুগে, সার্চ করলেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, নিগু-মা বা নিগু ডাকিনী (ডাকিনী ছিল মহা সম্মানের উপাধি, বজ্রযানের মহিলা তাত্ত্বিকদের ও আচার্য-পণ্ডিতদের ডাকিনী বলা হত) ছিলেন নাড়োপার স্ত্রী। এই নাড়োপা ছিলেন অতীশ দীপঙ্করের গুরুর গুরু। নাড়োপার ও নিগুমার (নাড়া-নাড়ী) উল্লেখ হরপ্রসাদ তাঁর প্রবন্ধে শুধু নয়, বেনের মেয়ে উপন্যাসেও করেছেন।

বঙ্কিম থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এই ট্র্যাজেক্টরি থেকে আরেকটা টেমপ্লেট পাওয়া যায়। বঙ্কিম ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, কিন্তু হরপ্রসাদ সর্বক্ষণের বঙ্গচর্চাবিদ। আমাদের আন্দোলনের লক্ষ্য এরকমই রাখতে হবে, আজ যারা কাজ করছি, আমরা চাকরি করি বিভিন্ন ফিল্ডে, কিন্তু আগামী দিনে এই আন্দোলনে বৌদ্ধিক হোলটাইমার চাই।
এবার আমি চর্যাপদের টাইম ফ্রেম নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করব।

প্রথমে চর্যা প্রকাশের ব্যাকগ্রাউন্ড। শরৎচন্দ্র দাস ১৮৭৯ সালে পিকিং এর ফরবিডেন টেম্পল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের চিত্র প্রতীক নিয়ে আসেন, সেই প্রথম কোনও আধুনিক যুগের বাঙালি আমাদের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি নিয়ে অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন। এর আগেই অবিশ্য রাজেন্দ্রলাল মিত্র এশিয়াটিক সোসাইটির তরফ থেকে স্যানস্ক্রিট বুদ্ধিস্ট টেক্সটস অভ নেপাল নাম দিয়ে হজসন সংগৃহীত নেপালী পুঁথিগুলো প্রকাশ করেন।
 
হরপ্রসাদ মোট চারবার নেপাল যান। ১৯০৭ সালে, তৃতীয় নেপাল অভিযান ছিল সেটা, চর্যাচর্য বিনিশ্চয় গ্রন্থটি পান এবং নেপালের দরবার গ্রন্থাগার থেকে কপি করিয়ে নিয়ে আসেন। সরহবজ্রের সটীক দোহাকোষ, মেখলাটীকাসহ কাহ্নপাদের দোহাকোষ এবং বৌদ্ধতন্ত্রের পুঁথি ডাকার্ণবের সঙ্গে এটি একত্রে প্রকাশিত হয় হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা শিরোনামে, ১৯১৬ সালে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে। এবছর চর্যা প্রকাশের শতবর্ষ।

চর্যাচর্য বিনিশ্চয় গ্রন্থে চর্যার টীকাও অন্তর্গত। আসলে টীকাই মুখ্য, গানগুলির টেক্সট দেওয়া হয়েছে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই, এবং গ্রন্থটি আসলে চর্যাগীতিকোষবৃত্ত/চর্যাগীতিকোষটীকা নামেই পরিচিত ছিল, এরকম একটা তত্ত্ব পরবর্তীকালে জোরালো হয়েছে, কারণ চর্যাচর্যবিনিশ্চয় টাইটল হরপ্রসাদের সংগৃহীত টেক্সটে কোথাও পাওয়া যায় না। সংস্কৃতে লেখা চর্যাগীতির এই টীকার নাম নির্মলগিরা টীকা, রচনাকার মুনিদত্ত। বৌদ্ধপণ্ডিত শান্তি ভিক্ষু শাস্ত্রী চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের অর্থ করছেন, viniscaya that is determination, of carya, that is to be practised, and acarya, that is not to be practised. 

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের সময়কাল ধরেছেন দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগ। লুইপাদ (আনুমানিক ৯৫০ খ্রীষ্টাব্দ) হলেন আদিতম চর্যাকার, এবং কাহ্নপাদ হলেন শেষতম।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন অষ্টম থেকে একাদশ শতক দিচ্ছেন চর্যাপদের রচনার সময়কাল হিসেবে। তাঁর মতে লুই আদি নন, সরহপাদ আদি। আনুমানিক ৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে সরহপাদ মারা যান।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলছেন যে ৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ হল চর্যার সূচনাকাল। চর্যাকারদের মধ্যে শবরপাদ হচ্ছেন অষ্টম শতকের লোক, তারও আগে কম্বলাম্বরপাদ হলেন সপ্তম শতকের। তারও আগে মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথের একটা বাংলা চর্যা পাওয়া যায়, এবং এই মীননাথ ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে তিব্বতে চলে গেছিলেন। সেটা কিন্তু মাৎস্যন্যায়ের সময়। গুহ্য সহজসাধনার সূচনা ও ব্যাপ্তি এইসময় হওয়া খুবই স্বাভাবিক কারণ প্রকাশ্য উপাসনার পক্ষে সেই অরাজক সময় অনুকূল ছিল না।

বাঙালির শেকড় অক্ষয় বটের মত, কত গভীরে গেছে, আমরা সত্যিই আজও জানি না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায়, যিনি আজ পর্যন্ত বাংলায় সঙ্ঘ পরিবারের সেরা ইন্টেলেকচুয়াল মুখ হিসেবেই পরিচিত, তিনি কয়েক মাস আগে টুইট করে বললেন, বাঙালির তো কোনও ইতিহাস নেই, মেরেকেটে দশম শতাব্দী, তার আগে আর কি ছিল। সেই তুলনায় ওডিশার ইতিহাস কত প্রাচীন। উড়েদের তেল দিলেন আর কি। এবং সেটা রসগোল্লা নিয়ে বিতর্ক চলছে, সেই কনটেক্সটেই। সেই সময়ে দেওয়া আমার একটা ফেসবুক স্টেটাস থেকে উদ্ধৃত করছি।
৮ জুন ২০১৬ তারিখে দেওয়া।

ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় দেখি লিখেছেন, বাঙালির যা কিছু ইতিহাস সব দশম শতাব্দীর পরে, তার আগে কিচ্ছু নেই, সে হিসেবে ওডিয়ারা (হ্যাঁ, উড়েদের আজকাল ওডিয়া বলতে হয়) তো অত্যন্ত এনশিয়েন্ট। রসগোল্লার ওপরে উড়েদের দাবীও ইনি মেনেই নিয়েছেন, মানে সেই দাবীতে আরও বাতাস করে এসেছেন।
বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, বঙ্কিম বলে গেছেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পড়ছিলাম, আবার।
হরপ্রসাদ বলছেন, ১৮৫০ এর দশকে স্কুল-শিক্ষার প্রসারের সময়ে বিদ্যাসাগরের লেখা পড়ে বড় হওয়া বাঙালির ধারণা জন্মেছিল, বিদ্যাসাগরই বাংলা ভাষার জন্মদাতা, তার আগে কিছু ছিল না। তারপরে শোনা গেল, না, রামমোহন রায় আর গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যও নাকি বাংলায় অনেক কিছু লিখে গেছেন। এরপরে যখন রামগতি ন্যায়রত্ন একখানা বই লিখলেন বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে, তখন আবার এই ইতিহাস আরও পিছিয়ে কাশীদাস, কৃত্তিবাস আর কবিকঙ্কণে গিয়ে ঠেকলো। এই ইতিহাস সত্ত্বেও, ১৮৮০র দশক পর্যন্ত শিক্ষিত বাঙালির ধারণা ছিল, যে বাংলা একটা নিতান্তই অর্বাচীন ভাষা, বাঙালিই নিতান্তই অল্পবয়েসী একটা জাতি। ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি হরপ্রসাদ বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান নিযুক্ত হন, তখনও এই মনোভাবের বশবর্তী। হরপ্রসাদ সেখানে গিয়ে বৈষ্ণব কাব্য আবিষ্কার করলেন। উনি বলছেন সেযুগের স্মার্ত আর নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ (মানে মোটামুটি সব শিক্ষিত বাঙালি ব্রাহ্মণ) দের বাড়িতে বৈষ্ণবদের নামও নেওয়া হত না, তারা এমন হাড়ে হাড়ে চটে ছিলেন বৈষ্ণবদের ওপরে, বিশেষ করে চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের ওপরে। ফলে বৈষ্ণব সাহিত্যের কথা হরপ্রসাদ কিছুই জানতেন না, শিক্ষিত বাঙালি প্রায় কেউই জানতেন না। এইবার, ১৮৯১ সালে উনি একটা প্রবন্ধ পড়েন, তাতে ১৫০ জন বৈষ্ণব পদাবলীকারকে নিয়ে আলোচনা করেন। সে সভায় উপস্থিত বাঙালিরা সবাই হতভম্ব হয়ে যান। বাংলায় এত বই আছে দেখে সকলেই আশ্চর্য।
এইবার হরপ্রসাদ পুরোনো পুঁথি সংগ্রহের অভিযানে নামলেন। প্রথমে আবিষ্কার করলেন ধর্মমঙ্গল। সেই প্রথম শিক্ষিত বাঙালি জানল, মঙ্গলকাব্যের বিপুল ঐতিহ্যের কথা। এর পরে যান নেপালে, বারবার যান। ফলে অবশেষে চর্যাপদ প্রকাশিত হল, ১৯১৬ সালে।
দাঁড়ান, এখানেই কিন্তু শেষ হয় না।
হরপ্রসাদ বারবার বলছেন, দীনেশ সেনও তার বৃহৎ বঙ্গে বলেছেন, বাঙালি দেশান্তরে যাক, খুঁজে দেখুক নেপাল, তিব্বত, ভুটান, ব্রহ্মদেশ, সিংহল, শ্যাম, সুমাত্রা, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশের প্রত্যন্ত লাইব্রেরিতে, বাঙালির অনেক ইতিহাস সেখানে লুক্কায়িত থাকতে পারে, সেখান থেকে অনেক কিছু জানা যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। হরপ্রসাদের বয়েস হয়ে গেছিল, ওঁর সন্ধান চর্যাপদে শেষ হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব ছিল, সে অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
করা যায়নি। ১৯৩০ এর দশক থেকেই বাঙালির শেকড়ের সন্ধান চালানো তো ছেড়েই দিন, এমনকি বিশ্বমানবতা আর বিশ্ববিপ্লবীয়ানায় বাধা দেওয়ার তেমন শক্তিশালী ইন্টেলেকচুয়ালও আর কেউ ছিলেন না। গোদের ওপরে বিষফোঁড়া আর নৈবদ্যের ওপরে গুজিয়ার মত বিশ্বহিন্দুত্ব তো এসে গেলই।
আর তাই চর্যা প্রকাশের এই একশো বছর পূর্তির বছরে, ২০১৬ সালে ভারতের একমাত্র বাঙালি রাজ্যপাল বলে দিলেন বাঙালির কোনও ইতিহাস নেই, ওই মেরেকেটে হাজার বছর। দেখলাম তথাগত আরও বলেছেন, বাঙালির যা কিছু, সবই ওই ইংরেজের বদান্যতায়। ইংরেজ আসার আগে বাঙালি আর কিছু করতে পেরেছে? ইংরেজরা হুগলীর বদলে মহানদীতে নৌকো ভেড়ালেই অন্যরকম হত। 

টেক্সটাইলের সে যুগে অনন্য গুরুত্বের ব্যাপারটা সঞ্জীব সান্যাল ওর বইতে উল্লেখ করেছেন। সুতানুটিতে কেন এল ইংরেজ বণিক, তার প্রধান কারণ ছিল এই সেযুগে পুরো ভারত মহাসাগরের সার্কিটে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পণ্য ছিল টেক্সটাইল। কাজেই ইংরেজরা হুগলির বদলে মহানদীতে নৌকো ভেড়াতো না, ইংরেজরা সুস্পষ্ট কারণেই এসেছিল এখানে। বাংলা ছিল তাঁতশিল্প, বয়নশিল্পের মহাকেন্দ্র, সুতানুটি নামটাই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। শেঠ বসাকদের সুতানুটির কর্মশালায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, সেটা ইংরেজের আসার অনেক আগে ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দের কথা। সে প্রসঙ্গে জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজ পত্রিকার কলকাতা সংখ্যা (ভলিউম ৩ নাম্বার ২)-র সম্পাদকীয় দ্রষ্টব্য। বাণিজ্যনগরী সপ্তগ্রামের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কলকাতার আত্মপ্রকাশ ঘটছিলই, ইংরেজ এসে হামলে না পড়লেও সেটা কালের নিয়মে ঘটতই।

                                                       (৪)

বাঙালির শেকড়ে কপিল এবং তাঁর সাংখ্য দর্শন।
 
গীতার দশম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, আদিত্যদের মধ্যে আমি বিষ্ণু, সমস্ত আলোর মধ্যে আমি সূর্য, রুদ্রদের মধ্যে শিব, পর্বতের মধ্যে আমি মেরু, সেনাপতিদের মধ্যে আমি স্কন্দ, সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল।

দীনেশ সেন অনুমান করেন যে কপিল নদীবিজ্ঞান জানতেন, খনার বচনে ভগার খাতের উল্লেখ সেই সাক্ষ্য দেয়। অর্থাৎ এটি প্রাচীন যুগের ইরিগেশনের উদাহরণ, দীনেশ মনে করছেন। এখন, ভাগিরথী নামে গঙ্গাকে ভারতে আর কেউ ডাকে না কিন্তু। এবং এই গঙ্গার বর্তমান খাত বাঙালির লাইফলাইন। স্মরণ করুন ঈশ্বর গুপ্তকে নিয়ে লেখায় বঙ্কিমের সেই উচ্চারণ, তিনি বাঙালির প্রাণের আরাম খুঁজে পেয়েছিলেন গঙ্গাবক্ষে এক মাঝির এই গানে সাধো আছে মা মনে, দুর্গা বলে প্রাণ ত্যজিব জাহ্নবী জীবনে

সগররাজার ষাট হাজার ছেলেকে ভস্ম করার ঘটনা আগুনের সুদক্ষ ব্যবহারের দিকে ইঙ্গিত করে। আগুন মানুষের আদি আবিষ্কার, প্রথমতম বিজ্ঞানের একটি। তবে আর্কিমিডিসের মত আতস কাঁচ ব্যবহার করে আগুন জ্বালানোর কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি না, সে আলোচনায় যাওয়ার অর্থ নেই যতদিন না অন্তত সেযুগের (খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ সাল) বাঙালির তৈরি কাচ আমাদের হাতে এসে পৌঁছচ্ছে। তবে খ্রীষ্টপূর্ব ৩৫০০ সাল থেকেই কাঁচ প্রস্তুত করার টেকনোলজি জানা ছিল মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ সুমেরুর বাসিন্দাদের।

সারা ভারতে কপিলের স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য স্থান আছে, সেগুলি লোকস্মৃতিতে ও গণমানসে সাংখ্যকার কপিলের জনপ্রিয়তার সাক্ষী। পঞ্চপাণ্ডবের যেমন অসংখ্য মিথবিজড়িত স্থান আছে, যেমন ধর্মতলায় লেনিন সরণী আছে, সেরকম কপিলের নামে কপিলবস্তু/কপিলবাস্তু নগরীও প্রমাণ দেয়, কপিল কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সমগ্র উপমহাদেশে। কিন্তু তাঁর জন্মস্থান খুলনায় ছিল এই মতটাই সবথেকে বেশি বিখ্যাত।
 
বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি সমস্ত অবৈদিক ধর্মই সাংখ্য উদ্ভূত। বুদ্ধদেবের দুই গুরু অড়ার কলাম ও উদ্রক, দুজনেই সাংখ্য অনুসারী ছিলেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর বৌদ্ধধর্মঃ কোথা হইতে আসিলপ্রবন্ধে বলছেনঃ
সাংখ্যমত কি বৈদিক আর্যগণের মত? শঙ্করাচার্য তো উহাকে বৌদ্ধাদি মতের ব্যয় অবৈদিক বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তবে তিনি এত যত্ন করিয়া ও মত খণ্ডন করেন কেন? মন্বাদিভিঃ কৈশ্চিৎ শিষ্টেঃ পরিগৃহীতত্ত্বাৎ। মনু প্রভৃতি কয়েকজন শিষ্ট উহাকে গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া। সাংখ্যমত কপিলের মত চিরকাল প্রবাদ। কপিলের বাড়ি পূর্বদেশে, অর্থাৎ বঙ্গ বগধ চেরদিগের দেশে। গঙ্গাসাগর যাইতে কপিল আশ্রম আছে, কবতক্ষের ধারে কপিল মুনির গ্রাম। কপিলবাস্তুও কপিল মুনির বাস্তু।
কপিলকে কেহ ঋষি বলে না। তাঁহার নাম করিতে গেলেই বলে আদিবিদ্দ্বান্‌। বাল্মিকী যেমন আদিকবি, তিনিও তেমনি আদিবিদ্দ্বান্‌। 'শ্বেতাশ্বতরে' তাঁহাকে পরমর্ষি বলা হইয়াছে। কিন্তু ভাব ভাষা ও মত দেখিলে এখানিকে নিতান্ত অল্পদিনের পুস্তক বলিয়া বোধ হয়।
কৌটিল্য তিনটি মাত্র দর্শনের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। কৌটিল্য ২৩০০ বৎসর পূর্বের লোক। তাঁহার সময় অন্য দর্শন হয়ই নাই, হইলে তাঁহার মত সার্বভৌম পণ্ডিতের তাহা অবিদিত থাকিত না।
সাংখ্য ও যোগের যে সকল পুস্তক আছে সকলগুলিই নূতন। ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকাই তাহাদের মধ্যে পুরানো। ঈশ্বরকৃষ্ণ খৃস্টীয় পাঁচ শতের লোক। কিন্তু তাঁহার পূর্বেও সাংখ্যমতের পুস্তক ছিল। মাঠর ভাষ্যের কথা অনেক জায়গায় শুনিতে পাওয়া যায়। পঞ্চশিখের দুচারিটি বচন যোগভাষ্যকার ধরিয়াছেন। আসুরির একটি কবিতা একজন জৈন টীকাকার তুলিয়াছেন। মহাভারতে আসুরির নাম নাই, পঞ্চশিখের নাম আছে। কপিলের নিজের কোনও বচন এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। যে ২২টি সূত্র কপিলসূত্র বলিয়া চলিতেছে, তাহাও বিশেষ প্রাচীন নহে, ঈশ্বরকৃষ্ণের কারিকা দেখিয়া লেখা বোধ হয়। কিন্তু অশ্বঘোষের লেখা ও কৌটিল্যের উক্তি দেখিয়া সাংখ্য যে খুব প্রাচীন তাহা বেশ অনুভব হয়।
সংহিতা ও ব্রাহ্মণে আদিবিদ্বান্‌ কপিলের নামও নাই গন্ধও নাই।
সাংখ্যমত সকলের চেয়ে পুরোনো, উহা মানুষের করা, এবং পূর্ব দেশের মানুষের করা। উহা বৈদিক আর্যদের মত নহে। বঙ্গ, বগধ বা চেরজাতির কোনও আদিবিদ্বানের মত।” 

বঙ্কিম যখন বলছেন, সাংখ্যকার বেদের দোহাই দিয়ে বেদের মূলোচ্ছেদ করিয়াছেন, তখন তিনি পরবর্তীকালে হরপ্রসাদের জন্য পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্কিমই প্রথম বলেন যে বাংলার হিন্দুধর্মের উৎস সাংখ্যে। তাই যখন কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রীপূজার বাদ্য শুনি, তখন সাংখ্য মনে পড়ে, বঙ্কিম এই কথা লিখে গিয়েছিলেন। বাঙালির বিস্মৃত শেকড়ের খোঁজে হরপ্রসাদ বঙ্কিম নির্দেশিত পথেই অনুসন্ধান চালিয়েছেন।
 
আজকের আলোচনার শেষ অংশে এসে এবার পৌঁছেছি আমরা।

তাম্রাশ্ম বা চ্যালকোলিথিক সভ্যতার ধাত্রীভূমি ছিল বাঙালির এই পুণ্যভূমি, এই গৌড়বঙ্গ, অতুল সুর বলছেন। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সেই তামা দেশে বিদেশে রপ্তানি হত, তার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি নিয়ে যেত তার ধর্ম, তার শক্তি উপাসনা, মাতৃকাপূজা। সুমেরে শক্তি উপাসনাও বাঙালিই নিয়ে গেছিল, অতুল সুর বলছেন। সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার বিপর্যয় নেমে আসে সরস্বতী নদী শুকিয়ে আসার ফলে, এই ব্যাখ্যাই আজ সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য।
 
এখানে একটা প্রশ্ন তোলা দরকার, আমার আগে সে প্রশ্ন কেউ তোলেন নি। আদি সাংখ্য ছিল প্রকৃতিপ্রধান, সেখান থেকে ধ্রুপদী সাংখ্য এসেছিল, তার মূল বক্তব্য হল প্রকৃতি থেকে পুরুষের উচ্ছিত্তি, বিস্তারিত জানতে আমার প্রবন্ধ সাংখ্য, দস্তুরমত দর্শন করলামপড়তে পারেন সপ্তডিঙা পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়, ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তে প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পূর্ণ প্রবন্ধটাই অনলাইনে পাওয়া যায়। পুরুষ-প্রকৃতির এই বিচ্ছেদকেই জৈনরা কৈবল্য বলেন, একে বৌদ্ধ বলেন মোক্ষ। এই যে প্রবল দুঃখবাদ, এই যে সন্ন্যাসের দিকে প্রবণতা, প্রবজ্যা গ্রহণ করে সংসারত্যাগ, এই উচ্ছিত্তির সংলাপ, এই প্রকৃতির প্রতি বীতরাগ, এই কৈবল্য -এর পেছনে কি একটা চূড়ান্ত সভ্যতার সঙ্কট কাজ করছিল? এই ধারণার উৎপত্তি কি সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়ার ফল? সাংখ্য দর্শনের এই চেহারাটি কি সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার সুপারনোভা, একটি নক্ষত্রের সেই ম্যাজিক্যাল মৃত্যুমুহূর্তকে ধরে রেখেছে?

আরেকটি ইঙ্গিত পাই সাংখ্য থেকে। আমরা বলি যে বাংলায় জাতপাতের সমস্যা নেই। এবং এই গর্ব মিথ্যা নয়। আমি উত্তরভারতের প্রাণকেন্দ্র, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে থাকি। জাতপাতের রাজনীতি কাকে বলে, সেটা আমার স্বচক্ষে দেখা। আর এ শুধু উত্তর ভারত নয়, দক্ষিণে অবস্থা আরও ভয়াবহ শুনেছি।

বাঙালির মধ্যেও সেই বিদ্বেষ, সেই ঘৃণা ছড়ানোর পূর্ণ প্রয়াস হয়েছে, রোহিত ভেমুলার নামে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, মহিষাসুর পুজোর মাধ্যমে, আমাদের শক্তি উপাসনার প্রতীক মা দুর্গাকে বেশ্যা বলে।

বাঙালি কেন এমন সৃষ্টিছাড়া? তথাকথিত নিম্নবর্ণ এখানে কেন তথাকথিত উচ্চবর্ণকে দেখে থুতু দিচ্ছে না ঘৃণায়, আর তথাকথিত উচ্চবর্ণ কেন নিম্নবর্ণকে দেখে ঘৃণায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে না, এই অস্বাভাবিকতা দেখে আমাদের অনেক প্রগতিশীলই জ্বলেপুড়ে যেতে থাকেন নিজেরাই।

হ্যাঁ, চৈতন্য আন্দোলন। হ্যাঁ, বাংলার বৌদ্ধ অতীত। আমাদের মধ্যে জাতপাতকে দুর্বল করার পেছনে এদের ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু আমি আরেকটা দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
 
সাংখ্য।

না, সাংখ্যের প্রকৃতি পুরুষ থেকেই চৈতন্য আন্দোলনের রাধাকৃষ্ণ, বা বৌদ্ধধর্মের সমস্ত দার্শনিক কাঠানো (হীনযান থেকে মহাযান থেকে বজ্রযান থেকে সহজযান) এসেছে, কিন্তু শুধু তাই বলছি না।

সাংখ্য বাঙালির ধর্ম। বাঙালি শুধু একটা জাতি নয়। বাঙালি একটা ধর্ম। এই ধর্ম আমাদের সমস্ত কাস্টগুলোকে এক করেছে। অস্ট্রিক ও অ্যালপাইনকে এক করেছে, দ্রাবিড়ভাষী ও মোঙ্গলয়েডকে এক করেছে। ধর্ম যেমন করে। ইসলাম যেমন আরব থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত একসূত্রে বেঁধে দেয়। ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্ম এক করে দেয় গোয়া থেকে রিও ডি জেনেইরো। বাঙালি এক হয় তার প্রকৃতি পুরুষ দর্শনে। সেখান থেকে উদ্ভূত সমস্ত মুখ্য ও গৌণ উপাসনায়।


 
বাঙালিত্ব একটি ধর্ম। বাঙালি আত্মপরিচয়, তাহলে বলতে পারি, একটা ধর্ম। ব্রাহ্মণ হোক বা বাউড়ি, এখানে সবাই মাতৃকা উপাসক। আজ থেকে নয়, বহুযুগ ধরে, সভ্যতার উষাকাল থেকে আমরা শিবশক্তির উপাসক (সেই শিবশক্তি কখনও রাধাকৃষ্ণ হতে পারেন। বাংলায় এজন্য রাধা ছাড়া কৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করা যায় না)। এই ধর্ম দৃঢ়প্রোথিত, সম্ভবত এজন্য বাংলার ইতিহাসে কাস্ট রায়ট আমরা দেখতে পাই না, কাস্টিস্ট ভায়োলেন্স আমাদের ইতিহাসে নেই।
আজ বাঙালির এই শেকড় চিনে নিয়ে, পূর্বসূরীদের বাস্তুভিটেয় ফিরে গিয়ে, নিজেদের আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হয়ে ওঠার সময় এসেছে, আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলে শেষ করতে চাই।

বাঙালির জয় হোক! জয় গৌড়, জয় বঙ্গ।



 

1 comment: