Monday 26 September 2016

আলোচনা : বিদ্যাসাগরের নির্মোহ মূল্যায়ণ

(আলোচনায় তমাল দাশগুপ্ত ও দ্বারকা সেন শর্মা)

দ্বারকা : অগস্ত্য পুনরায় বারিধিশোষণকারী রূপে অবতীর্ণ হননি, এ আমাদের অশেষ দুর্ভাগ্য।



তমাল : কি হে, আবার অগস্ত্যকে ডাকাডাকি করছ কেন?



দ্বারকা : বাঙালির সাগরের এক নতুন বাণী জানতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তমালদা, কি আর করা?



তমাল : কোন সাগর?



দ্বারকা : বিদ্যা, দয়া ইত্যাদির সাগর বলে বাঙালি যাকে চেনে।



তমাল : ও আচ্ছা। তা কোন বাণীর কথা বলছো?



দ্বারকা : এই যে এইটা। ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫৩ সালে, নোটস অন সংস্কৃত কলেজ-এ লিখেছেন “কতগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কিন্তু সাংখ্য আর বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে বিষয়ে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসাবে ছাত্রদের ভালো ভালো ইংরাজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার”।



তমাল : এটা কোথায় পেলে?



দ্বারকা : ফেসবুকে কিছু লোক এটা খুব করে শেয়ার করছে। সুমিত সরকারের একটা প্রবন্ধে, প্রবন্ধটার নাম “Vidyasagar and Brahmanical Society”, এই নোটটার উল্লেখ পেলাম। Women and Social Reform In Modern India বলে একটা বইয়ে প্রবন্ধটা আছে। 

 



তমাল : হুম, এটা অনুবাদ যা বুঝছি। কারণ বিদ্যাসাগরী বাংলা অবশ্যই এটা নয়।



দ্বারকা : হ্যাঁ, মূলনোটটা ইংরেজিতে। মেকলের ক্রীড়নক তো ছিলেনই, কনফরমিস্ট বাঙালি তৈরিতে তাঁর লেখা প্রাইমারগুলির অবদান নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, সম্প্রতি শুনলাম শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় 'গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাস' বলে একটা বইও লিখেছেন। কিন্তু এরকমভাবে দেশজ দর্শনকে আক্রমণ। এতো ভাবাই যায় না।



তমাল: সাংখ্যকে ভ্রান্ত দর্শন বলেছেন আমিও দেখেছিলাম। এই নোটে যেটা আছে সেটা হল একটা ইন্টারমিডিয়ারি স্টেপ। মানে মাঝে এরকম ভাবা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত কিন্তু সত্যি সত্যি ভ্রান্ত ভারতীয় দর্শন পড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সংস্কৃত কলেজে। আমি ঈশ্বর গুপ্তের ওপরে কাজটা করতে গিয়ে দেখেছি। সেখানে সুমিত সরকারের রেফারেন্স দিয়েছিলাম

দ্বারকা : সবথেকে যেটা আশ্চর্য লাগছে, যে কোন দর্শনকে ভ্রান্ত বলাই যে ভ্রান্তির কাজ, এটা কি উনি জানতেন না? তাও আবার সাংখ্যের মত দর্শন। আর তার ওপর এই বিশেষ মতভেদ না থাকার কথা যে বলছেন, সেই মতদানকারীরা তো সবাই প্রতীচ্যের। এটা কি সাগরসম গভীরতার লক্ষণ?



তমাল : আসলে তখন একদল সাহেব ছিলেন ওরিয়েন্টালিস্ট, এরা চাইতেন ভারতের দর্শন, ভারতের ধর্ম, ভারতের সাহিত্য এসবই পড়ানো হোক ব্রিটিশের স্কুল কলেজে। এর বিপরীতে আরেকদল সাহেব ছিলেন, তারা পশ্চিমবাদী, তাদেরই নেতা মেকলে। এরাই জিতেছিলেন। বিদ্যাসাগরের নিয়োগ এদের মাধ্যমেই হয়েছিল।



দ্বারকা : হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো সুবোধ গোপালের জয়গান গেয়ে প্রতিবাদহীন ব্রিটিশ-দাস বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করতে এত দায়বদ্ধ ছিলেন।



তমাল : মেকলের এজেন্ডা লাগু করছিলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ পড়ানোও সম্ভবত ওঁর সময়ে বন্ধ হয়েছিল। অথবা ওঁর একটু আগেই। উনি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেননি অবশ্যই।



দ্বারকা : দেশজ ডিসিপ্লিনগুলোর একেবারে মূলে আঘাত আর কি। সুমিত সরকার বিদ্যাসাগরের মন্তব্যকে "blunt and aggressive" বলছেন। দিয়ে তাকে জাস্টিফাই করতে চেয়েছেন "কন্টেক্সট"-এর কথা বলে। বেনারস সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ Ballantyne বেশ কিছু ভিন্নমুখী ধারা চাইছিলেন, যেমন Mill-এর লজিকে গুরুত্ব কমানোর পক্ষপাতী ছিলেন। এই মিল প্রসঙ্গে ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল-এর কথা মনে পড়ে যায়। তো Ballantyne চেয়েছিলেন সেই একঘেয়ে মিল ইত্যাদি কমিয়ে প্রাচ্যপাশ্চাত্য সমন্বিত চিন্তাপাঠ প্রবর্তন করতে। সেই প্রসঙ্গেই নাকি ঈশ্বরচন্দ্র সাংখ্য-বেদান্তকে ভ্রান্ত বলেন। এই জাস্টিফিকেশন মেনে নেওয়া কঠিন। ও হ্যাঁ, সুমিতবাবুর লেখা থেকে জানলাম যে বিদ্যাসাগরকে নব্যন্যায়কেও বালখিল্য মনে করতেন।



তমাল : ঈশ্বর! আমার জাতির কি অসামান্য ট্র্যাজেডি! অবথেকে বড় ট্র্যাজেডি এই যে এই ইতিহাসের সামনে চোখ তুলে দাঁড়ানোর সাহস নেই আমাদের। বাম আমলে বিদ্যাসাগরকে আইকন হিসেবে তুলে ধরা। তবে সেটা না করলেও বাঙালি তাঁর অনুগামী থাকতো। কিন্তু অনুরাগী হয়েও আমাদের স্বীকার করতেই হবে, যে তিনি পশ্চিমের হাতের ক্রীড়ানক ছিলেন।



দ্বারকা : হ্যাঁ বিদ্যাসাগরের সদর্থক দিকগুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে, সেটা ঠিকই। পূর্বে সংস্কৃত কলেজে অ-দ্বিজ দের প্রবেশাধিকার না থাকায় শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ-বৈদ্যেরা সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ পেতেন। ঈশ্বরচন্দ্র জাতিনির্বিশেষে হিন্দুমাত্রেরই সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নাধিকার সুনিশ্চিত করেন। আর বিধবা বিবাহের ব্যপারটা তো আছেই।



তমাল : বিধবা বিবাহ আন্দোলন সম্পর্কে অবশ্য নানা বক্তব্য আছে। বিধবা বিবাহের উদ্যোগ প্রথম করেছিলেন ঢাকার রাজা রাজবল্লভ সেন। প্রায় কেউই সেই ইতিহাস জানে না। 

দ্বারকা : সেটা ঠিক। ঈর্ষান্বিত কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপের পন্ডিতমন্ডলীকে কাজে লাগিয়ে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা না করলে মহারাজ রাজবল্লভ সেনই বিধবা-বিবাহ প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত হতেন।



তমাল : বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার পশ্চিমনির্ভর ছিল। হাতের পুতুল না হলে ঐ সমাদর সাহেবরা করতোও না।



দ্বারকা: বহুবিবাহ রদের পেছনে বিদ্যাসাগর যে যুক্তি নিয়ে এগোচ্ছিলেন তার ফাঁকফোকরগুলো বঙ্কিম চমৎকার ধরেছিলেন। শাস্ত্রের দোহাই দিলে যে আরও গোলযোগ হতে পারে, ডিফেন্স যে শক্তপোক্ত হয় না, সেটা বঙ্কিম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন। আমার তো বঙ্কিমকে অনেক বেশী যুক্তিবাদী মনে হয়েছে।



তমাল : সে তো বটেই। রাজদণ্ড ব্রিটিশের হাতে, তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে তখন শিক্ষিত বাঙালি। বিদ্যাসাগরের সব কাজই অদ্ভুতভাবে পশ্চিমমুখী ছিল। তার মধ্যেই বঙ্কিম যদি তার বঙ্গদর্শনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরণের আন্দোলন শুরু না করতেন, তাহলে এই অবস্থাটার হাত থেকে মুক্তি পেতাম না আমরা।



দ্বারকা : সদর্থক কাজগুলি সত্ত্বেও এই মেকলের অনুচরবৃত্তিকে ক্ষমা করা যায় না। সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে টেবিলে চটিশুদ্ধু পা তুলে দেওয়া প্রভৃতি যে কাহিনীগুলো আছে তা যদি সত্যিও হয়, তাহলে তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিরোধ। নীতির ক্ষেত্রে এক আত্মসমর্পণকারী ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না বোধহয় তাঁকে। আর শিক্ষানীতির কুফল তো সুদূরপ্রসারী। শিক্ষার ভিত কে মূলহীন করে এক দুর্বল দিশাহীন প্রজন্ম তৈরির পেছনে তাঁরই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তাই না? একদিক দিয়ে নেহরুর পূর্বসূরি বলা যায় ।



তমাল : বিদ্যাসাগর শুরু করেছেন ইংরেজের চাকুরে হিসেবে। সে যুগের যুগধর্মই তাই। বঙ্কিমও তাই করেছেন। কিন্তু দেখ, সেখান থেকে নিজের হিন্দু ঐতিহ্যকে পুনরাবিষ্কার করার কাজ শুরু করলেন বঙ্কিম।
দ্বারকা : ঠিকই।



তমাল : বিদ্যাসাগর যে সময়ে জন্মেছেন, সেই সময়ে হিন্দু ঐতিহ্যকে যারা রিপ্রেজেন্ট করেন, তারা রক্ষণশীল। মানে রাধাকান্ত দেব টাইপ। তাদের বিপরীতে রয়েছে রিফর্মাররা, যাদের উৎস রামমোহনে। এরা সবাই ব্রিটিশের মোহিনীমূর্তিতে মুগ্ধ। বিদ্যাসাগর এই দলে ছিলেন।


দ্বারকা : ঠিক, রামমোহনের উত্তরসূরি বলাটা অনেকটাই যুক্তিযুক্ত।



তমাল : এখন, নিজের যুগধর্মের বাইরে যাওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। বঙ্কিম যে পেরেছিলেন, তার একটা বড় কারণ কি বলতো? সে যুগে ইউরোপেও জাতীয়তাবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছিল। বাঙালিরা সেই আন্দোলনের সম্পর্কে পড়ছিলেন, জানছিলেন।




দ্বারকা : হ্যাঁ। বঙ্কিম পাশ্চাত্যের তত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস এবং সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে তো রীতিমত চর্চা করেছেন।

তমাল : বিদ্যাসাগর নিজের যুগধর্মে সম্পূর্ণ বন্দী, আর বঙ্কিমও কিন্তু কিয়দংশে তাই থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই আনন্দমঠের শেষে বাঙালিরাজত্ব নয়, ইংরেজরাজত্ব গড়ে ওঠে। ইতিহাসের ডমিন্যান্ট ঝোঁকের বাইরে বেরোনো খুব কঠিন।



দ্বারকা : তোমার লেখায় বঙ্কিমকে ফেল করানোর ব্যাপারটা জেনেও আকাশ থেকে পড়েছিলাম।



তমাল : হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভালো লিখতে পারেন না এই কারণে বিদ্যাসাগর দু-বার তাঁকে ল্যাঙ্গুয়েজ পেপারে ফেল করান। ঐ পেপারের বাংলা পার্টটার পরীক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন।



দ্বারকা : শাস্ত্রীয় বিষয়েও বঙ্কিম বিদ্যাসাগরের বেশ কিছু লেখার প্রতিবাদ করেছিলেন। মানে বহুবিবাহের ব্যাপারটায় তো ধর যুক্তির দিকটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রথা বিষয়েও বেশ কিছু ভুল তথ্য বিদ্যাসাগর তাঁর লেখায় দিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র যার প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।



তমাল : আচ্ছা।



দ্বারকা : তারপরে সেই বিবেকানন্দকে শিক্ষকতার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা? আত্মীয়ের কুমন্ত্রণা শুনে আর কোন বিচার না করেই ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বঙ্কিম বাংলা লিখতে পারেন না, বিবেকানন্দ ছেলে পড়াতে পারেন না, দারুণ ব্যাপার !



তমাল : তবে বিবেকানন্দ যে বিদ্যাসাগরের স্কুল থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে বিদ্যাসাগরকে বেনিফিট অভ ডাউট দেওয়া যায়, কারন তখন বিদ্যাসাগরের জামাই স্কুলটা চালাতেন যদ্দুর জানি, তিনিই বরখাস্ত করেছিলেন, বিদ্যাসাগর সরাসরি কিছু করেননি।



দ্বারকা : গুলি চলবে, অথচ বন্দুকের মালিক কিছু জানবেন না, এটা বিশ্বাস করা কিন্তু কঠিন।



তমাল : হেহে।



দ্বারকা : তারপরে ধর নিজের লেখা বই নিজেই সুপারিশ করা, এগুলো তো ছেড়েই দিলাম।



তমাল : হুম। বিদ্যাসাগরের কথা ভেবে আমার একটু বিষণ্ণ লাগে, রবীন্দ্রনাথের মত রাগ হয় না। বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে মেকলের অবতার হিসেবে অবতীর্ণ, তখন, সেই সময়ে, সেই যুগে, অন্য কিছু করা, অন্য কিছু ভাবাটাই প্রায় অসম্ভব ছিল। বিদ্যাসাগর ইতিহাসের ট্র্যাপে বন্দী, অনেকটা রামমোহনের মতই।


দ্বারকা : হুম।


তমাল : রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বমানবতা করছেন, তখন সেটা কিন্তু সেই সময়ের যুগধর্ম, অর্থাৎ অগ্নিযুগের ধর্মকে লঙ্ঘন করছে। রবীন্দ্রনাথের সামনে তাই শুধু স্বদেশী হওয়ার চয়েস ছিল তাই নয়, উনি নোবেল পাওয়ার পর থেকেই সেই যুগে তাঁর দেশের প্রধান ঝোঁক অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিদ্যাসাগর যুগধর্মের দ্বারা বন্দী, রবীন্দ্রনাথ যুগধর্মকে পালটে দিয়েছেন। বঙ্কিম যেমন এককালে পাল্টেছিলেন।



দ্বারকা : একদমই তাই।



তমাল : রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ-উত্তর কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টরা অত্যন্ত সফলভাবে বাঙালিকে জাতীয়তাবাদ থেকে ডিরেইল করতে পেরেছেন। বঙ্কিম যদি বিপ্লব করে থাকেন, বঙ্কিম যেটা করেছিলেন তাকে যদি আমরা বিপ্লব বলি, এরা করেছেন প্রতিবিপ্লব। এবং তাতে এরা সফল।



দ্বারকা : হুম।



তমাল : তবে বিদ্যাসাগর ব্যক্তি জীবনে খাঁটি বাঙালি ছিলেন, কোনও সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে একটা ব্যাপারে আলোকপাত করতে চাই। বৃদ্ধ বয়েসে তিনি একবার কৃষ্ণকমলকে বলেন, আর যাই করি, ছেলেপুলেকে ইংরেজি কখনও শেখাব না। অসার ও ডেঁপো হওয়ার এমন পথ আর নেই। বিপিনবিহারী গুপ্তের "পুরাতন প্রসঙ্গ" বইটায় এটা পাবে। বৃদ্ধ বয়েসে বিদ্যাসাগর কিছুটা আগন্তুকের উৎপল দত্তের চরিত্রের মত হয়ে গেছিলেন, জানোই তো। সাঁওতালদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। সম্ভবত পশ্চিমী সভ্যতা সম্পর্কে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলেন।



দ্বারকা : বোধ হয়, ওখানে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও করতেন, কোথায় যেন পড়েছিলাম।



তমাল : এই মানুষটিই কিন্তু সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করেছিলেন যুবাবয়েসে। অন্যদিকে দেখো, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু যত বয়েস হয়েছে, ততই বিশ্বমানবতা বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। বরং অল্প বয়েসের রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তাই, বিদ্যাসাগর সম্ভবত এই জায়গায় রবীন্দ্রনাথের থেকে একটু ওপরে থাকেন। বিদ্যাসাগর ক্রমশ উপলব্ধি করেছেন পশ্চিমী লিবেরাল কু-প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ তাতেই গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাকে বিশ্বমানবতা নাম দিয়েছেন।



দ্বারকা : সমস্যা হল, দুজনেই বাঙালির দুই হোলি কাউ।

তমাল : হেহে, আমার একটা মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একজন সপ্তডিঙার ম্যানিফেস্টো পড়ে বলেছিল, সাংখ্য তো ভ্রান্ত দর্শন, বিদ্যাসাগর বলে গেছিলেন, তার পরে ওই সাংখ্যের ওপরেই নির্ভর করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেন তৈরি করা হবে? মজার ব্যাপার হল সেই ব্যক্তি নিজে সাংখ্য পড়েও দেখেননি, আর বঙ্কিম সাংখ্য নিয়ে কি বলেছেন তাও জানার চেষ্টা করেননি। স্রেফ বিদ্যাসাগর বলেছেন, তাই এটাই তার কাছে শেষ কথা।


দ্বারকা : এটাই ব্যাপার।



তমাল : বিদ্যাসাগর অনেকের কাছেই বেদ-কোরান-বাইবেল। তাদের কাছে, উনি যা বলে গেছেন, তার পরে আর কথা হয় না। বাঙালির এই বিদ্যাসাগর পুজো, বা রবীন্দ্রনাথ পুজো ইতিহাসজ্ঞান বিবর্জিত। এই দুই মহাপুরুষের ঐতিহাসিক অবস্থান আমাদের বুঝতে হবে।


 




1 comment:

  1. বাঃ বাঃ কী লেখা! ব্যাদে অবশ্য এ সবই ছিল। এর পরের লেখাটা সতী দাহের সমর্থনে হোক।

    ReplyDelete